শিক্ষা-সংস্কৃতির বিপথগামিতা এবং বাংলায় নতুন মাৎস্যন্যায়ের যুগ
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২২ পিএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
খৃষ্টীয় সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে উগ্রবাদী হিন্দু রাজা শশাঙ্কের সময় বাংলায় চরম অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। সে সময়ে দেশে কোনো আইন শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার বালাই ছিলনা। প্রভাবশালী মানুষ দুর্বলদের উপর নিপীড়ন চালাতো। রাষ্ট্রীয় বিচার ও নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল। সে সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাকে মাৎস্যন্যায়ের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইতিপূর্বেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এরূপ সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা গিয়েছিল। সেই মৌর্য্য সা¤্রাজ্যের যুগেও কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রে মাৎস্যন্যায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন দ-দানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা মাছের রাজ্য সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোট মাছকে গ্রাস করে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবে, এটাই স্বাভাবিক। আইন প্রয়োগের অসামর্থ্য বা আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মত শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে এমন অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। শশাঙ্কের পতনের পর পাল রাজারা প্রায় একশ বছর ধরে বাংলায় শাসন ব্যবস্থা কায়েম রাখলেও দাক্ষিনাত্য থেকে আগত সেনদের কাছে পাল রাজাদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলায় সেন রাজবংশের উত্থান ঘটে। সেনদের জাতিভেদ, ব্রাহ্মন্যবাদী চিন্তাধারায় নি¤œবর্ণের হিন্দুরা নিস্পেষিত হতে থাকে। বৈষম্যপূর্ণ ও শ্রেণী বিভক্ত সমাজ কখনো শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনা। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেনের সময় সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মাত্র ১৭ জন অগ্রগামী অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ১০০৪ সালে আফগানিস্তান থেকে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলাদেশ আক্রমণ রাজা লক্ষণ সেনের সেনাবাহিনী প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করেনি। খবর শুনে রাজা নদীপথে পালিয়ে বিক্রমপুরে চলে আসেন। সেই থেকে বাংলায় নতুন দিনের সূচনা হয়। বৈষম্যপীড়িত, ভাগ্যবিড়ম্বিত হিন্দুরা সামন্ত জমিদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে এবং ইসলামের সাম্য-মৈত্রী ও শান্তির বানীতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে সামিল হতে থাকেন। অবশ্য এর আগে থেকেই আরব থেকে আগত পীর-আওলিয়াদের দ্বারা এ অঞ্চলের নি¤œ বর্ণের হিন্দুরা প্রভাবিত হয়েছিল। হিন্দু অধ্যুসিত পূর্ববাংলা ক্রমে মুসলমান অধ্যুসিত হওয়ার এটাই হচ্ছে সামাজিক-ঐতিহাসিক পটভূমি। বিদেশী শক্তির প্ররোচনায় নবাব সিরাজদৌলার পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় দুইশ বছরের জন্য বাংলা এবং ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এ উপমহাদেশ যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবর্তনের সম্মুখীন হয়, বিংশ শতকে দুইবার রাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটার পরও তার ধারাবাহিকতার রূপান্তর এখনো বিদ্যমান। বিশেষত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শেকড় বিচ্ছিন্নতার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের দেশ ও জাতিকে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শেকড় বিচ্ছিন্নতার সুত্রপাত হয়েছিল ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গর্ভনর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শিক্ষা সচিব লর্ড মেকলে বৃটিশ পার্লামেন্টে ভারতের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষাসহ স্থানীয় ভাষার বদলে ইংরেজী মাধ্যমকে একমাত্র ভাষা হিসেবে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ১৮৩৫ সাল থেকে ১৯৩৫ সাল, এই একশ বছর ধরে বৃটিশদের এজেন্ডা ভিত্তিক এক্সপেরিমেন্টাল শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জাতিসত্তা বিনাশে ষোলকলা পূর্ণ করেছিল। তবে বৃটিশদের কাছে মসনদ হারানো মুসলমানরা বৃটিশদের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক এজেন্ডার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সমর্থনের মাধ্যমে নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। এ জন্য বৃটিশ শাসনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও আধুনিক শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে এক সময়ের অগ্রসর ও সমৃদ্ধ জাতি হয়েও শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের বৈষম্য এবং সংক্ষুব্ধ মুসলমানরা হিন্দুদের চেয়েও অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। পলাশী যুদ্ধের পর প্রায় দেড়শ বছরের মাথায় ১৯০৫ সালে প্রথমে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলার অনগ্রসর মুসলমানদের কিছুটা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল বৃটিশরা। কলকাতার হিন্দু বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও জমিদারদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ রদ করার ক্ষতিপুরণ হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে সাড়া দেয় পূর্ব বাংলার কয়েকটি শিক্ষানুরাগী নবাব ও জমিদার পরিবার। