ঢাকা   রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৬ কার্তিক ১৪৩১

বিশ্ব রাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:০৩ পিএম | আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম

মধ্যপ্রাচ্য এবং দূরপ্রাচ্যের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পটভূমি থেকে পরাশক্তিগুলোর চোখ এখন মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা সামলে শ্রীলঙ্কা যখন একটু স্থিতিশীলতার দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছে, তখন ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে বহুমাত্রিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনগণের প্রত্যাশা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে পরাশক্তিগুলোর কৌশলগত অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নিবিড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়া, ¯œায়ুযুদ্ধ অবসান এবং পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাণিজ্যিক প্রতিযোগীতায় চীনের অগ্রযাত্রার মধ্যেও নব্বই দশকের শুরু থেকে বিশ্বব্যবস্থা মূলত এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় পরিনত হয়েছে। ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থা তিন দশক অতিক্রম করলেও পশ্চিমাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তৃতীয় বিশ্বের কোথাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, এমন কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়না। একটি আগ্রাসন আরেকটি আগ্রাসনের ক্ষেত্র তৈরী করেছে। একটি যুদ্ধ আরেকটি যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ও আফগান মুজাহিদদের জানবাজ প্রতিরোধের মুখে সোভিয়েত বাহিনীর পশ্চাৎপসারণ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করেছিল। অজেয় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাস্ত করা তালেবান মুজাহিদদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। কারণ সোভিয়েত বাহিনীকে হটাতে তালেবান-মুজাহিদদের পাশে পেন্টাগণ ও সিআইএ গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে কৌশলগ বোঝাপড়ার কারণে কট্টর ইসলামি শাসন সত্ত্বেও আফগান শাসকদের সাথে মার্কিনীদের একটি বোঝাপড়ার সুযোগ ছিল। মূলত হীন উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক- রাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে জায়নবাদী ইসরাইল লবির প্রভাবিত অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে একের পর এক সামরিক আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে রক্তাক্ত ও অগ্নিগর্ভ করে তুলেছিল। ফিলিস্তিনের অব্যাহত সংগ্রামের পাশাপাশি ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেনের যুদ্ধে লাখ লাখকোটি ডলার ব্যয় করেও পশ্চিমা পরাশক্তি কিংবা তাদের বশংবদ রাজারা কোনো সুবিধা করতে না পেরে প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই প্রাণ নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে পালাতে বাধ্য হয়েছে। আমেরিকায় নাইন-ইলেভেনে সন্ত্রাসী বিমান হামলার সাথে আলকায়েদা ও তালেবান সম্পৃক্ততা কিংবা ইরাকে ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন বা গণবিদ্ধংসী ক্ষেপনাস্ত্র থাকার কথিত মিথ্যা তথ্যের নেপথ্য কলকাঠি ছিল জায়নবাদী মিডিয়া ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর হাতে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অন্তহীন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী বিমান হামলায় নিউইয়র্কের বিশ্ববানিজ্য কেন্দ্রের টুইনটাওয়ার ধ্বংস এবং পেন্টাগনে কথিত হামলার এক ঘন্টার মধ্যেই কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই দায় আলকায়েদার উপর চাপিয়ে ইসলামি জঙ্গিবাদের নামে পুরো মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি ‘ক্রুসেড’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। খৃষ্টীয় দশম-একাদশ শতকে খৃষ্টানদের আরোপিত শতবর্ষব্যাপী ক্রুসেডে শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় ঘটেছিল। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে জায়নবাদীদের প্ররোচনায় সূচিত অন্তহীন ওয়ার অন টেররের শেষ পরিনতিতে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীকে তালেবানদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আফগানিস্তান থেকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছে। একযুগ যুদ্ধ করেও তারা সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দিলে দেশের জনগণ তা মেনে নেয়না। তবে পূর্ব-পশ্চিমের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ এখানে নেপথ্য শক্তি হিসেবে যুদ্ধের ফলাফলের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

অনেক অর্থ, অস্ত্র, প্রাণক্ষয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামোফোবিক জায়নবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে সিকি শতাব্দী আগের পশ্চিমা নীতি এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। একদিকে শত মিলিয়ন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিক এজেন্ডা, অন্যদিকে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমাদের ভারত নির্ভরতা এ অঞ্চলে বড় ধরণের রাজনৈতিক-সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ভারতের অভ্যন্তরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান এবং তাদের দ্বারা মুসলমান নিপীড়নের ধারাবাহিক তৎপরতা ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁধাগ্রস্ত করে সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উত্থান এবং ভারত-মার্কিন সমঝোতার আলোকে নবম জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণের ধারাবাহিক পরিনতিতে বাংলাদেশে হাইব্রিড রিজিমকে কার্যত রাজনৈতিক ব্ল্যাঙ্কচেক দিয়েছিল প্রথমে ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী শাসকেরা। র‌্যাডিকেল মুসলমান ও জঙ্গিবাদের তকমা দিয়ে বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম ইসলামি রাজনৈতিক দল ও আলেম উলামাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালানো হয়েছে। দশম জাতীয় নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার বদলে ব্যাপক জনসমর্থিত বিরোধিদল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দিতা ও বিনাভোটে বিজয়ী ঘোষণার নেপথ্যে প্রধান শক্তি হিসেবে উলঙ্গভাবে ভূমিকা রেখেছিল ভারতীয় কূটনীতিকরা। হুসেন মোহাম্মদ এরশাদকে প্রকাশ্য ঘোষিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা না হলে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে কিংবা পরে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারত। তবে নবম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি জোরদারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। এটি অবশ্য নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া বিরোধিদলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা আপাতত দূর হলেও নবম জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধিদলের কিছু হঠকারি সিদ্ধান্ত, লগিবৈঠার আন্দোলনে রাজপথে মানুষ হত্যাসহ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে আবারো একটি অনিশ্চয়তার নিগড়ে ঠেলে দেয়া হয়। নবম জাতীয় নির্বাচনের অস্বাভাবিক ফলাফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মহাজোটের হাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক ভবিষ্যত কার্যত জিম্মি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমাদের সব উদ্বেগ ও প্রত্যাশার বানী যেন ভারত ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের কাছে অরণ্যে রোদনের মত মূল্যহীন বলে প্রতিয়মান হয়েছে। আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের প্রত্যাশা ও দাবির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যাশা একই সমান্তরাল বিন্দুতে উপনীত হয়েছে। একদিকে বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনে লাখো মানুষের অংশগ্রহণ একটি প্রবল গণজোয়ারে রূপ নিতে চলেছে, অন্যদিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও মানবাধিকারের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, নিষেধাজ্ঞা ও ক্রমবর্ধমান চাপ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাকে সম্ভাবিত করে তুলেছে।

সাম্প্রতিক দশকে পশ্চিমারা যখন অর্থনৈতিক মন্দা ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তখন চীন-রাশিয়ার বহুমাত্রিক তৎপরতা ছিল আফ্রিকা ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে। শত শত বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হলেও চীন-রাশিয়ার ইনফ্লুয়েন্স অনেক দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। এক সময়ের পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রভাব এখন চীন-রাশিয়ার একনায়কতান্ত্রিক প্রভাবে রূপ নিতে চলেছে। আফ্রিকা মহাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ শুধু শিল্পায়ন কিংবা অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে নয়। আফ্রিকা মহাদেশের শতকরা ৭ ভাগ ভূমির মালিকানা নাকি এখন চীনের। ১.২ বিলিয়ন একর বা ১,৮৬,০০০ বর্গকিলোমিটার যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের চেয়ে বেশি। আফ্রিকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং পশ্চিমা প্রভাব হ্রাসের কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অগণতান্ত্রিক শাসনের বিস্তার ঘটে চলেছে। দেশের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার সুযোগ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গ্যাবন, মালি, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, সেনেগাল, ঘানা, সুদানসহ বেশকিছু দেশের সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখল কিংবা অভ্যুত্থান প্রয়াস দেখা গেছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রভাবের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সেনাশাসকরা সাধারণ মানুষের সমর্থনও পাচ্ছে। আফ্রিকার ৩৪টি দেশের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের পক্ষে মত দিয়েছে। আফ্রোব্যারোমিটার নামের সেই গবেষণা সংস্থার জরিপে ২৮টি দেশের বেশিরভাগ মানুষ অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের চেয়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করছে বলে জানা যায়। শত বছর ধরে এসব দেশের উপর পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভিত্তি লাভ করেনি। পুঁজিবাদের প্রবল প্রতিযোগিতায় ঔপনিবেশিকদের শিল্পের কাঁচামাল ও সম্পদ লুন্ঠনের হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এসব দেশ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থাকলে জনগণের কাছে শাসকদের জবাবদিহিতা থাকে বিধায়, জনগণের সম্পদের যথেচ্ছ অপচয়-অপব্যবহার করতে পারেনা। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে যত সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে, সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্য গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন তারা কখনোই তা ভুলতে পারবেনা। উপনিবেশোত্তর বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বের অগণতান্ত্রিক বশংবদ সরকারগুলো আধিপত্যবাদী শক্তির অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিমাদের ইসলামোফোবিক এজেন্ডা ব্যবহার করে দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে একটি অগণতান্ত্রিক রিজিম সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে ভারত ও চীন। পরস্পর বৈরী প্রতিদ্বন্দ্বি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অভিন্ন নীতি অনুসরণ করছে চীন ও ভারত।

গত সিকি শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও এশীয় প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়। ইসলামোফোবিক এজেন্ডা এবং অন্তহীন যুদ্ধের ধারণা তারা ইতিমধ্যেই পরিত্যাগ করেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প সূচিত নরমালাইজেশনের নামে ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্বে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টার পাশাপাশি ফির্লিস্তিনের গাজা উপত্যকার উপর ইসরাইলের অমানবিক অবরোধ, ধারাবাহিক আগ্রাসন ও গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। তবে ডেমোক্রেট জো বাইডেন প্রশাসন ইরানের সাথে ভেঙ্গে যাওয়া সমঝোতা চুক্তিতে ফিরে যাওয়া কিংবা নতুন সমঝোতার প্রয়াসে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে আটকে পড়া ৬ বিলিয়ন ডলারের রির্জাভ ফিরিয়ে দেয়াসহ দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ও হয়েছে। এটি এমন সময়ে বাস্তবায়িত হয়েছে, যখন ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়াকে ড্রোনসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে। যখন রাশিয়া, চীন, ব্রাজিলের নেতৃত্বাধীন ব্রিক্স জোটে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ইরান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ব্রিক্সের বিকল্প মুদ্রার প্রস্তাব এবং বিকল্প বাণিজ্যিক লেনদেন ব্যবস্থা মার্কিন ডলারের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক-আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে ভারত এক চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। চীনের মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল মার খাচ্ছে। ভারতের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাষ্ট্রীয় অখ-তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কানাডায় ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদিপ সিং নিজ্জারের হত্যাকা- নিয়ে জাস্টিন ট্রুডো সরাসরি নরেন্দ্র মোদিকে অভিযুক্ত করেছেন। এ নিয়ে শুরু হওয়া কূটনৈতিক যুদ্ধে দুই দেশ পরস্পরের কুটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সহযোগী দেশ কানাডার অভিযোগ এবং পদক্ষেপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিরব সমর্থকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। জো বাইডেন প্রশাসন তার পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং মানবাধিকারের মত বিষয়গুলোকে অন্যতম শর্তযুক্ত মানদ- হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ ক্ষেত্রে চীনের বৈরী প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টি মনে রেখেও ভারতের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে অনেকটা অনমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভাতীয় গোয়েন্দাদের হাতে বিদেশের মাটিতে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা কিংবা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে গত দেড় দশকে ভারতের নেতিবাচক ভূমিকার বিষয়টিও মার্কিনীরা বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখছে। এসিএলইডি বা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ডেটা প্রজেক্ট নামের একটি পশ্চিমা জরিপ সংস্থা বিশ্বের ২৪০টি দেশ ও অঞ্চলের রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার বিবরণ সামনে রেখে গত বছরের জুলাই থেকে এক বছরের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে সংঘাতপ্রবণ ৫০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকায় ভারত ১৬ নম্বরে, পাকিস্তান ১৯ নম্বরে এবং বাংলাদেশ ২২ নম্বরে রয়েছে। আগামি ৬ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবচেয়ে জটিল। বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ সুগম করতে ইন্দো-প্যাসিফিকে পশ্চিমাদের সহযোগী হিসেবে অতীতের অগণতান্ত্রিক, অন্ধকার পথ ছেড়ে স্বচ্ছ ও ইতিবাচক পথ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ভারত একই সঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং পশ্চিমাদের কাছে নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপনের সুযোগ লাভ করতে পারে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

যুক্তরাষ্ট্রের নারী প্রেসিডেন্ট কি অধরাই থেকে যাবে?
গণঅভ্যুত্থানের সাবলিমিটি : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন
গণতন্ত্রের স্বার্থে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে
মুসলিম দেশগুলোতে সুশাসনের ঘাটতি
তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব
আরও

আরও পড়ুন

'বক্স অফিস কাঁপানো সিনেমা 'সিংহাম এগেইন' এবার ওটিটিতে স্ট্রিমিং হতে যাচ্ছে'

'বক্স অফিস কাঁপানো সিনেমা 'সিংহাম এগেইন' এবার ওটিটিতে স্ট্রিমিং হতে যাচ্ছে'

ডেমোক্র্যাটদের 'অপরাজেয়' জোটের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে ট্রাম্পের হাত ধরে

ডেমোক্র্যাটদের 'অপরাজেয়' জোটের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে ট্রাম্পের হাত ধরে

রাজবাড়ীতে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, হাতেনাতে যুবক আটক

রাজবাড়ীতে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, হাতেনাতে যুবক আটক

কালিয়াকৈরে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনবন্ধুর মৃত্যু আহত-১

কালিয়াকৈরে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনবন্ধুর মৃত্যু আহত-১

হামাসের সঙ্গে চুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে ইসরাইলিরা

হামাসের সঙ্গে চুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে ইসরাইলিরা

সাতকানিয়ায় ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মাঠে বিজিবি

সাতকানিয়ায় ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মাঠে বিজিবি

আ.লীগের নাশকতা ঠেকাতে টঙ্গীতে মহাসড়কে বিএনপির অবস্থান-বিক্ষোভ

আ.লীগের নাশকতা ঠেকাতে টঙ্গীতে মহাসড়কে বিএনপির অবস্থান-বিক্ষোভ

ফ্যাসিস্ট হাসিনার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নকারী ১০ জন গ্রেপ্তার

ফ্যাসিস্ট হাসিনার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নকারী ১০ জন গ্রেপ্তার

‘ফ্যাসিস্টদের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’ স্লোগানে উত্তাল নূর হোসেন চত্বর

‘ফ্যাসিস্টদের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’ স্লোগানে উত্তাল নূর হোসেন চত্বর

পেন্টাগন কীভাবে সামলাবে ট্রাম্পের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত?

পেন্টাগন কীভাবে সামলাবে ট্রাম্পের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত?

ক্যান্সার আক্রান্ত অভিনেত্রী আফরোজা হোসেন আর নেই

ক্যান্সার আক্রান্ত অভিনেত্রী আফরোজা হোসেন আর নেই

দোয়ারাবাজারে ইউপি শ্রমিক লীগের সভাপতি জামিল খান গ্রেফতার

দোয়ারাবাজারে ইউপি শ্রমিক লীগের সভাপতি জামিল খান গ্রেফতার

আ.লীগ নিষেদ্ধের বিষয়ে যা বললেন চিফ প্রসিকিউটর

আ.লীগ নিষেদ্ধের বিষয়ে যা বললেন চিফ প্রসিকিউটর

আলতাফ হোসেন চৌধুরীর গাড়ীতে হামলা ঘটনায় আ.লীগের ৫৬ নেতাকর্মীর নামে মামলা

আলতাফ হোসেন চৌধুরীর গাড়ীতে হামলা ঘটনায় আ.লীগের ৫৬ নেতাকর্মীর নামে মামলা

ঘানাকে পরিচ্ছন্ন করতে মাঠে নেমেছে "বাজ স্টপ বয়েজ" - দেশজুড়ে প্রশংসিত

ঘানাকে পরিচ্ছন্ন করতে মাঠে নেমেছে "বাজ স্টপ বয়েজ" - দেশজুড়ে প্রশংসিত

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশ থেকে ৯ গ্রেনেড উদ্ধার

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশ থেকে ৯ গ্রেনেড উদ্ধার

শিশু মুনতাহা হত্যায় জড়িত সন্দেহে ৩ নারী আটক

শিশু মুনতাহা হত্যায় জড়িত সন্দেহে ৩ নারী আটক

স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় বন্যা মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা নিয়ে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ

স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় বন্যা মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা নিয়ে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ

নতুন ধারাবাহিক 'হাউজ হাজবেন্ড' নিয়ে ছোট পর্দার ফিরছেন নির্মাতা ফরিদুল হাসান

নতুন ধারাবাহিক 'হাউজ হাজবেন্ড' নিয়ে ছোট পর্দার ফিরছেন নির্মাতা ফরিদুল হাসান

শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষ্যে তারেক রহমানের বাণী

শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষ্যে তারেক রহমানের বাণী