মুদ্রাস্ফীতির কষ্ট লাঘব করতে হবে
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৩৯ পিএম | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, রান্নার গ্যাস, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে সত্যিই অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নি¤œআয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষায় ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না।
অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কারণ, মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় এবং জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির অস্থিরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজ, আলু, ডিমের মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মাসিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০২ শতাংশ, যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় উল্লিখিত ৫.৬ শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমিত ৭.৫ শতাংশ উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৩-এর জন্য মুদ্রানীতির বিবৃতি মতে, ২০২২ অর্থবছরে গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.১৫ শতাংশ। উদ্বেগজনকভাবে সর্বশেষ বিবিএস এর তথ্য বলছে, আগস্ট ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৪ শতাংশের মতো উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে খাদ্যে ২০১১ সালের অক্টোবরে ১২.৮২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে, সেখানে এর পরিমাণ ১২.৭১ শতাংশ, যা গত জুলাইয়ে ছিল ৯.৮২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪০ শতাংশ। এমন এক সময়ে এই মূল্যস্ফীতি যখন আশেপাশের দেশ ভারত-পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে এটি কমে আসছে।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা চরম মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে গিয়েছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৭৩.৭ শতাংশ রেকর্ড করা হয়। আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। তখন দেশটি লাগামহীন লোডশেডিং দেখেছে এবং গাড়িতে জ্বালানি নিতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কার ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ৪.৬ শতাংশে নেমেছে। দেশটির পরিসংখ্যান বিভাগ বলছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দেশটির খাদ্যপণ্যের দাম বহুলাংশে কমেছে। ন্যাশনাল কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্সে বিস্তৃত পরিসরে খুচরা মূল্যস্ফীতি তুলে ধরা হয় এবং প্রতি মাসে ২১ দিনের ব্যবধানে এই সূচক প্রকাশ করা হয়। জুন মাসে শ্রীলঙ্কার ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৮ শতাংশ এবং জুলাইয়ে তা কমে হয়েছে ৪.৬ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান বিভাগ বলছে, জুনে খাদ্য মুল্যস্ফীতি ২.৫ শতাংশ বেড়েছিল এবং জুলাইয়ে তা ২.৫ শতাংশ কমেছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যগুলোর দাম জুলাই মাসে ১০.৯ শতাংশ বেড়েছে এবং আগের মাসে এটি ১৮.৩ শতাংশ বেড়েছিল। জুন থেকে শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি আগের মাসগুলোর তুলনায় দ্রুত কমতে শুরু করেছে। এর পাশাপাশি দেশটির মুদ্রা রুপিও শক্তিশালী হয়েছে। এর ফলে দেশটির জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং আমদানিকৃত খাদ্যের ব্যয় কমেছে।
আমাদের দেশে আয় আটকে আছে অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাগাতার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ একটাই, তা হচ্ছে, বাজারের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই বাজার মনিটরিং, তদারকি এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সব থেকে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়ে নি¤œবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নি¤œআয়ের প্রান্তিক মানুষ। অধিকাংশ প্রবীণ সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরিজীবন কাটিয়েছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। কারণ, চাকরি জীবনের তাদের সঞ্চয় পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকাই একমাত্র সম্বল। জীবনের শেষ সম্বল এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র কিনেছে। এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে তাদের সংসার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করতে হয়। যেন নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা কিংবা মরার উপর খরার ঘা!
আসলে সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে একদম নির্বিকার। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সুফল দিচ্ছে না।
বর্তমানে চাল, তেল, পেঁয়াজ, শাকসবজি ইত্যাদির দাম বেড়েই চলছে। প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা এক একটি অজুহাত দাঁড় করায় এবং সরকারও তাদের সাথে সুর মেলায়। অথচ কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া, অতিরিক্ত টাকা দিলে এমন কোনো পণ্য নেই, যা পাওয়া যায় না অর্থাৎ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত। আর এর মাশুল গুনছে সাধারণ মানুষ। নিত্যদিন তাদের পকেট কাটছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই, ভোক্তারা নির্বিকার ও চরম অসহায়।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন খরচ, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে সে হারে মানুষের আয় বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কীভাবে দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া, অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ন্যায়সংগত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা সংকটকে প্রকট করছে। পুরো অর্থনীতিতে এখনো ডলার সংকটের মারাত্মক প্রভাব। এর ফলে সরকারের লেনদেনে দেখা দিয়েছে রেকর্ড ঘাটতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ পরিশোধের খরচ বেড়েছে, দেখা দিয়েছে জ্বালানিসংকট, অসহনীয় হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতির চাপ। গোটা অর্থনীতিতে টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বহু বছর ধরে রেখেছিল। ফলে যে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দিয়েছে, তাও হুমকির মুখে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তা না করে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নীতিতেই আগ্রহ বেশি সরকারের। এতে সংকট আরও বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। মজুতদারি রোধ করতে পারলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি জমি থেকে সর্বোত্তম ফসল লাভের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, প্রচুর সার ও সেচ ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়লে দাম এমনিতেই স্থিতিশীল থাকবে। বাজারের উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের সকল মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামস্টি
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা