সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৪০ পিএম | আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
বছরের এমন দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে না। সড়কে মৃত্যুর মিছিল যেন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। সড়কে যে শুধু মানুষের প্রাণহানি ঘটে তাই নয়, অনেক পশু পাখিরও প্রাণহানি ঘটে থাকে। পশুপাখি অবুঝ বলে তাদের উপর দায় চাপানো খুব সহজ। কিন্তু সড়কে মানুষ হত্যার দায় কে নিবে? সড়কে যাদের প্রাণহানি ঘটে তাদের বেশির ভাগই শিশু, তরুণ এবং কর্মক্ষম ব্যক্তি। বয়স্করা তেমন যাতায়াত করে না বলে তাদের মৃত্যার হার কম। সড়কে একজন মানুষের অপমৃত্যু তার পরিবারের জন্য কত বড় বিপদ ডেকে আনে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। রাষ্ট্রকেও সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতি বহন করতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম কম হয়নি। সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয়েছিল ২০১৮ সালে যখন রমিজউদ্দীন কলেজের দুই শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। সেই সময় বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটাতে তেমন কোন সুফল আসেনি। আসলে ক্ষতটা অনেক গভীরে। সড়ক ও পরিবহন অব্যবস্থাপনা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, রাতারাতি সেটা দূর করা সম্ভব নয়। সড়কে শৃঙ্খলা কোন পর্যায়ে আছে, তা যারা নিয়মিত সড়কে চলাচল করেন তারা জানেন।
যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে সেটার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ চালক থাকে অনভিজ্ঞ, অদক্ষ, সনদবিহীন। বাসের হেলপার দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মহাসড়কে গাড়ি চালানো হয়। কে নিবে এর দায়ভার? একটি প্রাণ চলে যাওয়ার পর যতই শোরগোল হোক, তাতে কি যায় আসে। আমাদের দেশে সড়কে মনিটরিং ব্যবস্থা যে খুবই দুর্বল, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সড়কে যদি সত্যিকারে শৃঙ্খলা থাকে, তাহলে দুর্ঘটনা বহুগুণে কমানো সম্ভব। আমাদের দেশের সড়কগুলোতে মিশ্র এবং ভিন্ন ভিন্ন গতির গাড়ি চলাচল করে। সেগুলোর মধ্যে বাস, ট্রাক, টেম্পু, প্রাইভেট কার, মাইক্রো বাস, মোটর সাইকেল, বাইসাইকেল, রিকশা, ভ্যান, লেগুনা, ভটভটি, নসিমন, করিমন, ইজি বাইকসহ নানা জাতের পরিবহন রয়েছে। বলতে গেলে, রাস্তার মধ্যে একটি জগাখিচুরি অবস্থা এবং সবাই একটি অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। নিয়মের তোয়াক্কা করা যেন কারও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কে কার আগে যাবে, তা নিয়ে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার নির্মম শিকার হচ্ছে সাধারণ যাত্রী ও পথচারী। তবে এসব দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার পিছনে পথচারীদের যে একেবারে দায় নেই, তা বলা যায় না। রাস্তায় যারা গাড়ি নিয়ে চলাচল করেন তারা সবাই জানেন, কিছু পথচারী অকারণে রাস্তা পার হন অসচেতনভাবে। তাদের ফুটপাত এবং ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করার কথা থাকলেও তারা সেটা এড়িয়ে যান। এর মূল কারণ হচ্ছে, সড়কে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা।
একটি জরিপে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৮০-৯০ শতাংশ ঘটে থাকে অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। একজন চালক হয়তো দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে সময় বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তার এই অপরিনামদর্শী চিন্তা মূল্যবান জীবন কেড়ে নেয়। বাসগুলো রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাফেরা করে। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলে। এর ফলে তীব্র জটের সৃষ্টি হয়। নিয়ম-কানুন কেউ মানছে না। যাত্রী তোলার জন্য পাল্লাপাল্লি চলে বাসগুলোর মধ্যে। এর ফলে সড়কে নৈরাজ্য তৈরি হয়। সময় নষ্ট হয়। এই সময় কভার করতে গিয়ে চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায়। প্রশ্ন হচ্ছে, চালকরা এত সাহস পায় কোথা থেকে? নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধে যদি কঠোর ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে নেয়া যেত, তবে কখনই এমনটি হত না। উন্নত দেশের সড়কগুলোতে গাড়ির চালকরা শৃঙ্খলা মেনে চলতে বাধ্য হয়। অনিয়ম করার কোন সুযোগ তাদের নেই। আমাদের দেশে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সড়কে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেও চালকেরা কিভাবে যেন পার পেয়ে যান। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি যেন সড়কে নৈরাজ্য আরো তীব্রতর করে তুলেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু যে প্রাণহানি ঘটে তাই নয়, অনেকে আহত বা পঙ্গু হয়ে এক বেদনাময় জীবনযাপন করে। বোঝা হয়ে উঠে পরিবারের জন্য। এছাড়ও আর্থিক ক্ষতি হয় প্রচুর। এক জরিপ মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়, যা মোট জিডিপির ২-৩ শতাংশ।
বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে গাড়ি যখন ওভারটেকিং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। হুটহাট ওভারটেকিং বন্ধ করার জন্য টহল পুলিশ কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। একমূখী লেনেও ইদানিং তীব্র জ্যামের সৃষ্টি হয়। অথচ সেটা হওয়ার কথা নয়। যে যার খুশিমত রাস্তায় চললে রাস্তার কোন শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকে না। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করার প্রবণতা এদেশের চালকদের মধ্যে প্রবল। আবার ফুটপাত বা ফুটওভার ব্রীজ ব্যবহার না করে রাস্তায় এলোপাথারি দৌড়াদৌড়ি করা পথচারীদের একটি মারাত্মক প্রবণতা। রাস্তায় গতি সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার পরও চালকেরা সেটা অমান্য করে। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। দুর্নীতি আমাদের পরিবহন এবং সড়ক ব্যবস্থাপনাকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। দুর্নীতির কারণে চালকরা অনেক সময় অন্যায় করেও পার পেয়ে যায়। সড়কে জীবন নিরাপদ রাখতে হলে দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে। যাত্রীকল্যাণ সমিতি ও বুয়েটের একটি জরিপে উঠে এসেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৯ হাজার। মৃত্যু হয়েছে ২৫ হাজার মানুষের এবং আহত হয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার মানুষ। গড়ে প্রতিদিন মৃত্যু ২০ জনের উপরে। ২০২০ সালেও ৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে একটি জরিপে উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গাড়ির অতিরিক্ত গতির কারণে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা না ভেবে এটাকে সড়কে হত্যা হিসাবে নিয়ে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিআরটিএ-কে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। ড্রাইভিং সনদ যেন সহজলভ্য না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। মহাসড়কের পাশ দিয়ে অপরিকল্পিত হাটবাজার ও দোকান পাট গড়ে ওঠা বন্ধ করতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, তাদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
পরিকল্পিত বাস স্টপেজ নির্মাণ এবং রাস্তা পারাপারের জন্য পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ, পরিবহন আইনের সংস্কার ও তার কঠোর প্রয়োগ, সড়কে যে প্রাণহানি হয়ে থাকে সেগুলোর দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা, পর্যাপ্ত ফুট ওভার ব্রিজ নির্মাণ, লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহল, বিআরটিএ-এর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতি বন্ধকরণ ও পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো, শ্রমিকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলকরণ, ভারী যানবাহন ও ট্রাক রাতে চালানো এবং চালকদের ৬ ঘন্টার ডিউটি নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে সরকারকে কঠোর হতে হবে। পরিবহন খাতের নৈরাজ্য নিরাপদ সড়কের অন্তরায়। সড়কে যদি শৃঙ্খলা আনতে হয়, তবে গাড়ির কাগজপত্র কঠোর ভাবে চেক করতে হবে এবং ট্রাফিক আইন মানতে হবে।
সড়কে টহল এবং ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা আমাদের দেশে পর্যাপ্ত নয়। টহল এবং ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা দ্বিগুন করা উচিত। সড়কের শৃঙ্খলা যে ভঙ্গ করবে, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও পর্যাপ্ত জরিমানার আওতায় আনতে হবে। কাউকে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ যেন না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে কোন দুর্ঘটনা ঘটার পর অনেক ক্ষেত্রে জানা যায়, প্রকৃত চালক নয়, অন্য কেউ গাড়িটি চালিয়েছিল। দুর্ঘটনা ঘটার আগে এটা জানা যায় না কেন? চেকিং ব্যবস্থায় আমাদের দুর্বলতা আছে। আমাদের দেশের সড়ক পরিবহন আইনের তেমন কোন দুর্বলতা আছে বলে মনে করি না। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে দুর্বলতা এবং অব্যবস্থাপনা। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তাদের আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। রাজধানীতে টহল চেকপোস্ট আরো বাড়াতে হবে। একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব নয়। পরিবহণ শ্রমিকদের কাছে কোনো মতেই সড়ক পথ জিম্মি হতে পারে না। পরিবহণ খাতে নৈরাজ্য বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিকভাবে সেটা মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, এই খাত নিয়ে প্রচুর রাজনীতি হয়। ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে কমে আসতে পারে সড়কে হত্যার সংখ্যা।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা