হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের আত্মপরিচয়ের সংকট এবং গণতন্ত্রের অগস্ত্যযাত্রা
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৯ পিএম | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
কিছুদিন আগে ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনে পৌরাণিক যুগের কথিত অখ- ভারতের মানচিত্র স্থাপন করতে গিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতিবাদ ও অনাস্থার সম্মুখীন হয়েছেন ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা অখ- ভারতের মানচিত্র স্থাপনকে শ্রেফ একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিল। আদতে তাদের সে ব্যাখ্যা ধোপে টেকে না। তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- এবং সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আড়ালে আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফ্যাসিবাদী চরিত্রের উত্থান ভারত রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভারতীয় ও প্রতিবেশীদের উদ্বিঘœ হতে বাধ্য করছে। বিশেষত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানদের নিয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এখন এক রক্তাক্ত পটভূমি রচনা করে চলেছে। দেশভাগের আগে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাভাগের দাবিকে গ্রাহ্য করতে সেই দাঙ্গা ফলপ্রসু হয়েছিল। এর চার দশক আগে বৃটিশ ভারতীয় সরকার যখন পিছিয়ে থাকা পূর্ব বাংলার উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক সুবিধার কথা ভেবে ঢাকাকে রাজধানী করে ১৯০৫ সালে আসাম ও পূর্ববাংলাকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ ঘোষণা করেছিল, তখন কলকাতার জমিদার, আমলা ও বাবু বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গমায়ের অঙ্গহানির বেদনায় কাতর হয়ে তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তুলে ৫ বছরের মাথায় বৃটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করেছিল। সেই হিন্দু বৃদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরাই ১৯৪৭ সালে এসে বলতে শুরু করলেন, আর কিছু ভাগ হোক বা না হোক বাংলাকে ভাগ করতেই হবে। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দেড়শ’ বছর পেরিয়ে এসে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন ভারতে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তণের কথা বিবেচনা করে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রবর্তণ করল, তখন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায় মুসলমানদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কলকাতার মেয়র হিসেবে হোসেন শহীদ সহরাওয়ার্দী কিংবা বাংলার মূখ্যমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হকদের আধিপত্য হিন্দুদের প্রমাদ গুণতে বাধ্য করেছিল। সেই বাস্তবতাই তাদেরকে বাংলাভাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এর মানে হচ্ছে, বাংলার হিন্দুরা মুসলমানদের শাসন করতে কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের শাসনে থাকতে প্রস্তুত ছিলনা। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের আধিপত্যের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ভারতরাষ্ট্র বা তথাকথিত অখ- ভারতবর্ষের ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছিল মুসলমান সুলতান ও মুঘলদের মাধ্যমে। আজকের হিন্দুত্ববাদীরা যে অখ- ভারতের ধারণা উপস্থাপন করছেন, তার নাম মৌর্য সা¤্রাজ্য। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রতিষ্ঠিত মৌর্য সা¤্রাজ্য তার পৌত্র স¤্রাট অশোকের সময় এসে সবচেয়ে বিকাশ লাভ করে। মহামতি অশোক কিন্তু সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বৌদ্ধ। তার অহিংস বানী এবং যাগযজ্ঞের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ক্ষেপে গিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করতে থাকলে অশোকের মৃত্যুর মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই মৌর্য সা¤্রাজ্য ভেঙ্গে বহুধা বিভক্ত সামন্ত শাসনে পরিনত হয়।
আজকের হিন্দুত্ববাদীরা এতটাই আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন যে, তারা এখন তাদের রাষ্ট্র ও ধর্মের নাম নিয়েও সংশয়বাদী হয়ে উঠেছেন। আদতে তাদের কোনো ধর্মগ্রন্থে হিন্দু বলে কোনো শব্দ নেই। একইভাবে হিন্দুস্থান নামেও কোনো রাষ্ট্র নেই। হাজার হাজার বছর আগে এটা থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। পঞ্চদশ শতকে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় পর্দাপণের আগে আমেরিকা নামে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। কলম্বাসের আগে নাকি আমেরিগো ভেসপুচি নামের একজন পর্তুগিজ নাবিক সেই ভূখ-ে পা রেখেছিলেন। সেখান থেকে ভ্রমণ করে এসে তিনি নাকি একটি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছিলেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর লোকমুখে চাউর হয়ে ‘আমেরিগো’স ল্যান্ড’ এক সময় ‘আমেরিকা’ হয়ে যায়। এখনকার জাতীয়তাবাদী আমেরিকানরা যদি হিন্দুত্ববাদীদের অনুকরণে আমেরিকা নাম পরিবর্তনের জিগির তুলতে শুরু করে? গণতন্ত্র ও বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে পদানত করতে এই একটি বণর্বাদী এজেন্ডাই যথেষ্ট। হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্ট, কু-ক্লাক্স-ক্লানদের এজেন্ডা কিংবা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ শ্লোগান মার্কিন সমাজে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী বিভক্তিই শুধু বাড়ায়নি, সেই সাথে বিশ্বের অভিন্ন সমস্যা-সংকট নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছিল। ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ, ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পারমানবিক সমঝোতাচুক্তি, জেরুজালেমের বিশেষ মর্যাদার প্রশ্ন, কয়েকটি বাণিজ্য চুক্তি, ইউনেস্কোসহ জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছিল, জো বাইডেন প্রশাসন এখন তা জোড়া লাগাতে কাজ করছে। তবে একবার ভেঙ্গে গেলে তা জোড়া লাগানো কঠিন। তবে ভারতে কিংবা আমেরিকায় একটি জনগোষ্ঠীর একক আধিপত্য এবং খ-িত স্বার্থের এজেন্ডা মাথায় নিয়ে রাষ্ট্রকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা একদিকে অখ- ভারতের কথা বলছেন, সে অনুসঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে রাষ্ট্রকে বিভক্ত, দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন করে তুলেছেন। কাশ্মিরের মুসলমানদের সাথে বিজেপি’র বিশ্বাসঘাতকতা কেউ সহজভাবে মেনে নেয়নি। কাশ্মির, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মনিপুর কিংবা পাঞ্জাব সর্বত্র এখন রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার সুর। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের অংশ না হয়েও বিশেষ মর্যাদার শর্তে সত্তুর বছরের বেশি সময় ধরে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরিরা বিচ্ছিন্নতার দাবি সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছিল। বিজেপি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় শাসনের নামে মূলত সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে প্রায় এক দশক ধরে কাশ্মিরের উপর যে রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন চলছে, তা কাশ্মিরিদের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। ভারতের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী ভারতের উদগাতা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নতুন প্রজন্মের নেতা রাহুল গান্ধী সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাকে জোড়া লাগাতে ‘ভারত জোড়ো’ পদযাত্রা করেছিলেন। সেই পদযাত্রাকে গণতন্ত্রকামী ভারতীয়রা সমর্থন জানিয়েছে। তামিলনাড়–র কন্যাকুমারি থেকে উত্তরে কাশ্মির উপত্যকা পর্যন্ত প্রথম পদযাত্রার পর বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি’র ভরাডুবি ঘটিয়ে কংগ্রেসের রাজনৈতিক পুনরুত্থান ঘটতে দেখা গেছে।
ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কি কখনো নিজেদের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ উদঘাটনের চেষ্টা করেছিল? হাজার বছর ধরে হিন্দুস্তান নামে প্রচলিত দেশ ও হিন্দু ধর্মের পরিচয় থেকে তারা এখন বের হয়ে একটি অনিশ্চিত যাত্রায় সামিল হতে চাইছে? হিন্দু, ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্তান একই শব্দের অপভ্রংশ থেকে উদ্ভুত। প্রাচীন গ্রীক ও পারস্য থেকে আসা অভিযাত্রীদল সিন্ধু নদের উপত্যকার এই অঞ্চলকে হিন্দ ও হিন্দুস্তান নামে অভিহিত করেছিল। পশ্চিমাদের কাছে ইন্ডাসভ্যালি হয়ে ওঠে ইন্ডিয়া। এর আগে বা পরে ভারত সম্পর্কে আর কোনো ন্যারেটিভস নেই। পঞ্চদশ শতকে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্যা গামা ভারতের নৌপথ আবিষ্কারের বহু আগে মুসলমান পরিভ্রাজক, পন্ডিত ও সুলতানরা বিশ্বের সামনে ভারতের দ্বার উন্মুক্ত করেছিলেন। ভারত নামক রাষ্ট্র এবং এর অধিবাসিদের সম্পর্কে পশ্চিমা দুনিয়া, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দূরপ্রাচ্যের মানুষদের জানার প্রথম গবেষণামূলক গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, ফারসি পন্ডিত আল বেরুনী। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইন্ডোলজি বা ভারত তত্ত্বের মূল ও প্রথম আকরগ্রন্থ হিসেবে এখনো আল বেরুনীর ভারত তত্ত্বকেই স্বীকার করা হয়। এক হাজার বছর আগে লেখা ভারত তত্ত্বে আল বেরুনী ভারতীয়দের যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছিলেন, গত হাজার বছরে হয়তো তার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। তা নাহলে, মুসলমানরা ৮০০ বছর বৃটিশরা পৌনে দুইশ’ বছর ভারত শাসন করতে পারত না। তবে আজকের ভারতের রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে, আল বেরুনী যে ভারতীয়দের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছিলেন, তা এখনো অটুট রয়েছে। তা নাহলে, হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় যে ভারতবর্ষের বিস্তার ঘটেছে, বিশ্বের কাছে তা হিন্দুস্তান, হিন্দুধর্ম এবং ইন্ডিয়া নামে বিশেষত্ব লাভ করেছে। সেই হিন্দুস্তান ও ইন্ডিয়া শব্দযোগ পরিত্যাগ করতে এতটা উদগ্রীব হওয়ার মধ্যেই আল বেরুনী বিধৃত ভারতীয় হিন্দুদের অদ্ভুত সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। পৌরাণিক অখ- ভারতে বিশ্বাসীরা উপমহাদেশের অন্যদেশগুলোর স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এ কারণেই চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও ভারতকে আঞ্চলিক বন্ধুহীন দেখা গেছে। দেশের অভ্যন্তরে ২৫ কোটি মুসলমানসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে বৈষম্য ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের জন্য কঠিন সময়েও ভারতে অনৈক্য, বিসম্বাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা গেছে। এই পূর্ববঙ্গ থেকে হিজরত করা একজন ভারতীয় হিন্দু লেখক অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে লন্ডনে বসবাসের পরও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলে বিষোদগার করেছেন। প্রয়াত নীরদচন্দ্র চেীধুরী তার আত্মঘাতী বাঙালী গ্রন্থে ইংরেজী শেখা এবং ইংরেজের সাথে সংশ্রবকে বাঙালীর পুনর্জন্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে এখনকার হিন্দুত্ববাদীরা ইন্ডিয়া নামকেই ঔপনিবেশিক দাসত্বের চিহ্ন হিসেবে দেখছেন। মুঘল-সুলতানি শাসনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে শত শত স্থানের নাম পাল্টে হিন্দুকরণের জোয়ারে এখন ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান এমনকি হিন্দু ধর্মের নাম পাল্টে ফেলার তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।
আজকের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা গত হাজার বছরে ভারতের রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাক্রমের সাথে মুসলমান ও বৃটিশদের অবদান ও ঐতিহ্যকে মুছে দিতে চাইছে। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মাণের ৫০ বছর পরে লিখিত তুলসি দাসের রাম চরিত মানস গ্রন্থের কোথাও রামের জন্মস্থান বা মন্দিরের উপর মসজিদ নির্মাণের তথ্য নেই। মুসলমান শাসনে শত শত বছর ধরে এই ভূখ-ে হিন্দু-মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে না পারলে এই রাষ্ট্রের ক্রমবিস্তার ও সমৃদ্ধি অসম্ভব ছিল। বাণিজ্য করতে এসে রাষ্ট্র দখলে নিয়ে বৃটিশরা এদেশের সম্পদ পাচার করলেও সুলতান মাহমুদের মত প্রথম দিকের আক্রমণকারীর কথা বাদ দিলে মুসলমান শাসকরা এদেশ থেকে সম্পদ পাচার করেননি। তারা দেশকে নিজের করে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। বৌদ্ধ স¤্রাট মহামতি অশোকের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে উঠলেও মুসলমান মুঘল স¤্রাট মহামতি আকবর ভারত রাষ্ট্রের ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বহুত্ববাদী আধুনিক ভারতের নির্মাতা হিসেবে উদারপন্থী ভারতীয়রা মহামতি আকবরকেই ভারতের প্রকৃত জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান। ভারতীয় হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কান্ডে কাটজু কয়েক বছর আগে নিজের ব্লগে নিবন্ধ লিখে এই দাবি করেছেন। মূলত ১৮৫৭ সালের বৃটিশবিরোধী বিদ্রোহের আগ পর্যন্ত ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন কখনোই এতটা প্রকট হয়ে উঠেনি। হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারত শাসনকে নির্বিঘœ করতে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি বা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ-বৈরিতা সৃষ্টির প্রয়াস দেখা যায়। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, রামমন্দিরের উপর বাবরি মসজিদ নির্মাণের প্রচারণা ছিল বৃটিশ পলিসির আওতায় প্রপাগান্ডার অংশ। বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগ শেষ করে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত স্বাধীন ভারতের বয়স এখনো আশি বছরও অতিক্রম করেনি। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গৌরবময় কাল হিসেবে পরিগণিত মৌর্য সা¤্রাজ্যের আয়ুষ্কাল ছিল প্রায় ৮০ বছর। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিদ্রোহের কারণেই অশোকের সা¤্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাতে আবারো ভারতবর্ষ পতনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতের মাটিতে মুসলমান গণহত্যা ও বিনাশের আলামত দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক জেনোসাইড ওয়াচের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একাধিকবার সতর্ক করার পরও ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিদ্বেষী তা-ব বেড়েই চলেছে। সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন এবং বহুত্ববাদী ধারণা চরমভাবে অগ্রাহ্য হচ্ছে। বাংলাদেশেবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুম-খুন, হয়রানি ও মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনায় এলিট ফোর্স র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা রকম সতর্কবার্তা দেয়া হলেও ভারতে মুসলমান গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে পশ্চিমারা অনেকটাই নীরব। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় মানবাধিকার কর্মী ও লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ভারতে এখন কী হচ্ছে, তা জি-২০ সম্মেলনে আসা পশ্চিমা নেতা জো বাইডেন ও ইমানুয়ের ম্যাখোঁ জানলেও তারা এ বিষয়ে মুখ খুলবেন না। গো রক্ষার নামে, মুসলমানদের প্রকাশ্যে হত্যা করা, মুসলমান মেয়েদের ধর্ষণ করা কিংবা প্রতিবাদী মুসলমানদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার পেছনে যে হিন্দুত্ববাদীরা দায়ী তাদের সাথে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত এবং রাষ্ট্রযন্ত্র একাকার হয়ে গেছে। প্রকাশ্য মুসলমান হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা হিন্দুত্ববাদের মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার ঘটনাগুলোকেও অরুন্ধতী রায় আল জাজিরার সাথে তার সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন। এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভারত বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হয়ে একটি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হতে চলেছে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা