অধিকার নিশ্চিত করে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে হবে
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:০৫ পিএম | আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং তার সমর্থনপুষ্ট বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনে নিজ দেশ এবং বসতভিটা ছেড়ে প্রায় সাড়ে বারো লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসাবে বসবাস করছে। তাদের প্রায় সবাই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী বর্তমানে তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা রাখাইন রাজ্যের মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। ফলে সেখানকার মুসলমানরা হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে, নারীরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে সে সময় প্রায় সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আর আগে থেকেই এখানে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করত। এই সময়ের মাঝে অনেক রোহিঙ্গা শিশু এদেশে জন্মগ্রহণ করেছে। সব মিলিয়ে এখন প্রায় সাড়ে বারো লাখ রোহিঙ্গা এদেশে বসবাস করছে। সেই থেকে রোহিঙ্গারা প্রতি বছরের ২৫ আগস্টকে গণহত্যা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। নিজ বাসভূমি, জমি জমা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সহায় সম্বল ফেলে আসা এসব মানুষে আজ সর্বহারা এবং ত্রাণের উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে। এভাবে বছরের পর বছর ধরে তারা তো আর বাংলাদেশে বসবাস করতে পারে না এবং তাদের ভার বাংলাদেশ অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত বহন করতে পারে না। এ সব রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। সুতরাং এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। তার জন্য বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করা এই সব রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে এবং মিয়ানমারে অবস্থিত তাদের নিজ ভিটাবাড়িতে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার। মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বৃটেন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। তখন এর নাম ছিল বার্মা। ১৯৬২ সাল থেকেই সেখানে সেনাবাহিনীর শাসন চলছে। সময়ে সময়ে গণতন্ত্র এলেও তা স্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশ সীমান্তের পাশ^বর্তী রাখাইন রাজ্যে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা সেখানে বসবাস করছে। প্রায় হাজার বছর আগে রাখিয়াং নামে এক জাতি ইসলাম গ্রহণ করে রোহিঙ্গা নাম নিয়ে মিয়ানমারে বসতি স্থাপন করে। সেই থেকেই রোহিঙ্গা বলে পরিচিত এই জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। অথচ, মিয়ানমার সরকার এখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে, যার কোনো প্রমাণ মিয়ানমারের হাতেও নেই। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারত এবং তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশটির সংসদে পাঠাত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর ‘বার্মিজ সিটিজেনশীপ ল’ নামে একটি আইন পাশ করে এবং এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। তখন থেকেই রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী। ২০১৪ সালের আদম শুমারিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাদ দেয়া হয়। মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য মতে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের হাতে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হবার কারণে ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধেক রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
প্রত্যেক মানুষের কতকগুলো মৌলিক অধিকার থাকে, যা যে কোনো দেশের, যে কোনো ধর্মের এবং যে কোনো নাগরিকের বেলায় সমভাবে প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাপী মানুষের এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সার্বজনীন মানবাধিকারের নীতিমালা গ্রহণ করে। সেই থেকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার দিবস পালিত হয়ে আসছে। আর মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকারের এই ঘোষণাপত্রে বিভিন্ন উপধারা সহ মোট ৩০টি মূলধারা সংযুক্ত করা হয়। এই ঘোষণাপত্রে-আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার, জাতীয়তা লাভের অধিকার, চিন্তা-বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, সভা-সমাবেশ করার অধিকার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশে সরকারে অংশ গ্রহণের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের অধিকার, সকলের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং সর্বোপরি শাসনতন্ত্র বা আইন কর্তৃক প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে বিচার বা আদালতের মাধ্যমে তার কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের এইসব মূলনীতি বিশে^র দেশসমূহ গ্রহণ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বসবাসরত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এবং প্রতিটি নাগরিকেরই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার, মত প্রকাশের এবং রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সকল অধিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরও রয়েছে। এখানে ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্রীয়ভাবে কাউকে চিহ্নিত করে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। যদি করা হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের সুস্পষ্ট লংঘন।
ইতোমধ্যে এই সংকটের ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে; কিন্তু এর কোনো সমাধান হয়নি। ফলে দিন দিন এই সমস্যাটা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে এবং এটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী সমস্যার আকার নিচ্ছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গার অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, রেডক্রস প্রধান, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারসহ বিভিন্ন দেশের পদস্থ কর্মকর্তাসহ অনেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে সর্বাত্বক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এখনো এই সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। বিদেশি রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সাহায্য দিলেও, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়াটাই প্রধান কর্তব্য। আর এটাই একমাত্র এবং স্থায়ী সমাধান। এসব রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য আমরা দাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা চাই, এসব উদ্বাস্তুদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে সহযোগিতা।
এই সংকটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া এবং তাদের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজ বসত বাড়িতে বসবাসের সুযোগ দেয়া। মোট কথা, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক করতে হবে। একই সাথে তাদের মিয়ানমারের মূল জনগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য অংশ করতে হবে। নিজ দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করাটা যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র এবং সরকারের নৈতিক দায়িত্ব, সেখানে মিয়ানমারের সরকার আজ সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয় তাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে আশ্রয় দেবার মতো শক্তি সামর্থ্য আমাদের নেই, এ কথা নিরেট সত্য। কিন্তু এর পরও শুধু মাত্র প্রাণে বাঁচানোর জন্য, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দিয়েছে। কারণ, এটা একটা মানবিক বিষয়। এখানে ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্র বিবেচনার বিষয় নয়। এখানে বাংলাদেশ বিশাল উদারতা, মানবিকতা এবং দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে। একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ যেভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা সত্যিই অতুলনীয়। বিশ্ববাসীর উচিত বাংলাদেশকে সর্বাত্বক সাহায্য সহযোগিতা করা।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা