দখল ও ভোগ লক্ষণসীমা অতিক্রম করেছে
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৩৬ পিএম | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
দূর অতীতের মানব ইতিহাস, মধ্যযুগের রাজ-রাজড়ারইতিহাস এবং বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা কী দেখতে পাই? দেখতে পাচ্ছি শুধু দখল আর লড়াই। ইতিহাসে এ লড়াইয়ে কোনো পার্থক্য নজরে পড়ে না। সর্বত্র একই ছবিÑ দখল করো, ভোগ করো। সুদূর অতীতে গুহাবাসীদের জীবনেও ছিল সীমানা বা অঞ্চল দখলের জীবন-মরণ লড়াই। পরবর্তীকালে বা মধ্যযুগে ছিল সম্রাট-শাহানশাহ-রাজা-মহারাজাদের ওই সীমানা বা রাজ্য দখলের লড়াই। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। বর্তমান গণতন্ত্রের যুগেও অতীতের সেই একই দখল নদীর বেগবান খরস্রোতধারা উত্তাল তরঙ্গে বহমান।
মধ্যযুগের সমাজ জীবনের রাজনৈতিক ইতিহাসের ছবিগুলো যখন চোখে পড়ে, সে এক লোমহর্ষক ব্যাপার, বীভৎস কাহিনী যা লিখতে হাত অবশ হয়ে পড়ে। যেখানে লক্ষ করি, কত অন্যায়-অত্যাচার, কত অবিচার-অত্যাচার, কত অমানবিকতা-পাশবিকতা, কত খুন-জখম, কত নৃশংসতা, কত নির্মমতা, কত নিষ্ঠুরতা। লক্ষ করি, নর অপেক্ষা নারীই বেশি লাঞ্ছিতা, নির্যাতিতা। মানুষের মধ্যে মানব-হৃদয় বলে কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।
মধ্যযুগে লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল রাজ্য দখল, দেশ দখল, সম্পদ দখল, তারপর নর-নারী দখল। তাদের দাস-দাসী রূপে ব্যবহার করা হতো। তাদের দুর্ভোগের কোনো সীমা থাকত না। তারা খোয়াড়ে গাদাগাদি করে থাকত। তারা মানুষ হলেও তাদের প্রতি অন্যান্য জীবের মতোই আচরণ করা হতো। জীবদেরও কিছু রেহাই ছিল। কিন্তু দাসীদের সামান্য রেহাইও মিলত না।
এ তো গেল দাস-দাসীদের কথা। রানী বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদেরও নিস্তার ছিল না। পরাজিত রাজা-উজির, সেনাপতি, আমির-উমরাগণের পরমা সুন্দরী স্ত্রী ও কন্যাদের দুর্দশাও একেবারে কম ছিল না। দখলদাররা তাঁদের নিয়ে কী যে লোমহর্ষক ব্যবহার করতেন, তা কেবল অনুমান করাই শ্রেয়। দেখা যায়, একই মাসে ওই সমস্ত রাজ পরিবারের রমণীদের তিন থেকে পাঁচ বার মালিক পরিবর্তন হতো, যেহেতু তাঁরা দখলদারের দখলীকৃত সম্পদ। মানবতার অপমৃত্যু ও অপমান এর থেকে বেশি আর কী হতে পারে! এখানে একটিই লক্ষ্য সকলের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে দেখা যেত, কেবল ‘দখলদারি’। কে কতটা দখল করেছে করছে ও করবেÑ এটাই ছিল মূল কথা। অতীত-মধ্য ও বর্তমান যুগেও সেই একই প্রথা বহমান।
পশু-পাখি, জীব-জন্তুর জীবনেও লক্ষ করা যায়, সেই একই দখলের লড়াই। কেউ কাউকে আপন এলাকা বা অঞ্চল ছাড়তে রাজি নয়। আবার আপন আপন অঞ্চলেও চলে দখলের পর ভোগের লড়াই। কে কাকে ভোগ করবে। দিবারাত্রি অহরহ এ লড়াই চলছেই। জঙ্গলের এটাই একমাত্র ধর্ম। যেহেতু তারা পশু ও জানোয়ার, তাদের কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নেই, তাদের বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান-গরিমা, চিন্তা-চেতনা নেই। তাই ওই দখলিপনায় তারা অপরাধী হয়েও নিরপরাধ আর বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ মানুষের কথাÑ সে তো অমৃত সমান।
মানুষ নানা কারণে পরাধীন হতে পারে। কিন্তু বিনা কারণে প্রতিটি ‘মানুষের মন’টি স্বাধীন। এ কথা, মহামানব-মহাপুরুষগণ বলে গেছেন। ওখানে কেউই লাগাম পরাতে পারে না। রাজা-বাদশাহকেও একজন দীনাতিদীন চাকর ঘৃণার চোখে দেখতেই পারে। তাই মানুষের অবোধ মনে প্রশ্ন জাগে, বনের পশু ও জানোয়ার ‘দখলে ও ভোগে’ মেতে আছে ঠিকই। কিন্তু সভ্য-শিক্ষিত-সুশিক্ষিত সচেতন সমাজ এবং জ্ঞান-গরিমার দাবিদার মানুষ কি ওই দখল ও ভোগের লড়াইয়ে এতটুকুও কম মেতে আছে? তাই যদি না হবে, তাহলে দেশের নব্বই শতাংশ সম্পদ মাত্র দশ শতাংশ মানুষ ভোগ করে কীভাবে। দেশের কিছু মানুষ মাসে পঞ্চাশ হাজার থেকে দু’লক্ষ টাকা মাইনে পাচ্ছে। যেখানে অগণিত হতভাগা মানুষ মাসে মাত্র তিন থেকে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা মাইনে পায়। এও কি দখল ও ভোগের চিত্র নয়? সব কিছুরই একটা সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। আজ দেশে দখল ও ভোগ লক্ষণসীমা অতিক্রম করেছে। জনরোষও আজ জাগ্রত। সচেতন মানুষ আজ প্রতিবিধান এবং প্রতিকার চায়।
একবার এই হতভাগা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন। কী সকরুণ দৃশ্য! এই পৃথিবীর কত দুর্বল দেশ সবল দখলকারীর যাঁতাকলে পড়ে অসহায় জীবজন্তুর ন্যায় আকাশ-ভাঙা আর্তনাদ করছে। তাদের যুগ-যুগান্তের শতাব্দীব্যাপী আর্তনাদ কি ওই সমস্ত দখলকারী দানবের কানে পৌঁছায় না? মানুষের মন যেমন মন্দপ্রবণ, তেমনি প্রশ্নপ্রবণও। মনে প্রশ্ন জাগে, একই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ, নিরীহ হরিণ-জেব্রা ও বোকা বাইসন কেন? আবার একই পৃথিবীতে শক্তিমত্ত আমেরিকা-অবলুপ্ত প্রায় পানামা, বিধ্বস্ত ইরাক ও আড়ষ্ট ইরান, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান এবং হতদরিদ্র দেশগুলো কেন? সারা পৃথিবীতে এরূপ উপমার অভাব নেই। এ যেন কেবল ‘দখল ও ভোগের’ পরিশুদ্ধ উন্নতমানের সীমাহীন হৃদয়হীন সর্বগ্রাসী সংগ্রাম। এটাই কি মানব সভ্যতার আধুনিক রূপ?
আমাদের দেশ স্বাধীন হলো। বেনিয়ার জাত ইংরেজ আমাদের দেশকে প্রায় দুশো বছর ভোগ-দখলে রেখে মনের সুখে শাসন করল। তাদের সেই দখলদারি ছাড়াতে দেশের মানুষের কালঘাম ছুটে গেল। অগণিত প্রাণ অকালে ঝরে পড়ল। কত সহস্র সন্তান পিতৃহারা হলো। কত নিষ্পাপ রমনী বিধবা হলো। কত মাতা ও পিতা সন্তানহারা হলো। কত শিশু অনাথ হলো। কাদের পাপে তারা প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করল, সে বিচার এক মহাবিচারক ছাড়া আর কেই বা করবেন। দেশবাসীই দেশকে একদিন পরাধীন করেছিল নইলে গুটিকতক ইংরেজদের কিছু করার ছিল না।
দেশ স্বাধীন হলো। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠল। এবার আবার সেই পুরনো মদ নতুন বোতলে এসে গেল। দখল ও ভোগের সংগ্রাম। কোন দল দেশের কতটা দখল করবে? কোন দল দেশের কত মানুষ দখলে রাখবে? এসবই যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্যব্রত হয়ে উঠল। এ জন্য আজও স্বাধীন দেশের কত নিরীহ-নিরপরাধ প্রাণ লুটিয়ে পড়ছে। দেশের শ্রীবৃদ্ধিও নেই, দশের উন্নতিও নেই। কেবল আছে ‘দখল ও ভোগের’ কুৎসিত কামনা, লোলুপ বাসনা মাত্র। এ পরিবর্তন শুধু পালা বদলের পালা মাত্র। দলগুলো একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এই পরিবর্তন দেশেরও নয়, সমাজের নয়। দেশের জনসাধারণ সার্বিকভাবে সজাগ না হওয়া পর্যন্ত এ ধারা চলতেই থাকবে। প্রতিটি দল এখন আপন আপন দলেও পোক্ত লেঠেল ও একান্ত অনুগত ‘দলদাস’ বানাতে ও বাড়াতে ভীষণ ব্যস্ত। জনগণ ঘুরে না দাঁড়ালে বার বার নির্বাচন হবে আর প্রমাণ হবে দেশটি গণতন্ত্রের অযোগ্য। যে সংগ্রামে ভালো কাজের জন্য আকাক্সক্ষা নেই, হৃদয়ের কোনো আকুতি নেই, মনের আকুলি-বিকুলি নেই তা পশুদের সংগ্রাম থেকেও কতই না নিকৃষ্ট। যে সংগ্রাম কেবল ‘দখল ও ভোগে’র জন্য নির্বিচারে মানুষ খুন করতে ওস্তাদ, দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি যার এতটুকুও সহমর্মিতা বা সমবেদনা নেই, তা দূর অতীতে দানবের লড়াই ও পশুর সংগ্রাম ছাড়া আর কী? মানুষ তার দুঃসময় পারিবারিক জীবনে দু’মুঠো অন্ন ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছে, সেই মানুষটিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে দিবালোকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা, এ কোন হিংস্রতা? এরই নাম কী দেশসেবা, দেশ গঠন? তা হলে গভীর জঙ্গলে জানোয়ারের কাজটি কী? মানুষে আর জানোয়ারে তফাৎটা কোথায়? মা ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে রাস্তায় ছেলে বা মেয়ের সামনে মাকে খুন করা বা ছেলে বা মেয়েকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া, ছেলে বা মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ করা, মার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা, এটা কি ধরনের হিং¯্রতা? এটাই কি সুস্থ সমাজের নিদর্শন?
বিধির নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটু ফিরে তাকালে স্বস্তি জাগে। কই, কোথায় গেল বিশ্বের তাবড়-তাবড় গগনস্পর্শী বিশাল সাম্রাজ্যগুলো। কে তাদের যথাসময়ে আস্তাচলে নিয়ন্ত্রিত করলেন? যারা ভেবেছিল তাদের উদয় আছে অস্ত নেই, পৃথিবীতে তাদের প্রাসাদ অট্টালিকা-দুর্গগুলো চিরস্থায়ী। কে তাদের চিরবিদায় দিয়ে আজকের এই ভোগ দখলের ‘দলতন্ত্র’বাগীশদের আমন্ত্রণ জানালেন। আবার সময়ে বিদায়ও ধরিয়ে দেবেন।
আমরা জানি, পৃথিবীর প্রাণ মানব জাতি। আবার মানব জাতির প্রাণ তাদের মনুষ্যত্ব-মানবতা। মানুষের এই মনুষ্যত্বের ও মানবতার প্রকাশ ঘটে তার দৈনন্দিন আচরণে, সকল সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব পালনে, সকল মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ভালোবাসায়।
মানুষের প্রথম পরিচয় হোক, সে একজন মানুষ। সে পরিচয় জাতি-ধর্মে-বর্ণে নয়, শিক্ষা ও দীক্ষাতে নয়, টাকা-পয়সা পদ ও পদবিতে নয়, বংশ গোত্র ও সমাজে নয়, কাল ও যুগে নয়, মানুষের পরিচয় হোক কেবল মানুষ বলেই। মানুষের জন্য মানুষের অকপট ভালোবাসা, সহমর্মিতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা, দয়া-মায়া-ক্ষমা প্রভৃতি থাক, যেগুলো মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ ভূষণ। এই সহমর্মিতাই পৃথিবীর প্রাণ। মানুষের প্রতি মানুষের লক্ষ্য হোক বিচ্ছেদ নয়, মিলন; বিষাদ নয়, বন্ধন; সংঘর্ষ নয়, সংহতি; ধ্বংস নয়, প্রগতি; হিংসা নয়, ভালোবাসা; হত্যা নয়, রক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের