উন্নয়নের নামে কর্তৃত্ববাদের যথেচ্ছাচার মেনে নেয়া যায় না
০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২৯ পিএম | আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩৬ এএম
অধিকার এবং উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তর্ক চলছে দীর্ঘকাল ধরে। এই তর্ক প-িত, নীতিনির্ধারক এবং অনুশীলনকারীদের মধ্যে চলমান। এই তর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি তত্ত্ব, যার নাম ‘কম অধিকার, বেশি উন্নয়ন’। অনেকেই মনে করছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের জন্য এ তত্ত্ব কার্যকর একটি পদ্ধতি। এই তত্ত্বের পরামর্শ হলো, কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে গণঅধিকার প্রক্রিয়ার হ্রাস ঘটলে তা মেনে নাও, কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাতে আরো সুবিধা দাও, তাকে আরও ধারাবাহিক এবং কার্যকর করো, যেন সে দক্ষ উন্নয়ন-ফলাফলের দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রান্তিকতা, চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতায় পরিপূর্ণ। এ তত্ত্ব নিজেই নিজেকে রদ করে। কারণ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, মানবাধিকার এবং টেকসই উন্নয়নের মধ্যে জটিল নৈকট্য ও নির্ভরশীলতা রয়েছে। একটাকে বাদ দিলে আরেকটা পঙ্গু হয়ে যায়। এ তত্ত্বের অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অগ্রগতি বৃদ্ধির জন্য আরও ভারসাম্যপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির কথা আমাদের ভাবতে হয় এবং ভাবনাকে সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা করতে হবে।
এটা তো অস্বীকারের উপায় নেই যে, অধিকার এবং উন্নয়ন হচ্ছে আন্তঃসম্পর্কিত ধারণা। তত্ত্বগতভাবে একটি অপরটির সাথে যুক্ত, পারস্পরিকভাবে তাদের একে অপরকে শক্তিশালী করা উচিত। নাগরিক অধিকার জনগণকে একটি কণ্ঠস্বর প্রদান করে, সরকার গঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতে অংশগ্রহণ করতে তাদের সক্ষম করে। এটি উন্নয়ন নীতিগুলিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে উন্নয়ন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নত জীবনযাত্রা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নাগরিক স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণ শক্তিশালী প্রগতি লাভ করে।
কম অধিকার, বেশি উন্নয়ন তত্ত্বের প্রবক্তারা দাবি করেন, গণঅংশীদারিত্বের যে প্রক্রিয়ার কথা বলে গণতন্ত্র, তা উন্নয়নের জন্য সব সময় ভালো নয়। জনগণের দাবিদাওয়া সব সময় উন্নয়নের পক্ষে থাকে না। তাদের দাবিকে বিবেচনায় নেওয়া উন্নয়নের জন্য সহায়ক হয় না অনেক সময়। জনপ্রিয় দাবি মাত্রই ভালো নয়। জনতাবাদের প্রতি সংবেদশীলতা কার্যকর নীতি বাস্তবায়নে বাধা তৈরি করে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও বড় আকারের প্রবৃদ্ধির পথে প্রায়ই গণদাবি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে ত্বরান্বিত করার জন্য টেকনোক্র্যাটিক কর্ততৃত্বপূর্ণ শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতা দেওয়া দরকার, যাতে আরও দক্ষতার সাথে সম্পদ সম্ভবপর হয়।
কিন্তু এই ব্যবস্থার সমস্যা হলো, এখানে থাকে জবাবদিহির নিদারুণ অভাব। জনতার নিকট দায়বদ্ধতাহীন সরকারের মধ্যে প্রতিনিয়ত জবাবদিহির ক্ষয় হতে থাকে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় প্রায়ই ভারসাম্যের অভাব থাকে, যার ফলে নেতারা জনসাধারণের যাচাই ও পছন্দকে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জবাবদিহির এই অনুপস্থিতি দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সম্পদের অপব্যবহারের দিকে ধাবিত করে, যা শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের লক্ষ্যকে ক্ষুণœ করে।
এই তত্ত্বের ব্যবহার প্রায়ই টেকসই উন্নয়নে মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে উপেক্ষা করে। স্বৈরাচারী সরকারগুলি, দ্রুত অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নে সক্ষম হয় বটে। কিন্তু সাধারণত তারা সেটা করে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মানবিক মর্যাদার বিনিময়ে। মানবাধিকার দমনের মাধ্যমে অর্জিত উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। উল্টো বরং তা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
এ ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে নাগরিকদের ভূমিকা হ্রাস করা হয় কিংবা বাদ দেওয়া হয়, যা উন্নয়ন উদ্যোগের উপর জনগণের মালিকানার বোধকে ‘নাই’ করতে চায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে জনগণের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ উন্নয়নের সঠিক চালক। উন্নয়নের নীতিকে অবশ্যই জনগণের চাহিদা এবং আকাক্সক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এই তত্ত্ব গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে সীমিত করার মধ্য দিয়ে উন্নয়নকে উৎসাহিত করে। ফলে এ উন্নয়ন সেই সব চ্যালেঞ্জের প্রতি উদাসীন থাকে, যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে জনগণ। বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় এ উন্নয়ন।
কর্তৃত্ববাদী শাসন দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই উন্নয়নের চেয়ে স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক লাভকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। মেয়াদ শেষে মানুষের মতামতে সঠিক উপায়ে নির্বাচিত হবার চাপ একটি সরকারকে জনবান্ধব হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই চাপ না থাকলে এই সরকারগুলো মানব উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশ সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চায় না। তারা বরং দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রতি নজর রাখে। তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাধনায় থাকে সরকার। এর মধ্য দিয়ে আপাত উন্নয়ন হয় বটে, কিন্তু তা সামগ্রিক এবং স্থায়ী উন্নয়নের বিনিময়ে।
এই তত্ত্বের অনুসারী সরকারগুলো দুর্নীতির প্রতি দুর্বল থাকে। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব থাকে, যা প্রকল্পগুলিতে ব্যাপক দুর্নীতির মচ্ছব তৈরি করে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলি প্রকৃত অগ্রগতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির বাহন হয়ে উঠতে পারে। বড় প্রজেক্ট শুধু বড় উন্নয়ন নয়, হয়ে উঠে বড় দুর্নীতিও। জনগণের সম্পদকে লুটের মাল মনে করার সুযোগ বাড়ে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি হতে থাকে। রাজনীতিকদের সাথে মিলে তারা জনগণের সম্পদের উপর শ্রেণীস্বার্থের মনোপলি কায়েম করে বসে।
জনতার নিকট দায়বদ্ধ একটি জবাবদিহিমূলক সরকারের আমলে মানুষের আয় ধীর গতিতে একটি বিশেষ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তা হয় স্থায়ী, টেকসই। সরকার পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া এখানে বিদ্যমান থাকে। ফলে উন্নয়নের টেকসই ভবিষ্যত বিদ্যমান থাকে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী, জবাবদিহিশূন্য সরকারব্যবস্থায় জনগণের মাথাপিছু আয় অনেক উঁচুতে উঠে গেলেও এর পতনের ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ, জনগণকে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য এবং শৃঙ্খলমুক্তির জন্য আজ হোক, কাল হোক লড়াই করতে বাধ্য হতে হয়। তখন নৈরাজ্য ও হানাহানি অর্থনীতির গতিরোধ করে এবং উন্নয়নের পতন ডেকে আনে। অধিকার হত্যা করে উন্নয়ন করা হলেও সেই উন্নয়ন অধিকারহীনতার প্রতিষেধক হতে পারে না।
উন্নয়ন হতে হবে মানুষের। আর মানুষের হাতে, মুখে, চোখে লাগাম লাগিয়ে তার উন্নয়ন হয় না। তার জন্য মুক্তি বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়নই উন্নয়নের প্রকৃত শর্ত পূর্ণ করে না। উন্নয়ন তাই কেবল স্থাপনা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন কেবলই অর্থনীতির ব্যাপার নয়। এতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকতে হবে, মানুষের ন্যায়সঙ্গত মতামত প্রকাশ ও প্রয়োগের স্বাধীনতা থাকতে হবে, সুযোগ-সুবিধাকে কোনো বিশেষ দল, শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জন্য কেন্দ্রীভূত করা যাবে না, স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবন ও জীবনমানের সুরক্ষার পরিবেশ থাকতে হবে। এসব বাদ দিয়ে চোখে পড়া উন্নয়নের প্রতিটি দৃশ্য আসল উন্নয়নের বদলে উন্নয়নের কৃত্রিম ছবি দেখায় মাত্র।
এ প্রেক্ষাপটে অধিকার এবং উন্নয়নের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির বদলে সমন্বয় তালাশ করতে হবে, যা হবে অধিক ভারসাম্যপূর্ণ, কম খরুচে এবং টেকসই। জনতার কর্তৃত্ব ও ভূমিকা সঠিক উপায়ে কাজ করলে টেকসই উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলি মানুষের মধ্যে অধিকার চেতনা জাগিয়ে তোলে এবং উন্নয়নের নীতিতে জনতার দৃষ্টিকোণকে অঙ্গীভূত করে। এ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং আইনের শাসনকে উৎসাহিত করে, যা উন্নয়ন প্রচেষ্টার ন্যায্যতা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উন্নয়নশীল দেশগুলি প্রায়ই বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সেখানে দুর্বল প্রতিষ্ঠান, জাতিগত উত্তেজনা এবং ঐতিহাসিক অবিচারের ধারা বজায় থাকে। এর মধ্যে যদি উন্নয়নের নামে কর্তৃত্ববাদের হাতে স্বেচ্ছাচারের স্বাধীনতা তুলে দেওয়া হয়, তাহলে জনগণের মূল্য পদপিষ্ট হবে। এখানে বরং জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে উৎসাহিত করা জরুরি।
লেখক: কবি, গবেষক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মারা গেলেন 'মুজিব' বায়োপিকের নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল
মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোর আয়োজিত যৌন শিশু পাচার প্রতিরোধে অ্যাডভোকেসি সভা অনুষ্ঠিত
যশোরে আদালত চত্বরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের বিক্ষোভ
ফাইনালে মুখোমুখি মেট্রো-রংপুর
চুয়াডাঙ্গার গোয়ালপাড়া থেকে ১ কেজি ১৯৪ দশমিক ৩২ গ্রাম ওজনের ৪টি অবৈধ স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছে বিজিবি
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির নিরপেক্ষ ভেন্যু দুবাই
কুয়াকাটা টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরাম’র সভাপতি কাজী সাঈদ, সম্পাদক মিজান
শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর চিঠি নিয়ে যা জানাল ভারত
বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে ৭ সদস্যের কমিশনে আছেন যারা
‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন’-এ বারের অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রস্তাব
সোনারগাঁওয়ে বাস-অ্যাম্বুলেন্সের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ১০
মামলা রেকর্ড করতে ঘুষ গ্রহণ, কুষ্টিয়ায় ওসি ও এসআই ক্লোজ
কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিতের ঘটনায় জামায়াতের ২ কর্মী বহিষ্কার
পতিত আওয়ামী স্বৈরাচারের গত ১৭ বছরের নির্যাতন ভুলে যাবার সুযোগ নেই: আমিনুল হক
পাবনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চে প্রাক বড়দিন উৎসব অনুষ্ঠিত
পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
ধর্ম-বর্ণ নয়, সমান মর্যাদায় হোক নাগরিক পরিচয়: জোনায়েদ সাকি
এসবিএসি ব্যাংকের শরিয়াহ্ সুপারভাইজরি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
আ.লীগের হাতেও নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তুলে ধরেনি গণমাধ্যম!
ভারত বাংলাদেশ থেকে বস্তা বস্তা টাকা লুট করেছে : দুদু