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও কলকাতার কিছু শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক ও কবি-সাহিত্যিককে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও তাদের দলে দেখা গেছে। পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজের মেধাবী সন্তানরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সাফল্যজনক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ঢাকার নবাবদের পরামর্শে বৃটিশ সরকার পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্বকীয় সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পৃক্ত ও শিক্ষাব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, কারিকুলামসহ সামগ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ঢাকা শহরের অবকাঠামোগত বাস্তবতা বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কলকাতার শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতা ও অসহযোগিতা নিয়ে গড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অল্পদিনের মধ্যেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভিসি স্যার পি.জে. (ফিলিপ জোসেফ) হার্টগ এবং জর্জ হ্যারি লংলে(জিএইচ লংলে)’র অসামান্য অবদান রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় এবং প্রথম বাংঙ্গালী মুসলমান হিসেবে স্যার আহমেদ ফজলুর রহমান(এ এফ রহমান) পূর্ববর্তী ভিসিদের কৃতিত্বের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্নই শুধু রাখেননি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয় ধারায় নিজেদের সামর্থ্যরে জানান দিতে সক্ষম হন। স্যার এ এফ রহমান থেকে বর্তমান( ২৮তম) ভিসি আখতারুজ্জামান পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান পতনের ইতিহাস বিশেষভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ আজ এক সর্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা, অবক্ষয় ও অরাজকতার সম্মুখীন। এই বিশৃঙ্খলা যেন অনেকটা সেই খৃষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের বাংলার মাৎস্যন্যায়ের পুনরাবৃত্তি। এই সর্বব্যাপী অবক্ষয়, দুর্নীতি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ-লুটপাটের মূল আঁতুর ঘর হচ্ছে দেশের বিপথগামী শিক্ষাব্যবস্থা। বিগত শতকের তিরিশের দশকে ভারত শাসন আইনের মধ্য দিয়ে দেশে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল সে ধারায় ঔপনিবেশিক শাসকদের ছত্রছায়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর প্রাধান্য বিস্তারকারী ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা প্রমাদ গুনতে শুরু করে এবং ভারত ভাগের পাশাপাশি বাংলা ভাগের রাজনৈতিক ফমূর্লা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে ওঠে। সে ইতিহাস এখানে আলোচ্য নয়। তবে এ পাকিস্তানের সাথে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত অনিবার্য অনুঘটকের ভূমিকা পালন করলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এ দেশের মানুষের সার্বজনীন আকাঙ্খা বাস্তবায়নে ভারত শুধু নিস্পৃহই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে তারা প্রধান অন্তরায় ও প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বিশ্বরাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভারতকে পশ্চিমাদের সাথে কিছুটা সমঝোতার পথ গ্রহণ করে অনেকটা নিরবতা অবলম্বন করতে দেখা গেলেও ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা এখনো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে দেশে এবং পশ্চিমাদের তোপের মুখে থাকা কর্তৃত্ববাদী রিজিমকেই সমর্থন করছে। জননিরাপত্তা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের অনুঘটকের ভূমিকা পালনকারী প্রতিবেশী দেশ ভারতের আজকের অবস্থান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে দেশভাগ কিংবা স্বাধীনতার রূপরেখা নিয়ে রাজনৈতিক মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। সাতচল্লিশ এবং একাত্তুরে তার প্রতিফলন দেখা গেছে। তবে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ দেশের অন্তত ৯৫ ভাগ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আজকের বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে দেশকে স্পষ্টত বিভাজিত করা হচ্ছে। আমাদের সংবিধান জনগণকে দেশের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পণ করেছে। সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে শতকরা অন্তত ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন ও প্রত্যাশাকে অগ্রাহ্য করে তৃতীয়বারের মত একতরফা নির্বাচনের পাঁয়তারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাননবাধিকার হরণের অভিযোগে দেশের এলিট ফোর্সের উপর নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনিক আমলা, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট, সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার বার্তা প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত গত একযুগ ধরে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। আর দেশের মাৎস্যন্যায় ও রাজনীতির এই ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রথম উত্থান ঘটে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস থেকে। অথচ একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের সহাবস্থান ও আদান প্রদানের মধ্য দিয়েই তার বিকাশ লাভ করে। ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে মতামতের প্রতিফলন ঘটায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামাজিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঔৎকর্ষের মেলবন্ধনের সুতিকাগার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও গবেষণাগারগুলো। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে পরিকল্পিতভাবে অস্থির করে তোলা, ছাত্র সংগঠনগুলোর হানাহানি, অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং রক্তাক্ত করে তোলার শেষ ধাপে এসে গত দেড় দশক ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো একটি ছাত্র সংগঠনের সমর্থক ছাড়া বাকি সব দল ও মতের জন্য কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এ সময়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায়, পেশিশক্তি ও প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের কর্মকান্ড রহিত করা হলেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাস- নৃশংসতার বলি হয় কয়েক ডজন শিক্ষার্থী।
গত পঞ্চাশ বছরে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও উচ্চশিক্ষায় তার ছাপ খুবই কম। নব্বই দশকের শুরুতে দেশে শতাধিক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রথম সারির কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলে বেশিরভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় মূলত সার্টিফিকেট বাণিজ্যের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সীমিত পরিসরের ক্যাম্পাসে নেই পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা, একাডেমিক ও এক্স্ট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজের পাশাপাশি শিক্ষা গবেষণায় দৈন্যদশা খুবই স্পষ্ট। শত শত একর জমির উপর গড়ে ওঠা একেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাসহ আনুসাঙ্গিক খরচ মেটাতে জনগণের রাজস্ব থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি ব্যয় হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যয় নির্বাহে সরকারের দায়বদ্ধতার সাথে উচ্চশিক্ষার দায়বদ্ধতা একই রকম নয়। দেশের জন্য উচ্চশিক্ষিত নাগরিক, পেশাজীবী, সুদক্ষ আমলা, কূটনীতিক, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বিজ্ঞানী সর্বোপরি উন্নত চিন্তার সুনাগরিক গড়ে তোলাই যে কোনো দেশের উচ্চশিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য। দেশের ভূমি, উর্বর মাটি, পানি, বায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি যে কোনো দেশের মূল সম্পদ। আর এসব সম্পদকে যথাযথভাবে ও সর্বোচ্চ মানদন্ডে কাজে লাগাতে প্রয়োজন দক্ষ ও সৃজনশীল মানব সম্পদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের ও বিশ্বের প্রয়োজনে দক্ষ, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী প্রতিভাসম্পন্ন মানব সম্পদের বিকাশ নিশ্চিত করে। এজন্যই বলা হয়, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দেশের উচ্চ শিক্ষাকে টার্গেট করে ধ্বংস করা হয়েছে। পর পর তিনবার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের গত দেড় দশকে দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গণে শিক্ষার সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশকেই শুধু ধ্বংস করা হয়নি। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে, কিংবা মুক্ত মানুষ হিসেবে একজন শিক্ষার্থীর বেঁচে থাকা ও ভবিষ্যতের জন্য গড়ে ওঠার স্বাভাবিক পরিবেশ ও নিরাপত্তাকে চরমভাবে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে একটি স্টাটাস দেয়ার কারণে বুয়েটের মেধাবি শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শরিফুজ্জামান নোমানী থেকে ২০১৯ সালে বুয়েটে আবরার ফাহাদ পর্যন্ত ছাত্রলীগের হাতে এক দশকে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্তত ৩৩ মেধাবি শিক্ষার্থী নির্মমভাবে নিহত হওয়ার প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, নারী ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের অনুপস্থিতির সুযোগ ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিশেষ স্থান এবং বিভিন্ন হল এখন মাদকের রমরমা হাটে পরিনত হয়েছে। বিরোধীদল দমন করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নস্যাত করতে গত দেড় দশক ধরে ছাত্রলীগ ও পুলিশ একে অপরের পরিপুরক ভূমিকা রেখে চলেছে। ক্যাম্পাসে মাদকের কারবারে ছাত্রলীগের সাথে পুলিশের যোগসাজশের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। এরপরও মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কক্ষ থেকে শত শত পিস ইয়াবাসহ নানা ধরণের মাদক উদ্ধারের ঘটনা বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক গোয়েন্দা রিপোর্টে ১৪ ছাত্রলীগ নেতার সরাসরি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছিল। প্রকৃত চিত্র খুঁজতে গেলে এ সংখ্যা শতগুণ বেশি হতে পারে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক অডিও ক্লিপে পুলিশের এক ওসি আটক হওয়া এক মাদক ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে ৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে নিজেই মাদক ব্যবসা শুরুর পরামর্শ দিতে শোনা গেছে। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার হলের এক ছাত্রলীগ নেতার কক্ষ থেকে সতেজ-সুউচ্চ এক গাজার গাছ উদ্ধার করেছে পুলিশ। করোনাকালে ঢাবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের বাইরে গাঁজার গাছ বিশাল আকারে বেড়ে ওঠার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। গাঁজার চাষ যেখানেই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যাপকহারে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। শুধু কি শিক্ষার্থীরা? দশ টাকায় চা, সিঙ্গারা, চপ ও সমুচা বিক্রি করে গিনেস বুকে নাম লেখানোর দাবির মতো দেশের আওয়ামী শিক্ষাবিদরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাঁজা উৎপাদনের জন্য নতুন কোনো এওয়ার্ড দাবি করতেই পারেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির এক মানব বন্ধনে বক্তব্য দিতে গিয়ে ঢাবির একজন অধ্যাপক নির্বাচন ছাড়াই সরকারের মেয়াদ আরো ৫ বছর বাড়িয়ে নেয়ার দাবি করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কমেন্টে একজন প্রশ্ন রেখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও কি মাদকে অভ্যস্ত ও আসক্ত হয়ে পড়েছেন? বিষয়টা অনুসন্ধান ও তদন্তের দাবি রাখে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অপরাধ ও মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে না পারলে এ জাতি কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। রাষ্ট্রে ও সমাজে বিদ্যমান মাৎস্যন্যায় রুখে দিয়ে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা- শিক্ষাঙ্গণকে শিক্ষাবান্ধব ও নিরাপদ করে তুলতে হবে।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা