প্রতারিত হয়ে কত মানুষ নিঃস্ব হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:১৫ পিএম | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম
বাংলাদেশে যুবক, ডেসটিনির মতো এমএলএম, ইভ্যালির মতো ই-কমার্সের প্রতারণা নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এমটিএফই নামে দুবাইভিত্তিক একটি কানাডিয়ান কোম্পানি সাধারণ মানুষের প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রায় ৪২ লক্ষ মানুষকে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশিদের কাছ থেকে অনলাইন ট্রেডিংয়ের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার এই ঘটনায় ইতোমধ্যে সর্বমহলে তোলপাড় চলছে। কথিত প্রতিষ্ঠানটি অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে গ্রাহকদের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়ে বন্ধ হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক ইউনিট ইতোমধ্যে এনিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউই এর দায় নিতে চাইছে না।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এমটিএফই (MTFE) এর পূর্ণ রূপ হল মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (Metaverse Foreign Exchange Group), যে বিভিন্ন বৈদেশিক মূদ্রা, সূচক, কমোডিটি, স্টক এবং ক্রিপ্টো মার্কেটের একটি ট্রেডিং ব্রোকার! এমটিএফই মূলত কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং পুরোটাই একটি জুয়ার প্লাটফর্ম। এখানে যারা হিসাব খুলে গ্রাহক হয়েছে, টাকা বিনিয়োগ করেছে, তাদের উদ্দেশ্য পণ্য ক্রয় করা নয়, বরং একটি কৃত্রিম পণ্য ক্রয় করা হয় এবং পরোক্ষভাবে জুয়ায় অংশগ্রহণ করা। যার উদ্দেশ্যে হলো পরবর্তীতে তার মূল্য বৃদ্ধি হলে বিক্রি করা। এখানে যে ভার্চুয়াল পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হয়, তা কখনও হস্তগত করা হয়নি কিংবা হস্তগত করার উদ্দেশ্যও ছিল না। বরং নির্ধারিত সময় শেষে যে লাভ বা লোকসান হয় সেটাকে ভাগ বাটোয়ারার নামে প্রতারণা করে নেয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। নামসর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করতো বলে জানা গেছে। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগ হওয়া ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের। অ্যাপের মাধ্যমে এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেছিলেন অন্তত ৪২ লক্ষ মানুষ। ভুক্তভোগীরা এ ঘটনায় দুবাই প্রবাসী কুমিল্লার মাসুদ নামের একজনকে দায়ী করছেন।
অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে, এর আগে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) ১৯৯৬ সালে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেয় এবং এর ঠিক একদশক পর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে যুবকের অবৈধ ব্যাংকিংসহ নানা প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সরকার তখন একটি কমিশনও গঠন করে। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুবকের ৩,০৩,৭৩৯ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের দাবির পরিমাণ ২,৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০০০ সালে ডেসটিনি এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসায়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু। কোম্পানিটি ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। তখন ডেসটিনির ক্রেতা, পরিবেশক ও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৪৫ লক্ষ। এরপর ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে ইউনিপেটুইউ নামের আরেকটি কোম্পানি ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের লোভ দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করে। ভুক্তভোগীরা বলেছে, ইউনিপেটুইউতে তারা ৬ হাজার কোটি টাকা জমা রেখেছিলে এবং তাদের কেউ টাকা ফেরত পায়নি। তবে দুদকের মামলায় ইউনিপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ছয়জনের সাজা হয়। তাছাড়া, ২০১৮ সালে বিপুল ছাড়ে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির কথা বলে ই-কমার্স ব্যবসায় নামে ইভ্যালি। এরপর ই-অরেঞ্জ, আলেশা মার্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একই কায়দায় মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করে।
মূলত এমএলএম বা মাল্টি-লেভেল মার্কেটিংয়ের বাংলা পরিভাষা হচ্ছে বহুস্তর বিশিষ্ট পণ্য বিপণন পদ্ধতি। এটি মধ্যস্বত্তভোগীদের বাদ রেখে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পণ্য বিক্রয় করে এর লাভের একটা অংশ পুনরায় ক্রেতার কাছে ফেরত দেওয়ার জন্যই এমএলএম’র জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশে জিজিএন বা গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্ক ও টিসি বা টং চং নামের দুটি কোম্পানির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে এমএলএম’র জন্ম হলেও এই পদ্ধতিটি প্রথম আবিষ্কার করেন ১৮৬০ সালে আমেরিকার এক ফেরিওয়ালা, যার নাম হেনরি হেইনজ। ১৯৩৪ সালে আধুনিক এমএলএম’র জন্ম হয় এবং এর আবিষ্কারকের নাম ড. কার্ল রেইনবর্গ। ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় বিলের মাধ্যমে এই ব্যবসার আইনগত স্বীকৃতি পেলে এর বিকাশ দ্রুততর হয়। ১৯৯৮ সালে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত নারায়ণ দাস নামের এক ব্যক্তি কানাডা থেকে খবর পান যে, দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশে এমএলএম’র খুব ভালো সম্ভাবনা আছে। তিনি সেই আশায় বাংলাদেশে দ্রুত বড়লোক হওয়ার পদ্ধতি এমএলএম কোম্পানি খুলে বসলেন। কিছুদিন পর তার কোম্পানি ভেঙ্গে গেলে টং চং নামের আরেকটি কোম্পানি নতুন করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় নিউওয়ে প্রাইভেট বাংলাদেশ লি: এবং ডেসটিনি-২০০০ লি: নামের আরো দুইটি কোম্পানির জন্ম হয়। তাদের এই কার্যক্রম দেখে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে দিন মজুর থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীর মানুষ এ পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে প্রতারণার শিকার হন। অনেক জায়গা থেকে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নামে মামলা হয় এবং পত্রিকায় এদের প্রতারণার রিপোর্ট বের হয়। কিন্তু এগুলোর প্রতিকার আজও হয়নি।
জানা গেছে, প্রতারণার ঘটনা ফাঁস হওয়ার আগে এমটিএফই নিজেকে অনলাইন বিনিয়োগের প্ল্যাটফর্ম দাবি করত। প্রতিষ্ঠানটির অ্যাপ থেকে গ্রাহকরা রেজিস্ট্রেশন করে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারতো। কোম্পানিতে ৯৩০ ডলার বা ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৪৫ হাজার টাকা লাভ দিত। ৫০০ ডলার বা ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ২২ হাজার টাকা লাভ দিত। এছাড়া কেউ যদি ৩,৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে এবং ১৫ জন ব্যক্তিকে কোম্পানিতে যুক্ত করে আর এই ১৫ জন মিলে যদি ৯ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে তাহলে ৩,৫০০ ডলার বিনিয়োগ করা ব্যক্তি প্রতি মাসে অন্তত ৪ লাখ টাকা করে লাভ পাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ ও ১৫ জন নতুন গ্রাহক যুক্ত করলে যে কোনো গ্রাহক হতেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও। জানা যায়, এমটিএফই-এর এমন চারশ’ সিইও ছিল। গ্রাহকদের লোভের ফাঁদে ফেলে অ্যাপটি দ্রুত প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। শুধু নাটোরে এমটিএফই’র ৫০০ জন ভুক্তভোগী ছিল এবং কোম্পানিটি ওই জেলা থেকেই অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সাধারণ মানুষও অতিলোভে আকৃষ্ট হয়ে এদের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়েছে।
এমটিএফই’র তথ্য অনুযায়ী, তাদের অ্যাপে বাংলাদেশ থেকেই মোট ৮ লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়; দুবাই, ওমান, কাতার, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এমটিএফইতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে তার কোনো অফিস নেই এবং তার অ্যাপ এতটা লোভনীয় যে এখানে লোকসানের কোনো সুযোগ বা অপশনই নেই। শুরুর দিকে বিভিন্ন অ্যাপ বানিয়ে অ্যাপগুলোতে বিকাশ অথবা নগদের মাধ্যমে মূল অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকানো শুরু করে। এরপর সাপ্তাহিক একটি অপশন চালু করলেই টাকা জমা শুরু হয়। যার নিচে যত মানুষ (রেফারেন্স) তার তত ইনকাম। ৯ হাজার ডলার জমা হলে সেই ব্যক্তিকে ওই এলাকার সিইও বানানো হয়। তিনি অতিরিক্ত কমিশন পান আরো তিন হাজার ডলার।
এমটিএফই’র ‘সিইও’ হতে হলে বিনিয়োগকারীকে প্রতি সপ্তাহে দুইজন নতুন গ্রাহক আনতে হতো। সেই নতুন বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ থাকতে হবে কমপক্ষে ৫০১ মার্কিন ডলার। ‘সিইও’রা যাদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছে, তাদের কাস্টমার সার্ভিসসহ সব ধরনের সাপোর্ট দিত। ভুক্তভোগী এক যুবক গণমাধ্যমকে বলেছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি সিইও হওয়ার ক্যাটাগরিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং তার অধীনে ১০০ জনের বেশি যুক্ত হয়েছিলেন। তার বিনিয়োগ ছিল ছয় লাখ টাকা। তিনি যখন লভ্যাংশের টাকা তুলতে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেন, প্রতিষ্ঠানটি তখনই সার্ভার আপডেট শুরু করে। ফলে কেউই কোনো টাকা তুলতে পারেননি। মূলত এটা ছিল একটি প্রতারণার কৌশল। অবশ্য সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন থেকেই এই প্ল্যাটফর্মটি নিয়ে সতর্ক করে আসছিল। কিন্তু মানুষ লোভের ফাঁদে পড়ে এখানে টাকা দিচ্ছিল। কিছুদিন আগে জানা যায়, এখানে যারা টাকা দিচ্ছিল তারা আর টাকা উঠাতে পারছিল না। এমটিএফই তাদের সিস্টেম বন্ধ করে দিয়েছে।
আসলে ভালো অর্থে এমএলএম’র জন্ম হলেও বাংলাদেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এমএলএম কোম্পানিগুলো সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব লুট করে নিচ্ছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ৭০টি এমএলএম কোম্পানি আত্মপ্রকাশ করেছে। তারপর থেকে বাংলাদেশে এমএলএম কোম্পানির অনুমোদন বন্ধ রয়েছে। অথচ, বেসরকারি হিসাবে শুধু ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১৫শ’ এমএলএম কোম্পানির জন্ম হয়েছে। ইউনিপে নামের একটি এমএলএম কোম্পানির কবর রচিত হলে তারপর থেকে নতুন করে এমএলএম কোম্পানির জন্মের নিরব বিস্ফোরণ ঘটে। এমএলএম বা ডাইরেক্ট সেল কোম্পানি নামের নানা ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান কী কী পণ্য ও সেবা কী দামে বিক্রি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এসব পণ্য ও সেবার গুণগত মান সম্পর্কে অবগত নয় সরকারি মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই। শুধু একটি ট্রেড লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রার অব দ্য জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ থেকে একটি রেজিস্ট্রেশন নিয়েই ব্যবসা ফেঁদে বসেছে বাহারি নামের নানা এমএলএম কোম্পানি।
বাংলাদেশের প্রথম এমএলএম কোম্পানি জিজিএন বা গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্ক ১৯৯৮ সালে যখন তাদের কোম্পানি শুরু করে তখন সাধারণ অবুঝ পরিবেশকদের থেকে হিসাব ছাড়া সার্ভিস চার্জ আদায় করে। পরে যখন সদস্যরা বুঝলো যে, তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে তখন কোম্পানি বলেছিলো তাদের সার্ভিস চার্জ ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু তা ফেরত দেওয়ার আগেই তারা লাপাত্তা হয়ে যায়। এরপর ডেসটিনি-২০০০ লি: কর্তৃপক্ষ ২০০১ সাল থেকে একটানা ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ পরিবেশকদের বুকিং পদ্ধতিতে পিপিসির মাধ্যমে ২৭৭৫ টাকা জমা দিয়ে কাজ করার সুযোগ প্রদান করে। তারা ওই টাকা সমন্বয় করার কঠিন পদ্ধতি দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে। কয়েক লক্ষ মানুষ থেকে যে টাকা সে সংগ্রহ করেছিলো তা আর কেউই ফেরত পায়নি।
ডেসটিনি-২০০০ লি: যখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, তখন ভিন্ননামে ২০০৬ সালের জুন মাস থেকে ‘ট্রি প্লান্টেশন লি.’ নামের একটি প্রজেক্ট চালু করা হয়। পরিকল্পিত কোনো গাছের প্রকল্প না থাকলেও গাছের উপর বিনিয়োগের নামে মানুষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে। প্রজেক্ট থেকে আগে প্রত্যেক বিনিয়োগের সাথে গাছের একটি সনদ দেয়া হতো। কিন্তু যখন দেখা গেলো তার যেসব প্রকল্পে এখনও গাছ লাগানো হয়নি, সেসব প্রকল্পের গাছের সনদ বিক্রয় করছে। পরে পত্রিকায় এই নিয়ে লেখা-লেখি হলে সনদ না দিয়ে শুধু টাকা জমার রশিদ দিয়েই শেষ করেছে। একই পদ্ধতিতে পরবর্তীতে নিউওয়ে, ইউরো ট্রি প্লান্টেশন এবং টিসিএল নামের এমএলএম কোম্পানি ‘ট্রি প্লান্টেশন লি.’ চালু করে মানুষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
বহুস্তর বিশিষ্ট বিপণন কোম্পানি এমটিএফই বাংলাদেশে রীতিমতো প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা নগদ, বিকাশ। কিন্তু প্রতারণার ঘটনার পর এখন সরকারি সংস্থাগুলোর কেউই দায় নিতে রাজি নয়। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার জন্য বাংলাদেশে আইন আছে, তবে অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তারপরও এমটিএফই এ ধরনের ব্যবসা করে কীভাবে অর্থ হাতিয়ে নিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমকে বলেছে, তারা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি)।
এর আগেও বাংলাদেশে এমএলএম ও ই-কমার্সের নামে প্রতারণার বড় বড় ঘটনা রয়েছে। ২০০৬ সালে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) অনিয়মের বিষয়টি উঠে আসে। ডেসটিনিতেও টাকা রেখে কেউ ফেরত পাননি। এ ঘটনা জেনেও ইউনিপেটুইউ নামক প্রতিষ্ঠানের একই ধরনের জালে আটকা পড়েন বিপুলসংখ্যক মানুষ। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রতারিত গ্রাহকের হিসাব অনুযায়ী, এমএলএম প্রতিষ্ঠান ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা প্রতারণার ফাঁদে আটকা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। প্রতারণার ঘটনাগুলো নিয়ে সরকার বহুবার তদন্ত করেছে, কমিশন গঠন করেছে, টাকা ফেরতের পথও দেখিয়েছে, অনেক মামলাও হয়েছে কিন্তু মানুষ টাকা ফেরত পায়নি, কোনো যথাযথ প্রতিকার বা সমাধান পায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমটিএফইর মতো অন্তত এক হাজার প্রতিষ্ঠান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। কেউ মাল্টিপারপাস সোসাইটি, কেউ ই-বাণিজ্য, কেউ জমি কেনা-বেচা বা এমএলএম নামে মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। অথচ, সরকার বিষয়টাকে হালকাভাবে দেখছে। প্রথমে যুবক, ডেসটিনির মতো এমএলএম; পরে ইভ্যালির মতো ই-কমার্স এবং এখন এমটিএফইর মতো ক্রিপটোকারেন্সির (ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা) মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের মোহে পড়েছেন তরুণরা। কেন এমন হচ্ছে, এ ব্যাপারে গবেষণা হওয়া দরকার। আপাতত সরকারের পক্ষে এসব বিনিয়োগ রোধে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর বিকল্প নেই; কিন্তু সরকার তা করছে না। মানুষেরও সচেতন হওয়া দরকার। অতি লোভের আশায় নতুন কোনো ফাঁদে পা দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের আগে শতবার চিন্তা করা উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত মানুষ প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হলে মানুষের ঘুম ভাঙ্গবে কিংবা কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
ধর্ম-বর্ণ নয়, সমান মর্যাদায় হোক নাগরিক পরিচয়: জোনায়েদ সাকি
এসবিএসি ব্যাংকের শরিয়াহ্ সুপারভাইজরি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
আ.লীগের হাতেও নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তুলে ধরেনি গণমাধ্যম!
ভারত বাংলাদেশ থেকে বস্তা বস্তা টাকা লুট করেছে : দুদু
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে সিটিজেন’স চার্টার অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত
মতিঝিলে বিশ্বমানের ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান শুরু আইসিডিডিআর,বি’র
স্বামীর অগোচরে স্ত্রী অন্য কারও সাথে কথা বলা প্রসঙ্গে?
চাঁদপুর মেঘনায় মালবাহী জাহাজে ৭ জনকে কুপিয়ে হত্যা, গুরুতর আহত ১
পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি
যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত
১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান
জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন