দক্ষ জনবলের অভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের ইন্টারনেট সেবা
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৩৫ পিএম | আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩০ পিএম
প্রযুক্তির বদৌলতে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন সহজতর করেছে মানুষের জীবনকে। সরকারের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিশ্বের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, যোগাযোগ তথা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুফল পাচ্ছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সহায়তায় ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্নের অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল উপকরণ কিংবা বিষয় হচ্ছে সন্দেহাতীতভাবে ইন্টারনেট। বর্তমানে ইন্টারনেটবিহীন এক সেকেন্ডও কি চিন্তা করা যায়!
১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের জন্য বিনা খরচে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের (সাবমেরিন ক্যাবেল) সাথে সংযুক্তির প্রস্তাব ছিলো। কিন্তু আফসোসের বিষয়, তৎকালীন বিএনপি সরকার ‘তথ্য ফাঁসের’ অজুহাতে এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতেই কৃত্রিম উপগ্রহনির্ভর ভি-স্যাট প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রথম দেশে সবার জন্য উন্মুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা হয়। তখন ব্যবহারকারীরা ডায়াল-আপ পদ্ধতিতে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতো। শুরুতে শুধুমাত্র ৬৪ কেবিপিএস ইন্টারনেট দিয়ে যাত্রা শুরু হয়, যার জন্য ভি-স্যাটের মাসিক ভাড়া ছিল ১০ হাজার মার্কিন ডলার। বিএনপি সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে প্রায় ১২ বছর পর ২০০৬ সালের ২১ মে সাবমেরিন ক্যাবল সি-মি-উই-৪ এর সাথে কক্সবাজার জেলা শহরের ঝিলংজা ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে যুক্ত হয় বাংলাদেশ, যার সক্ষমতা ৩০০ জিবিপিএস। পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবেল সি-মি-উই-৫ এর সাথে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে যুক্ত হয়, যা প্রথমবারের থেকে ৬ গুণ বেশি ১৮০০ জিবিপিএস সক্ষমতার। বাংলাদেশে ২০১২ সালে থ্রিজি এবং ২০১৮ সালে ফোরজি চালু হয়। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৬১ লাখেরও বেশি, যার মধ্যে মুঠোফোন ১১ কোটি ৪০ লাখের বেশি এবং ব্রডব্যান্ডে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি।
বিটিআরসি গ্রাহক পর্যায়ে ইস্টারনেট সেবা প্রদানের জন্য জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা কিংবা থানা পর্যায়ে চার ধরনের লাইন্সেসের অনুমোদন দেয়। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো এনটিটিএন (ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক)-এর সহায়তায় উল্লেখিত চার ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে। পরবর্তীতে এই চার ধাপের ব্যবসায়ীগণ গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান করে থাকে। কিন্তু হতাশাজনক সত্য হচ্ছে, ব্রডব্যান্ড অবকাঠামোতে উপজেলা কিংবা থানা পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের নানান সীমাবদ্ধতা, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে।
বর্তমানে এ পেশায় দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। এ খাতে ইঞ্জিনিয়ার, কাস্টমার সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার, ফাইবার টেকনিশিয়ানসহ বিভিন্ন পদে দক্ষ কর্মীর দরকার হয়। বাংলাদেশের সাধারণ কিংবা ভোকেশনাল শিক্ষা কারিকুলামে বাস্তবমুখী এই ধরনের প্রযুক্তিগত কোনো বিষয় বা ডিসিপ্লিন এখনও চালু হয়নি। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই সব বিষয়ে কোর্স চালু করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, ফলে দক্ষ জনবলের অভাবে গ্রাহক পর্যায়ে গুণগত মানের ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে নানা সময় প্যাকেট কিংবা পিং লসের কারণে ব্যান্ডউইথ অপচয় হয়ে থাকে। এ খাতে প্রচুর শিক্ষিত বেকারকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। এতে উপজেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যেমন দক্ষ জনবল পাবে, ঠিক তেমনি দেশের বাইরেও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এতে বিদেশ হতে প্রচুর রেমিটেন্স আসার খাত সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ অনুযায়ী, কোনো ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান পপ, ম্যাক, ডিশ ব্যবসায়ী অর্থাৎ রিসেলার কিংবা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু দেশের কিছু অসাধু ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর কারণে বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বৈধ উপজেলা বা থানা পর্যায়ে লাইন্সেসধারী ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা। কিছু অসাধু ইন্টারনেট ব্যবসায়ী প্রচুর মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সৃষ্টি করছে। কিন্তু দিনের শেষে তাদেরও মুনাফার প্রাপ্তি শূন্য। আইনের বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও কিছু ডিশ ব্যবসায়ী ইন্টারনেট ব্যবসায়ে যুক্ত হবার কারণে উপজেলা পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা সঠিক সংযোগ ফি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি অধিক মুনাফার আশায় অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের যথাযথ ও গুণগত ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন গ্রাহকরা ঠকছে, অপরদিকে প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বিটিআরসির কার্যালয় আছে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাতে। তাই মাঠ পর্যায়ে ইন্টারনেট কার্যক্রম দেখভাল বা তদারকি করা তাদের পক্ষে অনেকাংশে অসম্ভব। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনীর নিকট অবৈধ ব্যবসায়ীদের দমনে সুস্পষ্ট তেমন কোনো দিক নির্দেশনা কিংবা বিধি-বিধান নেই। পাশাপাশি (রিসেলার) গ্রাহকদের তথ্য ও লগ সার্ভার সংরক্ষণে অধিকাংশ সময় তারা উদ্যোগ নেয় না, যা জাতীয় নিরাপত্তা জন্য হুমকি।
বাংলাদেশে অধিকাংশ আর্থিক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যাংকসমূহ তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন খাতে অর্থলগ্নী করলেও ইন্টারনেট সেবা খাতে আগ্রহী না। ফলে এখনো প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে মাঠ পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড অবকাঠামো যথেষ্ট দুর্বল ।
গ্রাহক সচেতনতার অভাবেও ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুই ধরনের সেবা গ্রাহকদের প্রদান করা হয়। তা হলো ডেডিকেটেড এবং শেয়ারড। ইন্টারনেট জগতে ডাটা আদান-প্রদান হয় বিট এককে। অর্থাৎ ১ এমবিপিএস (মেগাবিট) হচ্ছে ১২৮ কেবিপিএসরে (কিলোবাইট) সমান। উদাহরণ স্বরূপ: যদি একজন গ্রাহক ডেডিকেটেড ৫ এমবিপিএস সংযোগ নেন, তিনি প্রতি সেকেন্ডে ৬৪০ কেবিপিএস করে ডাউনলোড কিংবা আপলোড ব্যান্ডউইথ গতি পাবেন। অপরদিকে শেয়ার্ড সংযোগগুলো বিভিন্ন রেশিওতে হয়। ১:৮ হলে ৮০(৬৪০/৮) কেবিপিএস হতে ৬৪০ কেবিপিএস পর্যন্ত ডাউনলোড এবং আপলোড ব্যান্ডউইথ গতি পাবেন। কিন্তু অধিকাংশ গ্রাহক নিজের ব্যবহার চাহিদা অনুযায়ী ইন্টারনেট প্যাকেজ নিতে আগ্রহী নয়। অনেক গ্রাহক ৫০০ টাকার ৫ এমবিপিএস নিয়ে অত্যাধিক ডিভাইস ব্যবহার করতে চান। যার ফলে উপজেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা মুনাফা প্রাপ্তি তো দূরের কথা বরং বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাবার ব্যাপারে সন্দিহান। ব্যান্ডউইথ সীমাবদ্ধতার এই সুযোগটুকু অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা নিয়ে থাকে। গ্রাহকদের নানা লোভনীয় প্যাকেজ বা অফার দিয়ে আকৃষ্ট করে। এতে উপজেলা পর্যায়ের বৈধ লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরা মুখ থুবড়ে পড়ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের চাহিদা বাংলাদেশেও সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচুর শিক্ষিত বেকারের এ সুবিধা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরাই গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গুণগত মানের নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা অব্যাহত রাখতে পারে, যা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মূল চালিকাশক্তি। এ খাতের যথাযথ ব্যবহার করে বেকার যুবকরা উপকৃত ও স্বাবলম্বী হতে পারে। এতে যেমন বেকারত্ব কমবে, তেমনি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব ।
বর্তমানে বাংলাদেশে উপজেলা পর্যায়ে দুই হাজারেরও অধিক লাইন্সেসধারী ব্যবসায়ী রয়েছে, যাদের অধিকাংশই অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের অপকান্ড ও দক্ষ জনবল সংকটের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক সম্পন্ন কিংবা চলমান রয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। আমার বিশ্বাস, সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ও সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে উপজেলা বা থানা পর্যায়ের লাইন্সেসধারী ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। যথাযথ হস্তক্ষেপ এবং দিক নির্দেশনার ফলে একদিকে ব্যবসায়ীরা যেমন বাঁচবে, অপরদিকে গ্রাহকদের কাছেও গুণগত মানের ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য হবে, প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হবে, সরকারের রাজস্ব ও রেমিটেন্স আয় বাড়বে ও জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হ্রাস পাবে।
লেখক: স্বত্বাধিকারী, মেসার্স এস.জে এন্টারপ্রাইজ (উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ পদক ২০২৩ প্রাপ্ত)।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা