ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০ পৌষ ১৪৩১

পানিবদ্ধতার দায় আমরা এড়াবো কী করে?

Daily Inqilab সৈয়দ ইবনে রহমত

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:১৭ পিএম | আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম

নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দিনগত রাত সাড়ে ৩টায় তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘১০টায় পান্থপথ থেকে রওনা দিয়ে, ৩টা ৩০ মিনিটে মিরপুর কমার্স কলেজ’। অর্থাৎ ঢাকার পান্থপথ থেকে রাত ১০টায় রওনা দিয়ে মিরপুর কমার্স কলেজ এলাকায় পৌঁছাতে সময় লেগেছে সাড়ে ৫ ঘণ্টা! গুগল ম্যাপে পান্থপথ থেকে রোকেয়া সরণী হয়ে মিরপুর কমার্স কলেজের দূরত্ব দেখায় ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার। প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার, ব্যক্তিভেদে যা কিছু কম বা বেশি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন মানুষ ওই দূরত্ব হেঁটে গেলে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম ব্যক্তিগত পরিবহনে সেই একই দূরত্ব অতিক্রম করেছেন ঘণ্টায় ২ কিলোমিটারেরও কম গতিতে! কারণ, রাস্তায় শুধু পানি আর পানি। উপরে বৃষ্টি আর রাস্তায় জমে থাকা হাঁটু বা তার চেয়ে বেশি পানি অতিক্রম করে কোনো যানবাহনই এগুতে পারছিল না। ছোট ছোট বাহন তথা সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কারের মতো অনেক যানবাহন পানির কারণে ইঞ্জিনই চালু রাখতে পারছিল না। যেখানে সেখানে এসব গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়ে ভয়াবহ জানযটের সৃষ্টি করে পুরো রাস্তায়।

কখনো হালকা, কখনো ভারি বৃষ্টি হচ্ছে ঢাকাসহ সারাদেশে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি ঝরেছে ঢাকায়। এতে বিভিন্ন এলাকার রাস্তা তলিয়ে যায়। পানি বেড়ে যাওয়ায় কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে ভোগান্তিতে পড়ে সারাদিনের কর্ম শেষে সন্ধ্যায় ঘরমুখী লোকজন। পানিময় সড়কে আটকা পড়ে দীর্ঘক্ষণ কাটাতে হয় অনেককে। বিশেষ করে রোকেয়া সরণী, ধানমন্ডি-৫ নম্বর সড়ক, সাতমসজিদ সড়ক, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল, বিজয় সরণি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তা, আজিমপুর, মতিঝিল থেকে দৈনিক বাংলা এলাকাসহ পুরো ঢাকার যেন একই চিত্র হয়ে উঠে। চারদিকে পানি আর পানি, তার মাঝেই সারি সারি ছোট-বড় যানবাহন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো গাড়িরই সামনে যাওয়ার উপায় নেই। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াসহ আশেপাশের এলাকার অবস্থা তো আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। রাস্তা-ফুটপাত ছাড়িয়ে পানি উঠে যায় দোকানপাটে, পানি ওঠার কারণে এসব এলাকার বিভিন্ন ভবনের নিচতলায় বসবাসকারীদের ঘুম হারাম হয়ে যায়।

রাজধানীর মেয়র দুজন। একজন উত্তরের, অন্যজন দক্ষিণের। দৃশ্যত ঢাকার এই পানিবদ্ধতার দায় সবার আগে তাদের উপরেই পড়ে। বিষয়টা তারাও বোঝেন না, তা নয়। বরং ভালো করেই তারা এটা জানেন। সে কারণেই প্রতি বছরই তারা নগরের পানিবদ্ধতা কমানোর জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেসব উদ্যোগের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে গত ১৪ জুন বংশাল এলাকার একটি খেলার মাঠ উদ্বোধনের সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দাবি করেছিলেন, ‘সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার জলাবদ্ধতা ৭০ থেকে ১০ ভাগে নেমে এসেছে। ২০২০ সালেও একটু বৃষ্টি হলে শহর প্লাবিত হয়ে যেত। মনে হতো বন্যা হয়ে গেছে। সেখান থেকে আমরা পানিবদ্ধতা ১০ ভাগে নিয়ে এসেছি।’ এর পর ২৯ জুন বৃষ্টিমুখর কোরবানি ঈদের দিন জাতীয় ঈদগাহে উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম একই সুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজধানীতে দুইদিন ধরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, সে তুলনায় সড়কে এবার পানি জমেনি। কিছু কিছু জায়গায় জলজট হলেও পানি দ্রুত সরে যাচ্ছে। আগে বৃষ্টি হলে বিভিন্ন জায়গায় আটকে যেতে হতো। এবার উত্তরার বাসা থেকে বৃষ্টির মধ্যেও জাতীয় ঈদগাহে আসতে পেরেছি।’

বাস্তবতা হলো, ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে পুরো শহর অচল হয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানিতে উপচেপড়া ড্রেনের ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে মিশে তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। নালা-নর্দমার পচাপানিতে ডুবে যায় গোটা শহর। সেকারণেই পানিবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নেওয়া নানা উদ্যোগ ও তৎপরতার সমালোচনা করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সত্যিকার অর্থে এই সমস্যার সমাধানে দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনাই নেই। পরিকল্পনা ছাড়াই বিচ্ছিন্নভাবে তারা বিভিন্ন সময় যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন, তাতে জনসম্পৃক্ততার কোনো জায়গা ছিল না। যদিও মাঝেমধ্যে একটি-দুটি খাল কিংবা নালার আবর্জনা পরিষ্কার করে বারবার নগরবাসীকে সমস্যা সমাধানে আশ্বস্ত করেছেন মেয়ররা, কিন্তু বাস্তবে সমাধান হয়নি। বিভিন্ন সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে দুই সিটি করপোরেশন খাল পরিষ্কার কিংবা দখলমুক্ত করার যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন, তার কার্যকারিতা দেখা যায় না। বিশেষ করে রামচন্দ্রপুর খালের অবস্থা খুবই করুণ। একইভাবে কল্যাণপুর খাল, পুরান ঢাকার আটটি খালের সংযোগস্থলের সব জায়গাতেই থকথকে আবর্জনা। যদি নগরীর খাল ও ড্রেনের সঙ্গে নদীর সংযোগ সরাসরি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে পানিবদ্ধতা হবেই। বৃহস্পতিবার সেটাই দেখেছে নগরবাসী।

নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত হচ্ছে, নগর এলাকার প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল করে ফেলার কারণে ঢাকাসহ দেশের মহানগর, জেলা ও পৌর এলাকার নগরসমূহে পানিবদ্ধতা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে শুধু প্রকৌশল সমাধান খোঁজা হচ্ছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না করেই বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। নগরজুড়ে তৈরি করা হচ্ছে অবকাঠামো। কিন্তু নগরে পানিবদ্ধতা নিরসনে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়ন করে কার্যকর ও টেকসই সমাধান আসবে না। কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সংশ্লেষ ও অর্থনৈতিক লাভের সুযোগ থাকাতে এ ধরনের ব্যয়বহুল প্রকল্পের প্রতি বিভিন্ন নগর সংস্থার অতি আগ্রহ লক্ষ করা যায়। প্রাকৃতিক জলাধারগুলো নগরায়নের চাপে এবং নগর সংস্থাসমূহের উদাসীনতায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে শহরের বৃষ্টির পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। তাই নগর এলাকায় পানিবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য ড্রেনেজ পরিকল্পনার অবকাঠামোগত ও প্রকৌশলগত সমাধানের পাশাপাশি পরিকল্পনাগত ও ব্যবস্থাপনাগত সমাধানের কার্যকর ও টেকসই সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থাকে প্রাধান্য নিয়ে ড্রেনেজ পরিকল্পনা তৈরি করে খাল-জলাশয়-জলাধারসমূহকে রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি কঠিন বর্জ্যের কার্যকর ব্যবস্থাপনা এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক শহরের অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, আজকাল আর ভারি বৃষ্টি বা মুষলধারে বৃষ্টির প্রয়োজন নেই, বরং এক ঘণ্টার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেও পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয় নানা জায়গায়। আর দিনে দিনে এ সংকট বাড়ছেই। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে একাধিক বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরেও সেখানকার অবস্থার উন্নতি হয়নি। গত আগস্ট মাসের শুরুতে লাগাতার এক সপ্তাহের বেশি সময় পানিবদ্ধতায় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের। সেখানে এর জন্য সিটি করপোরেশন এবং নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পরস্পরকে দায়ী করলেও প্রকৃত সমাধানের পথ এখনো পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ঢাকার পানিবদ্ধতা নিয়ে দুই মেয়রের সফলতার দাবি প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, ‘পরিকল্পনার দিক থেকে আদর্শ একটি শহরে বৃষ্টি হলে তার অন্তত ৪০ শতাংশ পানি মাটির ভেতর চলে যাওয়ার কথা। এর ৫০ শতাংশ হয়তো (খাল-নালার মাধ্যমে) রানআউট হতে পারে। আমাদের তো ৯০ শতাংশই রানআউট। এ জন্য দুয়েকটি কাজ করেই যদি কেউ মনে করেন, আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা থাকবে না, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’
ঢাকাসহ আমাদের দেশের অন্যান্য নগর-মহানগরের পানিবদ্ধতা নিয়ে কর্তৃপক্ষীয় পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন নিয়ে যেসব উদ্যোগ বা চেষ্টা আছে, তাতে যে ত্রুটি আছে, যে কারো পক্ষে সেটা ধারণা করা সম্ভব। কারণ, সামান্য বৃষ্টি হলেই যখন রাস্তাঘাট ডুবে যায়, তখন এর ভোগান্তিতো সবাইকেই ভুগতে হয়। সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা থাকলে এটা হতো না। তাই নগর-মহানগর কর্তৃপক্ষ এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের মধ্যকার মতপার্থক্য থাকাটাও স্বাভাবিক। তাছাড়া সিটি করপোরেশনগুলো পদক্ষেপ নিলেই যে তার পূর্ণাঙ্গ সুফল পাওয়া যাবে, ব্যাপারটি তাও নয়। কেননা, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যেমন সততার অভাব আছে, তেমনি ঠিকাদারদেরও শতভাগ কাজ করার ব্যাপারে যথেষ্ট অনিহা থাকে। দুই পক্ষের যোগসাজশে সঠিকভাবে প্রকল্পগুলো সম্পন্ন না করেই বিল তুলে নেয়ার প্রবণতাও বহুদিনের চর্চিত বিষয়। বিষয়টি কমবেশি সকলের জানা থাকা সত্ত্বেও কোথাও কোনো জবাবদিহির বালাই না থাকায় অনিময়-দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া, নগরগুলোর বিভিন্ন সেক্টর দেখাশোনার জন্য আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষ আছে। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও একটা বড় সমস্যা। সেকারণেই দেখা যায়, একই রাস্তা বছরে তিন কর্তৃপক্ষ হয়তো তিনবার কাটছে। এতে অর্থ এবং সময় ব্যয় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সমস্যার আর সমাধান হচ্ছে না। নগরজুড়ে পানিবদ্ধতাসহ নানা সংকট নিয়মিত ব্যাপার হয়ে থাকছে। এতে বরং সংশ্লিষ্ট কর্তাদের নতুন নতুন প্রকল্প তৈরি করে পকেট গরম করার সুযোগও বহাল থাকছে।

সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা, অনিয়ম-দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতাসহ যাবতীয় সংকটের পরেও দেখা যায়, প্রায়ই তারা বিভিন্ন এলাকার নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার করছেন। কিন্তু কিছুদিন পর সেগুলো ভরাট হয়ে গিয়ে আবার আগের অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার মানিকনগরের একটি গলির অবস্থা হলো, ১০ মিনিট বৃষ্টি হলেই পানি জমে। নালা পরিষ্কার থাকলে সেটা পরবর্তী ১০ মিনিটে আবার নেমেও যায়। কিন্তু একটু ভারি বৃষ্টি হলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি জমে থাকে। এর কারণ অন্য কিছু না; ময়লা-অবর্জনা বিশেষ করে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন জমে নালাগুলো বন্ধ হয়ে থাকে। সমস্যা বেড়ে গেলে নালাগুলো পরিষ্কার করা হয়, তখন ১৫/২০ দিন ঠিক থাকে। তারপর আবার নালাগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এই সমস্যা শুধু এ গলির না। এই সমস্যা পুরো ঢাকার। শুধু কি ঢাকার? বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য নগর-মহানগরেরও এই অবস্থা। এখন প্রশ্ন হলো, কর্তৃপক্ষীয় সমস্যা আছে, তাদের পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে, নানা অনিয়ম আছে, দুর্নীতি আছে, স্বচ্ছতার অভাব আছে। আমরা সেগুলোর অবসান চাই এবং বিশ্বাস করি, এসব সমস্যার সমাধান হলে আমাদের নগরগুলোর পানিবদ্ধতা অনেকাংশেই কেটে যাবে।

কিন্তু যখন তারা নালাগুলো পরিষ্কার করছেন, তার কয়েকদিনের মধ্যে সেই নালাগুলোতে যেসব পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতলসহ অন্যান্য কঠিন বর্জ্য আবার জমা হচ্ছে, সেগুলো কি নালার মধ্যে সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের লোকজন ফেলে যাচ্ছে? তাতো না। বরং সেটা আমরাই ফেলছি। আমরা প্রতিদিন বাজার করতে গিয়ে যেসব পলিথিনের ব্যাগ আনছি, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ রাস্তা বা ড্রেনে ফেলে দিচ্ছি। বিভিন্ন কোম্পানির জুস এবং কোমলপানীয় পান করে বোতলগুলো যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছি। রাস্তায় বা গাড়িতে বসে পানি পান করার পর খালি বোতলটা জানালা দিয়ে ফেলে দিচ্ছি। কয়েক দিন আগে দেখলাম, গুলশান শ্যুটিং ক্লাব এবং পুলিশ প্লাজার মাঝের রাস্তায় শত শত প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম কাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অনেকে বাসা-বাড়ির ময়লা পলিথিনে ভরে রাস্তার ধারে ফেলে আসছেন। এগুলো কোথায় যায়? কিছু হয়তো টোকাই বা ক্লিনাররা নিয়ে যায়। বাকিগুলোর গন্তব্য তো একটাই, নালা-নর্দমা। তারপর সেখানে জমাট বেঁধে পানি চলাচলের পথ বন্ধ হওয়া সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলে নালাগুলো বদ্ধ থাকায় পানি জমে রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়ে পুরো নগরকে অচল করে দেয়। এর সর্বশেষ উদাহরণ দেখা গেছে, ঢাকায় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। আমরা যদি সচেতন হতাম, পলিথিন, বোতল বা অন্যান্য অপচনশীল ময়লা রাস্তাঘাট-নালায় না ফেলতাম তাহলে পানিবদ্ধতা এমনিতেই কমে যেত। এসব অপচনশীল দ্রব্য বা যেকোনো ময়লা রাস্তা-নালায় ফেললে যে পানিবদ্ধতা হতে পারে এটা কি আমাদের কারো অজানা বিষয়? মোটেই তা নয়। তারপরও আমরা সেটাই করছি। এর দায় কি সিটি করপোরেশন ওপর দিয়ে নিজেরা বাঁচতে পারবো? না, সেটা সম্ভব নয়। বরং নগরবাসী হিসেবে এই নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে, বসবাসের উপযোগী রাখতে হলে আমাদেরও দায় আছে। সেই দায়টা অনুভব করতে হবে এবং দায়মুক্তির জন্য সচেতনতার সাথে এই মহানগরকে নিজেরা যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় না বানাই সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তারপর আসবে কর্তৃপক্ষীয় ত্রুটির বিষয়গুলো, যা আরো বড় পরিসরে আলোচনা-পর্যালোচনা করে সমাধান করা যাবে।

সব ধর্মেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামে এটাকে ঈমানের অংশ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই শেষ করি, রাসুল সা. এর একটি হাদিস দিয়ে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা আছে। সর্বোত্তম শাখা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। আর সর্বনি¤œ শাখা হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা। (মুসলিম, হাদিস: ১৬২)। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যে নগরে বসবাস করি, সেই নগরের রাস্তাঘাট-নালা-নর্দমা থেকে আল্লাহর হাবিবের এই বাণী অনুসরণ করে আমরা কখনো কি কোনো ময়লা-আবর্জনা-কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করি? বরং করি তার উল্টোটা। যখন যেখানে খুশি ময়লা-আবর্জনা, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল ফেলে রাস্তাঘাট নোংরা করি, পানি চলাচলের পথ বন্ধ করি, শহরটাকে বসবাসের অযোগ্য করি। এ অবস্থায় নগরীর পানিবদ্ধতার দায় আমরা নিজেরা এড়াবো কী করে?

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
মাহফুজ আলমের কথায় ভারতের আঁতে ঘা
অপরাধ বাড়ছে কেন?
বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

১৩ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ

১৩ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ

সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে পটল চাষে বাম্পার ফলন

সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে পটল চাষে বাম্পার ফলন

গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু

গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু

শাহরাস্তিতে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

শাহরাস্তিতে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

পাকিস্তানে অবশেষে সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনা শুরু

পাকিস্তানে অবশেষে সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনা শুরু

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি  বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি

বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি

যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন

যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭

মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭

মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি

মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল

মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪

মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪

মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী

মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী

রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি

রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি