শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম | আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, শিক্ষকতা হলো একটি ব্রত, একটি আদর্শ, একটি নৈতিক মানদন্ড। কোনভাবেই একে কলঙ্কিত করা যাবে না। জন অ্যাডামস শিক্ষককে গধশবৎ ড়ভ গধহ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রূপকার।’ একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন চরিত্রবান। তিনি আদর্শের প্রতীক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তাদের চরিত্রে, কথায় ও কাজে কোনো পার্থক্য থাকবে না।’ শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যা সমাজের সবচেয়ে মৌলিক স্তরের উন্নতি ও উন্নত সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। আর এখানে শিক্ষার আসনে যিনি বসে থাকেন এবং সমাজের সবচেয়ে মৌলিক স্তরের উন্নতি ও উন্নত সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যান তিনিই শিক্ষক। ‘যিনি জানেন, তিনি করেন, যিনি বোঝেন, তিনি পড়ান’ (এ্যারিস্টোটল)। শিক্ষা জাতির মেরুদÐ হলে শিক্ষকরা হলেন স্নায়ুতন্ত্র, যার ভিতর দিয়ে সব সময় প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা, নতুন সভ্যতা। সভ্যতার সুচারু কারিগর হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক সর্বদাই মানবিক, নৈতিক। তিনি কখনোই ব্যবসায়িক চিন্তা করেন না এবং ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে সামষ্টিক উন্নতির চিন্তায় রত থাকেন। তিনি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধী এবং সার্বজনীন ও মানসম্মত শিক্ষার নিরলস প্রচেষ্টায় মত্ত থাকেন। যিনি শিক্ষক, তার পক্ষে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর কোনো রকম ক্ষতি সাধন সম্ভব হয় না। তিনি সর্বদা সৃজনশীল, অধিকারচেতা। তিনি ছাত্রদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্নের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখান, ছাত্রের ভিতরকে জাগিয়ে তোলেন, সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করেন। শিক্ষক সেই, যিনি সমাজে স¤প্রীতির বন্ধন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমম্পর্ক এবং পরিবেশ সৃষ্টিতে বা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা পালন করেন। যিনি প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য এবং সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে। তার কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য বলতে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শেখে, বলার সাহস সঞ্চয় করে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে।
শিক্ষক শব্দটি বহুরূপীভাবে প্রসারিত। তার মূল অর্থ হলো ‘শেখানো’ বা ‘শিখানো’। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, সংস্কার এবং নৈতিক মূল্যগুলি স্থাপন করতে দায়ী হন। শিক্ষার্থীদের জীবনে পরিবর্তন উপস্থাপন করেন। শিক্ষক একটি সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা আত্মপ্রসূত শিক্ষা পদ্ধতিতে কাজ করতে পারেন। শিক্ষকতার মূল দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের শেখানো, উন্নত করা, এবং তাদের নৈতিক আত্মবিশ্বাস উন্নত করা। এছাড়া, শিক্ষকের কাছে অধ্যাপনা এবং শিক্ষার প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ, বিদ্যার্থীদের একটি উপস্থিতি স্থাপন, শিক্ষার উন্নতিতে সহায়ক ও প্রোৎসাহন দেওয়া এবং তাদের জীবনে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা। শিক্ষা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। এটি একজন ব্যক্তির জীবনে স্বপ্ন এবং লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়। শিক্ষা দ্বারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতি সম্ভব হয় এবং এটি একটি সুস্থ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ মূল্যগুলি প্রতিস্থাপনে সাহায্য করে। সরকার এবং সমাজ শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে দায়ী হয়ে উঠে এবং শিক্ষা প্রণালী নির্ধারণ এবং পর্যায়ক্রম ব্যবস্থা করে তুলতে সাহায্য করে। শিক্ষকতা আমাদের সমাজের উন্নতি এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক স্বরূপ সম্পর্কিত এবং মানসম্মতভাবে উন্নত করতে সাহায্য করে। শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে শিক্ষক নতুন প্রজন্মের জীবন প্রস্তুত করে তোলেন এবং তাদের সমৃদ্ধ করেন। শিক্ষকতা একটি মানসম্মত পেশা। কারণ, এটি নতুন প্রজন্মের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। একজন শিক্ষকের ভ‚মিকা ও দায়িত্ব অফুরন্ত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়াই মুখ্য। তারা আমাদের জীবনকে স্পর্শ করে আর আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। শিক্ষকের অর্জিত বিদ্যা শিক্ষার্থীর মধ্যে কাক্সিক্ষত মান অনুযায়ী সঞ্চারিত করা খুব সহজ কথা নয়। শিক্ষকের শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হলো টেকসই জ্ঞান ও অনুসন্ধান। এসবের প্রতিফলন ঘটে চর্চার মাধ্যমে। অন্যদিকে শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক দক্ষতা আর বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের শিক্ষা। শিক্ষার বিভিন্ন দর্শন, মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, শিক্ষার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভ‚মি, আর্থ-সামজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষার অনুশীলন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। একজন শিক্ষকের স্বপ্ন তার ছাত্ররা তাকে একদিন অতিক্রম করবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে এ ধরনের শিক্ষকের বড়ই অভাব। তবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং সমাজ উন্নয়নে সব শিক্ষকেরই ভ‚মিকা থাকবে এমনটি নয়। একজন শিক্ষক আদর্শ মানবসৃষ্টির শৈল্পিক কারিগরও বটে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দেশনা ও আদর্শ জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হয়। তাই বলা হয়, ব্যক্তি মানব এখানে অর্থহীন। কিন্তু ব্যক্তি শিক্ষক সবার শ্রদ্ধার ও সম্মানের পাত্র। তাছাড়া শিক্ষক সমাজে, কল্যাণকর ও প্রভাবশালী সচেতন প্রতিনিধি। এক্ষেত্রে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক কর্মকাÐে নেতৃত্বদান, সংগঠিত মনোভাব সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব।
একজন সফল শিক্ষক হওয়ার জন্য কেবল বিষয়সংশ্লিষ্ট জ্ঞান ও শেখানো পদ্ধতিবিষয়ক জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে বিষয়গত জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্তি¡ক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও জানা দরকার। শিক্ষকের পেশাগত শিক্ষা এমন হবে, যা শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও শ্রেণি ব্যবস্থাপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তার পড়াশোনার পরিধি হবে ব্যাপক। আর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে আগ্রহ থাকবে অফুরন্ত। সেই সঙ্গে চিন্তা ও বিবেচনাবোধ থাকবে সীমাহীন। শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের জানতে ও বুঝতে হবে এবং তার সব কর্মকাÐে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত হবে। তবে উন্নত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকের, আর দক্ষ শিক্ষক তৈরি করার জন্য দরকার উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা।
প্রাচ্যদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সবসময়ই গুরু-শিষ্যের মতো ছিল। প্রাচীন ভারতের নালন্দা থেকে শুরু করে সোমপুর বৌদ্ধবিহার ও শালবন বৌদ্ধবিহার এবং নিকট অতীতের পÐিত সমাজ থেকে শুরু করে মাদ্রাসাভিত্তিক মৌলভী-ছাত্রের সম্পর্ক ও গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক পরস্পরকে মনে করিয়ে দেয়। যেখানে একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে একাডেমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে নীতি-আদর্শ শিষ্টাচারসহ ব্যবহারিক জীবনের সব ধরনের দিকনির্দেশনায় দীক্ষিত করেন। আর ছাত্র তার গুরুর সেই শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করে ভবিষ্যৎ জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা শিক্ষকের অনুপ্রেরণা ও মডেল অনুসরণ করেন। বর্তমান সময়ে ছাত্র-শিক্ষকের চিরায়ত সম্পর্কে চিড় ধরেছে। এর কারণ, এখন শিক্ষক কোনো আদর্শ ব্যক্তিত্ব নন আর ছাত্রও অনুগত শিষ্য নয়। বর্তমানে ছাত্র ও শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রে যেন পরস্পরের প্রতিদ্ব›দ্বী। এক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষকের ভ‚মিকা নিষ্ক্রিয়। বর্তমানে ছাত্ররাই সক্রিয় বলদর্পী। তারা যখন-তখন শিক্ষককে অপদস্ত ও লাঞ্ছিত করতে পারে, এমনকি প্রাণনাশের কারণও হতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা লক্ষ করা যায়। এতে রাষ্ট্রের মর্যাদার তেমন কোনো ক্ষতি হয় না বলে অনেকে মনে করেন, যদিও এই ধারণা একেবারেই ভুল।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থা এবং ছাত্র-শিক্ষকের দূরত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পাশপাশি শিক্ষকরাও কম দায়ী নন। বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতি নিয়ে কথা বলতে নেই, টিউটোরিয়াল-অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে নেই, পরীক্ষার সময় নকল ধরতে নেই, ব্যবহারিক-মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্ন করতে নেই, ক্লাসে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে ধমক দিতে নেই, চুলের ফ্যাশন ও পোশাক নিয়ে কথা বলতে নেই এবং শিষ্টাচার শেখাতে নেই। সর্বোপরি কোনো হিতোপদেশও দিতে নেই। ‘আতঙ্ক’ (১৯৮৬) চলচ্চিত্রের ন্যায়নিষ্ঠ অধ্যাপকের একটি বাণী এখানে মেনে চলতে হয়, ‘মাস্টার মশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।’ বর্তমান সমাজে শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষমতা যেখানে মুখ্য হওয়ার কথা ছিল, সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষাকে একরকম পরিত্যাগ করে প্রশাসক হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাচর্চায় নিজেদের যুক্ত করছেন। শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ কমছে, ক্ষমতার চর্চা বাড়ছে, যা শিক্ষার চিন্তা ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
লেখক: শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা