এসডিজি বাস্তবায়নে অগ্রগতি
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:১৪ পিএম | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় এমডিজির যেসব অর্জন অধরা রয়ে গেছে, সেগুলো অর্জন করার নিমিত্তেই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজির ধারণার সূচনা হয়। এমডিজির অসম্পূর্ণতা এবং টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখে ২০১১-১২ সালেই জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশ, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের নিকট হতে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে প্রস্তাবনা আহবান করে। তৎপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার থেকে একটি এবং বেসরকারি পর্যায়েও একটি প্রস্তাব দাখিল করা হয় (পিকেএসএফ, ২০২১)। ২০১২ সালের জুন মাসে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য একটি নতুন লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানগণ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সাথে ব্যাপক আলোচনা এবং বিতর্কের ভিত্তিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে প্রাপ্ত প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনা করে টেকসই উন্নয়নের একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করার জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। বাংলাদেশ উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য ছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনার পর টেকসই উন্নয়নের খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য এজেন্ডা ২০৩০ এর উদ্বোধনী ঘোষণায় বিশ্বনেতারা ঘোষণা করেন: ‘এই মহান সম্মিলিত যাত্রা শুরু করার সময়ে, আমরা অঙ্গীকার করছি যে, কাউকে পিছনে ফেলে রাখা যাবে না। মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখাই আমাদের মৌলিক দায়িত্ব, আমরা দেখতে চাই যে, অভীষ্ট এবং লক্ষ্যমাত্রাসমূহ সকল জাতি ও জনগণ এবং সমাজের সকল অংশের জন্য সমভাবে অর্জিত হয়েছে এবং সবচেয়ে সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে আমরা প্রথমে পৌঁছানোর চেষ্টা করব’। টেকসই অর্জনের পথে সমগ্র বিশ্বকে ধাবমান করার প্রয়াসে ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তারিখে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানগণের উপস্থিতিতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি), ২০৩০ গ্রহণ করে। এটি এজেন্ডা ২০৩০ নামেও পরিচিত। এসডিজিসমূহ তিনটি স্তম্ভের উপর নির্ভর করে: অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত, যাতে উন্নয়ন টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সামগ্রিক হয়। এ বৈশ্বিক এজেন্ডা প্রণয়নে বাংলাদেশ ১১টি অভীষ্ট প্রস্তাব করেছিল যার মধ্যে ১০টি অভীষ্ট হুবহু এবং ১টি অভীষ্ট অন্যান্য অভীষ্টের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক উক্ত উন্নয়ন এজেন্ডার জন্য ১৭টি অভীষ্ট, ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা এবং ২৩১টি সূচক নির্ধারণ করা হয়। ঘোষণার পর হতেই বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করে।
সরকার দেশের এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যে সকল দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, সে সকল পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মধ্যেই এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অর্জনের সকল উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। তবুও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো আরও নিবিড়ভাবে অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সূচনালগ্ন থেকেই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণে জিআইইউ সম্পৃক্ত আছে। এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতার নিরিখে এসডিজি’র লক্ষ্য ও সূচকসমূহের জাতীয় অগ্রাধিকার নির্ধারণের মতো কাজগুলো জিআইইউ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পাদন করেছে। তবে, এসডিজি’র সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে যেমন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল প্রয়োজন, তেমনি স্থানীয় জনসাধারণ এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সরাসরি অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপর্যুক্ত বাস্তবতার নিরিখে জিআইইউ জাতীয় ৩৯টি অগ্রাধিকার সূচক চিহ্নিত করার পর স্থানীয় পর্যায়ে অতিরিক্ত ১টি সূচক নির্ধারণের প্রস্তাব রেখে স্থানীয়করণের ৩৯+১ মডেল প্রস্তাব করে, যা মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। জাতীয় ৩৯ অগ্রাধিকার সূচকের আলোকেই বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়ন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। এসডিজি হলো একটি ডযড়ষব ড়ভ ঝড়পরবঃু অঢ়ঢ়ৎড়ধপয। এ প্রক্রিয়ায় সমাজের সকল অংশীজনকে যেমন সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন, তেমনি স্থানীয় জনসাধারণ ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩৯+১ মডেলের আওতায় +১ স্থানীয় অগ্রাধিকার চিহ্নিতকরণে জিআইইউ স্থানীয় জনসাধারণ, জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়িক ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করে ডযড়ষব ড়ভ ঝড়পরবঃু অঢ়ঢ়ৎড়ধপয এর যে উদ্ভাবনী পদ্ধতি অনুসরণ করেছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত এসডিজি স্থানীয় সূচক বাংলাদেশের সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট কর্তৃক বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণ, জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি, ব্যবসায়িক ও মিডিয়ার প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে অগ্রাধিকার সূচক চিহ্নিতকরণের যে কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে তা এসডিজি স্থানীয়করণে একটি সর্বজনীন আদর্শ মডেল। তবে, একটি অগ্রাধিকার চিহ্নিত না করে সার্বিক উন্নয়ন অগ্রাধিকার অথবা অভীষ্টভিত্তিক অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে তা উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তা অধিকতর সর্বজনীন এসডিজি স্থানীয়করণ মডেল হতে পারে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, যেটি আসলে এসডিজি-১ এবং এসডিজি-২ এর মূল বিষয়বস্তু। সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এসডিজিতে যে কাঠামো প্রদান করা হয়েছে, সেটি সরকার তার নিজস্ব উন্নয়ন এজেন্ডাতে সম্পৃক্ত করেছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বৈশ্বিক অঙ্গীকারও পূরণ করা। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের আকাঙ্খা পূরণে সরকার ইতোমধ্যে গৃহহীন ও ভূমিহীন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, দুর্গম এলাকায় ও বিপন্ন অবস্থায় বসবাসকারীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো এসডিজি অগ্রগতি করেছে এরূপ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম হয়েছে বিধায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০২১ সালে টেকসই উন্নয়নের নবম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে SDG Progress Award প্রদান করা হয়। ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাশাপাশি বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাও বৃদ্ধি পায়।
দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় সঠিক এবং কার্যকর অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে এসডিজির মতো উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অগ্রাধিকার সূচকসমূহ এমনভাবে চিহ্নিত করেছে যে, এগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে অগ্রাধিকার সূচকের সাথে অনেক বৈশ্বিক সূচকও বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। সার্বিক বিবেচনায় নতুন সূচকসমূহ টেকসই কৃষি, অসমতা হ্রাস, গুণগত শিক্ষা, জেন্ডার সমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি বাংলাদেশের নিজস্ব অগ্রাধিকার প্রকাশ করেছে। জাতীয়ভাবে এসডিজির অর্জন আশাব্যঞ্জক হলেও স্থানীয়করণে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এসডিজি স্থানীয়করণে পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর না হলে নির্ধারিত সময়ে এসডিজির সকল টার্গেট অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু একটি কার্যকর এসডিজি স্থানীয়করণ মডেলের জন্য বৈশ্বিক ২৩১টি সূচক এবং জাতীয় ৩৯টি অগ্রাধিকারের আলোকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সামগ্রিক একটি অগ্রাধিকার সূচক তালিকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি উক্ত সূচকসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের যোগানসহ সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। বর্তমানে যে অগ্রাধিকার সূচকসমূহ চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রাপ্ত অগ্রাধিকারসমূহ বাস্তবায়ন করলে তৃণমূল অংশীজনের মধ্যে সরকারি পরিকল্পনায় তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি যেমন স্বীকৃতি পাবে, তেমনি স্থানীয় জনগণও উপকৃত হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি
যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত
১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান
জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণদের প্রস্তুতি নিতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা
২০২৫ সালে নিম্নমাধ্যমিক-মাধ্যমিকে ৭৬ দিনের ছুটির তালিকা প্রকাশ
খুলনা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকার পথে যুক্ত হচ্ছে ট্রেন জাহানাবাদ
প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত গ্রহনযোগ্য নির্বাচন দিন
আশুলিয়ায় কিশোর গ্যাং এর হামলায় আহত ৩
মাদারীপুরে পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব হলেন সরওয়ার আলম