ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০ পৌষ ১৪৩১

ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্বাপর নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও রূপান্তর

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:০৬ পিএম | আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম

ঔপনিবেশিক শাসনের আগের বাংলার দিকে দৃষ্টি দিলে একটি সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরম্পরা দেখা যায়। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির আগমনের আগে বাংলার ছিলো একটি সমৃদ্ধ দেশীয় সংস্কৃতি, একটি শক্তিশালী অর্থনীতি এবং একটি স্বতন্ত্র সামাজিক কাঠামো। এখানে ভাষিক বিশিষ্টতা ছিলো, ছিলো বৈচিত্র্যও। প্রধান ভাষা বাংলা একটি বিকশিত ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিকে উদযাপন করছিলো। বিভিন্ন উপভাষা নিজের গতিপথে চলমান ছিলো, সচ্ছন্দ ছিলো। কবিতা, সঙ্গীত, অনুবাদ এবং লোককাহিনীর সমৃদ্ধ প্রবাহ ছিলো তরঙ্গময়।

ইসলাম আগমনের আগ থেকে ঐতিহাসিকভাবে স্থানীয় বিশ্বাস ও বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র ছিল বাংলা। হিন্দু ধর্মও এখানে প্রভাব তৈরি করে, লাভ করে কিছু রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা। ইসলামের বিকাশ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে নিজের দিকে যেমন আকৃষ্ট করে, তেমনি সমাজে বিদ্যমান ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যেও আনে নতুন অভিব্যক্তি। সহাবস্থান ও সমবেত বিকাশের নতুন ধারা। মুসলিম শাসনামল বাংলার জনপদসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রথমবারের মতো গঠন করে বাংলা নামের দেশ। দীর্ঘ পরিসরে মুসলিম শাসন বাংলার ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশকে কৈশোর ও তারুণ্য দান করে। সামাজিক মননকে সুফিপ্রেমের পরশে নতুন মাত্রা দেয়। তার সাথে দীর্ঘ প্রতিবেশের ফসল হিসেবে হিন্দু সমাজে জন্ম নেয় ভক্তিবাদী জাগরণ। পরে উভয়ের যৌথতা এবং লোকায়ত নানা ভাব ও কুসংস্কারকে আলিঙ্গন করে জন্ম নেয় সমন্বয়ী ভক্তিধারা, শরীরপুজা, সত্যপীরপুজা ইত্যাদি। সুফিপ্রেম সেবা, নিষ্ঠা ও শুদ্ধতার সাধনায় মানবকল্যাণের অনুশীলনে নিবেদিত থেকেছে সমাজের অন্তরতলে।

উপনিবেশ-পূর্ব কালে উর্বর কৃষি জমির কারণে বাংলাকে ‘ভারতের চালের বাটি’ বলা হতো। ধান, পাট, গম, তুলা, আখ, আম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেল, রেশম, মরিচ, হলুদ, রসুন, আদা ইত্যাদির চাষ হতো বিপুলভাবে। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু ও পুকুর ভরা মাছের প্রবাদ বাংলার কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সমৃদ্ধিকেই বয়ান করে। কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের প্রাচুর্য ছিলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা ছিলো। প্রাচীনকালে প্রধানত কড়ির প্রচলন থাকলেও মুসলিম শাসনের শুরু থেকেই বিনিময় মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন হয়, যা বাংলার সমৃদ্ধ অর্থব্যবস্থাকেই ব্যক্ত করে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে বাংলার একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্য নেটওয়ার্ক ছিল। কৃষিজ ও শিল্পজাত পণ্যের রফতানিতে বাংলার আবেদন শুধু এশিয়ায় নয়, আফ্রিকায়ও ছিলো বিস্তৃত, ইউরেশীয় অঞ্চলও এখান থেকে আমদানি করতো উন্নত শিল্পদ্রব্য, বিশেষত মসলিন কাপড় ও তৈরি পোশাক। প্রাচীন তা-া, গৌড় ও বাকলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সাতগাঁও, সোনার গাঁর মতো বন্দরগুলো ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্থানীয় কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপীয় জাহাজগুলো এখানে আসে মূলত এখানকার সম্পদের টানে।

সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও এখানকার সমাজে শ্রেণীবিভাজন ছিলো বাস্তব একটি ব্যাপার। এটি ইসলামের পক্ষে সমাজে বৃহত্তর আনুকূল্য তৈরি করেছিলো। কারণ, ইসলামে বংশ বা পেশাগত বর্ণবাদের কোনো স্থান নেই। যদিও মুসলিম সমাজে তথাকথিত আশরাফ-আতরাফ বিভাজনের কথা বলা হয়, তা আসলে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে হাজির করা একটি বয়ান, যা জাতভেদ প্রথার মুসলিম সংস্করণ তালাশের উদ্দীপনা থেকেই অতিরঞ্জিত হয়েছে। মাত্রা, ধরন, প্রভাব ও ফলাফলে উভয়টির ব্যবধান ছিলো দুস্তর। এর মধ্যে সুফি ও ভক্তি আন্দোলন সমতার বিস্তার করেছিল। বাংলার সামাজিক গতিশীলতা ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।

শিল্প ও কারুকার্যের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র, জটিল পোড়ামাটির পাত্র এবং চমৎকার তাঁত পণ্যে উন্নত রুচি ও শৈলী খচিত হতো। স্থাপত্য ঐতিহ্যে ছিলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিকতা। শ্রেষ্ঠ নিদর্শনসমূহ তখন ছড়িয়ে ছিলো নানা শহরে, জনপদে। ঢাকার লালবাগ কেল্লা এবং মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদের মতো চিত্তাকর্ষক স্মৃতিসৌধ এখনো তার স্বাক্ষর হিসেবে জেগে আছে। সুলতানী আমল থেকে নবাবী আমল বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নতুন প্রগতি নিয়ে আসে এবং শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে অনন্য গতি দান করে। ঔপনিবেশিকতার পূর্ববর্তী কালপর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জনলগ্ন ভাষিক ঐশ্বর্যে বিস্তারিত হয়। যাবনী মিশাল বা মুসলমানী জবান তখন হিন্দু-মুসলমানের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা বা ব্যবহারিক ও সাহিত্যিক প্রকাশরীতি। এর নমুনা দেখা যাবে যেমন আলাওল, আবদুল হাকিমে, তেমনি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী থেকে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরেও। এমনতরো কবিদের রচনা ও জীবনবাদিতা বাংলা সাহিত্যের বিকাশে রক্তজল সর্বরাহ করছিলো।

নবাবী আমলে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতি বিশেষ স্থিতির দিকে এগুচ্ছিলো। কিন্তু এর মধ্যে বাস্তবতার আকাশে গুরুতর মেঘ জমছিলো দুই দিক থেকে। প্রথমত, মারাঠাদের আক্রমণ ও বর্বর ধ্বংসলীলা। দ্বিতয়ত, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বাড়-বাড়ন্ত। প্রথমে পর্তুগীজ, পরে ইংরেজ। মারাঠা-বর্গীদের আক্রমণে দেশ বিধ্বস্ত হয়, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প বিপন্ন হয়। মারাঠাদের নৃশংসতার বিবরণ পাওয়া যায় সমসাময়িক ইংরেজ ও বাঙালি লেখকদের ভাষ্যে। তাদের বিনাশ ও হত্যালীলার যে বর্ণনা গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণে রয়েছে, তাতেই স্পষ্ট হয় কী তীব্র আগুন, হত্যা, লুট, ধর্ষণ ও নৈরাজ্য নিয়ে তারা ধেয়ে এসেছিলো বাংলায়। আলীবর্দী খান প্রচ- বিক্রমে এদের দমন করেন এবং বাংলায় শান্তি নিশ্চিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় মেঘদল বাংলার আকাশকে ভয়াবহভাবে আচ্ছন্ন করেছিলো। পর্তুগীজদের বিতাড়িত করা এবং ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও ইংরেজদের অব্যাহত শক্তিবৃদ্ধি ও ছলে-বলে কৌশলে ক্ষমতাবৃদ্ধিকে মোকাবেলা করতে পারেনি নবাবী প্রশাসন। অবশেষে বণিকের মানদ-কে শাসকের রাজদ-ে পরিণত করার চেষ্টাকে প্রতিহত করবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধ পলাশীতে ব্যর্থ হলো ষড়যন্ত্রের ফলে। বাংলার স্বাধীনতা সূযর্ অস্ত গেলো, ঔপনিবেশিক শাসন দ্রুতই বাংলার সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রভাব তৈরি করলো।

ইংরেজ শাসনের অধীনে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা, প্রশাসনিক মাধ্যম ও উচ্চ মানদ-ের নিদর্শন হয়ে ওঠে, যার ফলে বাংলার মতো প্রাচীন ভাষার প্রাধান্য হ্রাস পেলো। ব্রিটিশরা পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল, যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাব ছিল। যদিও এটি আধুনিক জ্ঞানে বাংলার অন্তর্ভুক্তিকে সহজ করেছে, অপরদিকে এটি ঔপনিবেশিক মূল্যবোধকেও স্থায়ী করে। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের দ্বারা সমর্থিত খ্রিস্টান মিশনারীরা স্থানীয় জনসংখ্যার ধর্মীয় পরিচয় বদলাবার চেষ্টা করেছিলো। জনগণকে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিলো, ধর্মীয় দৃশ্যপট পরিবর্তনের এ চেষ্টা নানা উত্তেজনা ও জটিলতা তৈরি করে।

ঔপনিবেশিক আমলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়, আইন ব্যবস্থায় ব্রিটিশ কানুন প্রবর্তিত হয়। শিল্পায়নকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু সেটা হয় দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার বিনিময়ে। উপনিবেশ সবচেয়ে হীনবল করে বাংলার অর্থনীতিকে। উপনিবেশের আগে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও জনবান্ধব ছিলো যে অর্থনীতি, সেখানে নিরবচ্ছিন্ন লুটপাট ও প্রজাবৈরী নীতির মধ্য দিয়ে জীবনবিনাশী দুর্ভিক্ষ ও সম্প্রদায়গত গণদারিদ্র্য চাপিয়ে দিয়েছিলো ঔপনিবেশিকতা। তবে ভাষা, সাহিত্য, আইন, প্রশাসন, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রসমূহে ব্যাপক রূপান্তরের প্রণোদনা তৈরি হয়।

ব্রিটিশরা এমন নীতি প্রবর্তন করে, যা ঐতিহ্যবাহী কারিগরি শিল্প ও কারুশিল্পের পতন নিয়ে আসে। তারা নীলের মতো ফসলের চাষকে অবধারিত করেছিল। এটা করেছিলো ব্রিটেন ও ইউরোপের শিল্পায়নের স্বার্থে। স্থানীয় কৃষি ও কৃষকের চাহিদাকে তারা উপেক্ষা করেছিলো এবং কৃষিব্যবস্থার জন্য বয়ে এনেছিলো বৈরিতা। প্রথমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং পরে ব্রিটিশদের দ্বারা আরোপিত জমিদারি ব্যবস্থার ফলে কিছু মধ্যস্থতাকারীর হাতে জমির মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয়, যা কৃষকদের মধ্যে দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে তোলে। তাদের মেরুদ- দেয় ভেঙ্গে। ঔপনিবেশিক নীতিসমূহ প্রধানত মুসলিম জনসমাজকে পদপিষ্ট করে।

১৮২৮ সালে রাজা রামমোহনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মসমাজ। এর লক্ষ্য ছিল হিন্দু ধর্মের নববিন্যাস এবং একেশ্বরবাদ, যুক্তিবাদ এবং সামাজিক সংস্কারের প্রচার করা। আন্দোলনটি তার সমাজের গোঁড়া কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করে, নারীর অধিকার ও সামাজিক সমতার পক্ষে ওকালতি করে। ফলে বাল্যবিবাহ এবং বর্ণ প্রথার মতো সামাজিক কুফলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র হয়। মুসলিম শাসন এসবের উচ্ছেদ কামনা করতো। কিন্তু হিন্দু রীতি ও ঐতিহ্যে হস্তক্ষেপ করার নীতি মুসলিমদের ছিলো না। তখন থেকেই হিন্দুদের অগ্রসর একটি অংশ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছিল। রামমোহন রায় নতুন উপলব্ধির যে আলোকে শিখায়িত হন, তার ভিত্তি ব্রিটিশ সান্নিধ্যই ছিলো না, বরং তার তুহফাতুল মুওয়াহহিদিনের গ্রন্থ পড়লে স্পষ্ট হয় যে, ইসলামের প্রভাব তার ব্রাহ্ম মন গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছিলো। সেই প্রভাবকে আত্মীকরণ করে ইউরোপীয় চিন্তার সাথে তিনি বেদ-উপনিষদীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন আপন সমাজ ও সমকালের পরিসরে। সংস্কারের এই ধারা হিন্দু সমাজে চলমান ছিলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো সংস্কারকদের প্রচেষ্টার ফলে নারীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশদের প্রণোদনা বাংলায় ধর্মীয় উত্তেজনা ও সাম্প্রদায়িকতা বাড়িয়ে তোলে। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ন্যারেটিভসমূহ সাম্প্রদায়িক বাস্তবতাকে বিষিয়ে তুলছিলো। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, ঐতিহাসিক ও ভাষিক জমিতে সাম্প্রদায়িকতার উপাদানসমূহের চাষ হয় ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতায়, যার প্রধান ও পথিকৃত কণ্ঠগুলো ধ্বনিত হচ্ছিলো বাংলায়।

এরই মধ্যে ঘটছিলো বাংলায় জাতীয়তাবাদী উজ্জীবন। এই সময়ে বাংলা ভাষার রূপান্তর ছিল লক্ষণীয়। উনিশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষার প্রমিতকরণ নিশ্চিত হয়। ইংরেজির প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ফোর্ট উইলিয়াম ও কলকাতাকেন্দ্রিক বিশেষ চরিত্র লাভ করে। জনতার জবান থেকে বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতশাসিত একটি বাংলা শহুরে মধ্যবিত্ত্বের মধ্যে মাথা তুললো। ব্যাকরণ সামনে এলো এবং গদ্য হলো বিকশিত।

বাংলায় নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে শিক্ষা ছিল একটি মূল অনুঘটক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ভারতে একটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল এক শ্রেণীর শিক্ষিত ভারতীয় তৈরি করা, যারা ব্রিটিশ প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করতে পারে। এই ব্যবস্থা পশ্চিমা শিক্ষা, বিশেষ করে ইংরেজি-ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ কর্মচারীর ভূমিকা নেবে।

১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, জমির মালিকানার ধরন পরিবর্তন করে। ফলে জমিদারি মুসলিমদের হাতছাড়া হয়, নতুন ভূস্বামীদের ক্ষমতায়ন ঘটে এবং বাঙালি জমির মালিকদের একটি নতুন শ্রেণি তৈরি করে। জমির মালিকানার এই পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল ভয়াবহ। কারণ, এটি কিছু লোকের হাতে সম্পদ এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে। ঔপনিবেশিক প্রশাসন একটি বাজার-ভিত্তিক অর্থনীতির উপর জোর দিচ্ছিলো। এই পরিবর্তন বণিক, ব্যবসায়ী এবং পেশাদারদের উন্নতির সুযোগ তৈরি করেছে। পাট এবং টেক্সটাইল উৎপাদনের মতো নতুন শিল্পের উত্থান মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও প্রসারিত করে। বাঙালি মধ্যবিত্ত; তাই, শুধু জমির মালিকই নয়, পেশাদার, উদ্যোক্তা এবং দক্ষ শ্রমিক হয়ে উঠে। এই গোটা প্রক্রিয়া থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে গেলো বঞ্চিত।

জমিদারি, বাজারব্যবস্থা, প্রশাসনে চাকরি ও শিক্ষা থেকে কোণঠাসা মুসলিম জনগোষ্ঠী একদিকে সামাজিক জীবনে বৈষম্য ও বিভক্তি দ্বারা পিষ্ট হচ্ছিল, অপরদিকে প্রতিবেশী সমাজের নবজাগরণের চাপ তাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। তাদের ধর্মীয় উপাদান মুসলিম সমাজকে প্লাবিত করে নানাভাবে। বৈষ্ণব ধারার প্রভাব মুসলিম জীবনে সূফিপরিভাষা ও গুপ্ততত্ত্বের আবরণে অনুপ্রবেশ করে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা মুসলিম লোকজীবনে ‘না মুসলিম, না হিন্দু’ ধরনের এক রকম ভাবধারা ও অনুশীলন বিস্তৃত হয়।

অবশ্য পচন ও পতনের নানা উপসর্গের ভিড়ে সংস্কার আন্দোলন মাথা তুলে সবলে, যা একই সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতাকে ফিরে পেতে চাইছিলো, অপরদিকে কুসংস্কার ও অপচর্চা থেকে মুসলিম সমাজের উত্তরণ-প্রয়াসী ছিলো। ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের প্রতিরোধ, হাদা মিয়া, মাদা মিয়ার বিদ্রোহ স্বাধীকার প্রয়াসকে ধারাবাহিকতা দিলেও হাজী শরিয়তুল্লাহর সংস্কার আন্দোলন একটি তীব্র ও ব্যাপক সামাজিক সংস্কার নিশ্চিত করে, যা বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের অনুভূতিকে জোরদার করেছিলো।

লেখক: কবি, গবেষক
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
মাহফুজ আলমের কথায় ভারতের আঁতে ঘা
অপরাধ বাড়ছে কেন?
বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি  বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি

বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি

যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন

যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭

মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭

মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি

মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল

মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪

মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪

মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী

মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী

রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি

রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি

উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা

উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা

ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০

ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০

মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান

মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান

গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের

পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের

স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা