ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিস

Daily Inqilab মো. রফিক ভূঁইয়া খোকা

০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২৮ পিএম | আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩৬ এএম

১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন: ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। পাকিস্তানের অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশ ছিল পূর্ব বাংলা এবং তার অধিবাসীদের ভাষা ছিল বাংলা, যা এই ঘোষণায় উপেক্ষিত হয়। মূলত তখন থেকেই বাঙালিরা পাকিস্তান সরকারের শাসননীতিকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।

একটি দেশের মাতৃভাষা শুধু তার অধিবাসীদের ভাব প্রকাশের বাহন নয়। তা তার মান-মর্যাদা শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তথা তার স্বাধীন অস্তিত্ব ও স্বকীয়তার পরিচয় বহন করে। তাই বাঙালিরা বাংলা ভাষার ওপর এই আঘাতকে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র মনে করল এবং প্রতিবাদ জানাতে শুরু করল। ক্রমশই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান নেতৃবৃন্দের কঠোর মনোভাব এ দেশের জনসাধারণকে বিষিয়ে তুলল। গড়ে উঠতে থাকলো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সংগ্রাম। মাতৃভাষা আত্মোপলব্ধির মূর্ত রূপ, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও গৌরবোজ্জ¦ল জমাটবাঁধা স্মৃতিস্তম্ভ। আর তাই বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম বাঙালির কাছে ছিল অস্তিত্বের লড়াই। তাইতো আমরা দেখতে পাই (১৯৪৮-৫২)-র ভাষার লড়াই ছিল বাঙালির সর্বাত্মক লড়াই-সংগ্রাম। তখন এ দেশের জনগণের অকুতোভয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়া ছাড়া কোনের বিকল্প ছিল না।

প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাদের আর বেশি দিন একত্রে থাকা যাবে না। ৫২-র মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির পর এটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। এরই প্রেক্ষাপটে সংঘটিত ৫৪, ৫৮, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০-এর আন্দোলন এবং সর্বশেষ ৭১-র মুক্তিযুদ্ধ। আর যেহেতু ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সেহেতু মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের কথ উঠবেই। নেতৃত্ব, সংগঠন, আন্দোলন মিলে হয় সফলতা অর্জন। আর এসবের জন্য চাই যথা সময়ে চিন্তাশীল তথা জ্ঞানী ও বিচক্ষণদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অব্যাহত ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা তথা দেশ ও জাতির গঠনে সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। আর সে পথ ধরেই বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের এগিয়ে চলা। আর সেরূপ চিন্তা-চেতনা আলোকেই নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের মাত্র ১৮ দিনের মাথায় অর্র্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিস’।

মুসলিম শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা লালন-পালন ও সংরক্ষণ যাতে যথাযথভাবে পরিচালিত হয় সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই এই সংগঠন। তৎকালীন সুধী ও বুদ্ধিজীবীমহলের একাংশের সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগে গঠিত হলো ঐতিহ্যবাহী এই ‘তমদ্দুন মজলিস’। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস। তখন থেকেই সাংগঠনিক ও আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়। আর মূলত সে কারণেই এই সংগঠন ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন হিসেবে সর্বজনবিদিত। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক ‘আট দফা দাবি, নিয়ে গঠত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।’ তারপর এই সংগঠনের সাথে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ মিলে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।’

পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পুনর্বার ঘোষণা দিলে তমদ্দুন মজলিস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংগঠনটির ঢাকা কেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় শাখা কর্তৃক তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক এম.এ বার্ণিকের বই থেকে জানা যায়, ঢাকার বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে যে সর্বদলীয় সভা হয় তমদ্দুন মজলিস সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং মজলিসের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল গফুর পাকিস্তানের শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রের জবাবদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রাখেন।

উল্লেখ্য, সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৪৩ জন সদস্যের মধ্যে তমদ্দুন মজলিসের ছিল ১০ জন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আট তলায় অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ছিলেন অনড়। উক্ত কর্মসূচিতে সৈয়দ কমরুদ্দিন হুসেন শহুদও (তমদ্দুন মজলিস ময়মনসিংহ শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় যুগ লীগ নেতা) উপস্থিত ছিলেন। ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে শহীদদের মধ্যে শহীদ আবুল বরকত ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম সদস্য। ভাষা আন্দোলনের সময় শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘সিভিল লিবার্টি কমিটি’ গঠিত হলে মজলিসের নেতা আবুল হামিদ ছিলেন উক্ত কমিটির সদস্য। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে তমদ্দুন মজলিস ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা ও অবদানের কথা বিশেষভাবে বিবৃত হয়েছে।

তমদ্দুন মজলিসের নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঢাকার মিরপুর কলেজ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা, ভাষার ব্যাপক ব্যবহার ও বিস্তৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ভাষা আন্দোলনে ‘শহীদ সংখ্যা’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা ও কার্যক্রমে প্রমাণিত হয়, সংগঠনটি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জন্মগ্রহণ করেছিল, করেছিল লড়াই-সংগ্রাম এবং এ লড়াই আমাদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেই আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে তমদ্দুন মজলিস কখনো পিছ পা হয়নি, ঘটেনি সংগঠনটির সামান্য বিচ্যুতি। তাই বলা যায় এবং এটা ঐতিহাসিকভাবেও সত্য যে, তমদ্দুন মজলিস ছাড়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারে না। আর ভাষা আন্দোলন ছাড়া যুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কথা কল্পনাও করা যায় না।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, মদ্দুন মজলিস, ময়মনসিংহ বিভাগ
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনার দলবলকে আগলে রেখেছে বর্তমান প্রশাসন: সেলিমা রহমান

শেখ হাসিনার দলবলকে আগলে রেখেছে বর্তমান প্রশাসন: সেলিমা রহমান

রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ জনে

মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ জনে

অনতিবিলম্বে ভিসি নিয়োগ না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী ইবি শিক্ষার্থীদের

অনতিবিলম্বে ভিসি নিয়োগ না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী ইবি শিক্ষার্থীদের

৩শ' আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত: অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

৩শ' আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত: অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

বরিশালে রাইজিং স্কলার অ্যাওয়ার্ড ২০২৪ অনুষ্ঠিত

বরিশালে রাইজিং স্কলার অ্যাওয়ার্ড ২০২৪ অনুষ্ঠিত

ঈশ্বরদীতে সাপের কামড়ে ১ ব্যাক্তির মৃত্যু

ঈশ্বরদীতে সাপের কামড়ে ১ ব্যাক্তির মৃত্যু

৭ দিনের রিমান্ডে মশিউর রহমান

৭ দিনের রিমান্ডে মশিউর রহমান

সিলেট মহানগর শ্রমিক কল্যাণের ট্রেড ইউনিয়নের দিনব্যাপী কর্মশালা সম্পন্ন

সিলেট মহানগর শ্রমিক কল্যাণের ট্রেড ইউনিয়নের দিনব্যাপী কর্মশালা সম্পন্ন

দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ৪ ডিগ্রী বেশী মধ্য শরতের দুঃসহ গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত

দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ৪ ডিগ্রী বেশী মধ্য শরতের দুঃসহ গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত

নামাজের আগে বায়তুল মোকাররমে নাটকীয়তা

নামাজের আগে বায়তুল মোকাররমে নাটকীয়তা

জয়সয়ালকে ফেরালেন নাহিদ

জয়সয়ালকে ফেরালেন নাহিদ

সরকারের শিক্ষা-গণমাধ্যমসহ আরও কিছু সংস্কার কমিশন করার পরিকল্পনা আছে : নাহিদ

সরকারের শিক্ষা-গণমাধ্যমসহ আরও কিছু সংস্কার কমিশন করার পরিকল্পনা আছে : নাহিদ

তাসকিনের শিকার রোহিত

তাসকিনের শিকার রোহিত

কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ফাঁসির আসামি গ্রেপ্তার হলো ধামরাইয়ে

কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ফাঁসির আসামি গ্রেপ্তার হলো ধামরাইয়ে

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যার বিচার দাবিতে চাটমোহরে ছাত্র-জনতার মানববন্ধন

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যার বিচার দাবিতে চাটমোহরে ছাত্র-জনতার মানববন্ধন

বায়তুল মোকাররমের অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে যা বললেন খতিব রুহুল আমীন

বায়তুল মোকাররমের অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে যা বললেন খতিব রুহুল আমীন

গোদাগাড়ী সরকারি ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক, সাবেক এমপি লুৎফুন নেসা হোসেন মারা গেছেন।

গোদাগাড়ী সরকারি ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক, সাবেক এমপি লুৎফুন নেসা হোসেন মারা গেছেন।

দেড়শর আগেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস

দেড়শর আগেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস

ঝিনাইদহে ৮ মামলায় পুলিশের ৪৩ কর্মকর্তা আসামী

ঝিনাইদহে ৮ মামলায় পুলিশের ৪৩ কর্মকর্তা আসামী