পুলিশে দক্ষ ও পেশাদারদের পদোন্নতি দিতে হবে
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২২ পিএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
পুলিশের মধ্যে একশ্রেণীর অতিউৎসাহী, দলবাজ ও অদক্ষ সদস্যর জন্য দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরো বাহিনীর বদনাম হয়েছে এবং হচ্ছে। এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে পুলিশ বাহিনীর ওপর নানা অভিযোগ উঠেছে। খুন, গুম, নিপীড়ন, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মানুষকে তুলে নেয়া, সাধারণ মানুষকে হয়রানি, মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়াসহ হেন কোনো অপরাধ নেই যাতে এই শ্রেণীর পুলিশ জড়ায়নি। এই অতিউৎসাহী পুলিশের জন্য দেশকে ‘পুলিশি রাষ্ট্র’-এর বদনাম নিতে হয়েছে। এখনও এই শ্রেণীটির অপকর্ম থেমে নেই। দলবাজ হওয়ায় তারা যা ইচ্ছা তা করে যাচ্ছে। বিধিবদ্ধ নিয়মের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদলের কর্মীর মতো আচরণ করছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন পুলিশের অপকর্মের কারণে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। সর্বশেষ এডিসি হারুন ও সানজিদা কা- নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এতে পুরো পুলিশ বাহিনী বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়। শুধু এ ধরনের অপকর্মই নয়, কতিপয় দলবাজ পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের হয়ে রাজনৈতিক প্রচারণার কাজে নেমে পড়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ হয়ে ভোট চাইতে দেখা গেছে, যা পুলিশের কর্মবিধির মধ্যে পড়ে না। তারা মানুষের সেবার চেয়ে দলীয় সেবাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এসব দলবাজ পুলিশের অপকর্ম ও বিধিবর্হিভূত কর্মকা-ের জন্য শুধু ক্ষমতাসীন দলেরই বদনাম হচ্ছে না, আন্তর্জাতিকভাবেও দেশের বদনাম হচ্ছে।
বিগত একদশকে পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর অপকর্মের কারণে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরো বাহিনীকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে এবং হচ্ছে। সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদার পুলিশ সদস্যদের বদনামের ভাগিদার হতে হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, অদক্ষ, অসৎ ও অযোগ্যদের পদোন্নতি দেয়ার কারণে, সৎ ও দক্ষ সদস্যরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তারা বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে পুলিশকে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এক শ্রেণীর দলবাজ পুলিশও এ সুযোগ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। তাদের মতে, একদশক ধরে অতিউৎসাহী ও দলবাজ পুলিশ বিরোধীদলের আন্দোলন দমানো এবং নেতাকর্মীদের কঠোর হস্তে দমন, পীড়ন, নির্যাতন, গুম করে দেশে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে এমনও বলতে শোনা গেছে, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। এছাড়া, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছে, এ সরকারকে ক্ষমতায় আনতে এবং টিকিয়ে রাখতে পুলিশ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ নিয়ে পুলিশের অনেক সদস্যর মধ্যে অহম ও দম্ভ প্রকাশিত হয়েছে। কখনো কখনো তাদের কাছে এমপিরাও অসহায় পড়েছে। কোনো কোনো থানার ওসি এমপি’র কথা শোনে না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। একশ্রেণীর পুলিশের এমন বক্তব্য, আচরণ ও মানসিকতা প্রশ্রয়ও পাচ্ছে। অধিক সমালোচনার মুখে বিতর্কিত পুলিশকে সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে দায় সারা হয়েছে। এটা কোনো সমাধান নয়, বরং দলবাজ ও অদক্ষ পুলিশকে প্রশ্রয় দেয়ার শামিল। আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রায় সাড়ে তিন মাসের মতো বাকি। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে, কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলীয় নেতাদের মতো জনপ্রতিনিধিদের সামনে সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে এবং ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ ধরনের দলীয় বক্তব্য কোনো সরকারি কর্মকর্তা দিতে পারে না। এটা চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ এদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। দলবাজ পুলিশের দ্বারা আর যাই হোক, দেশের সুশাসন ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই শ্রেণীর পুলিশের আচরণ ও কথাবার্তা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, বিরোধীদল যে আন্দোলন করছে, তা কঠোরভাবে দমনে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এদিকে, পদোন্নতি নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে হাতাশা ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, গত সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাথে ঢাকার সব থানা এবং রাজধানীর আশপাশের জেলার বেশ কয়েকটি থানার ওসি দেখা করে পদোন্নতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। শুধু ওসি নয়, সাব ইন্সপেক্টর থেকে শুরু করে কনস্টেবলদেরও পদোন্নতির দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে, মাস তিনেক আগে অতিরিক্ত আইজিপি থেকে পুলিশ সুপার পর্যায়ে ৭২০ জন কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৩৪২টি পদ পদোন্নতির জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত তালিকার অর্ধেকের বেশি পদ অনুমোদন না পাওয়ায় পুলিশের ভেতরে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে। এতে তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে পারস্পরিক ‘ব্লেম গেম’ সৃষ্টি হয়েছে। এই অসন্তোষ অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া এক ধরনের অপসংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা পদোন্নতি পাবেন, তারা ক্ষমতাসীনদলকে টিকিয়ে রাখতে এবং বিরোধীদলের আন্দোলন দমনে যে কঠোর হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এটাও বলা আবশ্যক, দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়া হলে সৎ, দক্ষ, যোগ্য এ পেশাদাররা বঞ্চিত হয়। বলা বাহুল্য, অদক্ষ্য, অযোগ্য ও দলবাজরা যখন পদোন্নতি পায়, তখন তাদের প্রভাব ও প্রতাপে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনীতি নীপিড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়। যোগ্যরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে। চেইন অফ কমান্ড বা শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুলিশের ভাবমর্যাদা নিয়ে যে প্রশ্ন ও নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তা আরও গভীর হবে, যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
গুম, খুন, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভিন্নমতের লোকজনকে তুলে নেয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্বর আচরণের কারণে দেশে-বিদেশে পুলিশের দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল বেশি তোলা হয়। এ ধরাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট র্যাব ও পুলিশের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এদিকে, বেশ কিছুদিন থেকে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা পর্যালোচনা করছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। জাতিসংঘ সর্বশেষ জানিয়েছে, এখনো বাংলাদেশে ৭০টি গুমের ঘটনার নি®পত্তি হয়নি। সংস্থাটি থেকে মোট ৮৮টি গুমের বিষয়ে সরকারের কাছে প্রকৃত অবস্থা জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৫ জন আটক এবং ১০ জন মুক্ত অবস্থায় আছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়। বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্স অর ইনভলেন্টারি ডিসাপিয়ারেন্স সর্বশেষ এ তথ্য দিয়েছে এবং এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। বর্তমানে গুম নিয়ে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৪তম অধিবেশন চলছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ অধিবেশন ৬ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে। এতে গুম নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এসব ঘটনার বেশিরভাগের সাথে যে একশ্রেণীর পুলিশ জড়িত, তা ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে প্রকাশিত হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং গুমের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গণের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অনবরত কথা বলছে এবং সরকারের কাছ থেকে জবাব চাচ্ছে। এটা দেশের বদনাম এবং আইনের শাসনের অবনমন ছাড়া কিছু নয়। আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে, তা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অদক্ষতা ও পেশাদারিত্বের ঘাটতি থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সম্মানহানি হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশের পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্বপালন অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে দলবাজ, অদক্ষ ও অযোগ্যদের যদি পদোন্নতি দেয়া হয় এবং তারা যখন দায়িত্ব পালন করবে, তখন পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। সরকারকে এক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। পুলিশের পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদারদের পদোন্নতি দিতে হবে। তাহলে, দেশের স্থিতিশীলতা যেমন বজায় থাকবে, তেমনি পুলিশের ভাবমর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা