পর্যটনের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২২ পিএম | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর নাজুক বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পর্যটন ব্যবসার প্রসার শুরু হয়। পর্যটন কেন্দ্রের সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে এবং পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৮০ সাল থেকে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা United Nations World Tourism Organisation (UNWTO) এর সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ ২৭ সেপ্টেম্বরকে ‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, Tourism & Green Investments অর্থাৎ পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ।’
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চোখে ‘এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার/কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়/কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র/আকাশ তলে মেশে/এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায়/বাতাস কাহার দেশে’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে পারলে দেশকে সুইজারল্যান্ডের মতো নান্দনিক এবং শীর্ষ পর্যটন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা সম্ভব। সে লক্ষ্যে বাংলার আকাশ, বাংলার বাতাস, সবুজ সমারোহ, পাহাড়, সমুদ্র, ঝর্ণা, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নদী, সুন্দরবন, নৃতাত্ত্বিক সৌন্দর্য্য, পুরাকীর্তি, হাওর, ইতিহাস-ঐতিহ্যে মুখরিত প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপত্যকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দিতে, পর্যটন খাতের উন্নয়নে এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে The Bangladesh Parjatan Corporation Order, ১৯৭২’ নামক ১৪৩ নং President Order(PO) প্রণয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় চৎবংরফবহঃ ঙৎফবৎ এর ৩(১) নং ধারা অনুযায়ী ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’ এবং ১৯৭৩ সালে শুরু হয় এর কার্যক্রম।
জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যটন শিল্প একক বৃহত্তম অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের যেকোন দেশের পর্যটককে আকর্ষণ করার বহুমাত্রিক রূপবৈচিত্র্যের অপার সম্ভাবনাময় এ শিল্পের সেবার সার্বিক উন্নয়ন, পরিচালনা ও বিকাশ, অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের ক্রমবর্ধমান অবদানকে আরও শক্তিশালী করতে সরকার ২০১০ সালে প্রণয়ন করে ‘বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড আইন-২০১০’। এ আইনের ৪(১) নং ধারা অনুসারে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে ‘বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি)’ গঠন করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বহির্বিশ্বে পর্যটন শিল্পের ভাবমর্যাদা উন্নয়নে ব্যাপক প্রচার ও বিপণনে কাজ করা। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অপরাধ দমনে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেস্বর যাত্রা শুরু হয় ট্যুরিস্ট পুলিশের। এ শিল্পের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে এবং সমৃদ্ধ করতে সরকার ২০২২ সালের ৭ জুন ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (সংশোধন) বিল-২০২২’ সংসদে পাস হয়। প্রথমে ছোট ছোট ৬টি ইউনিট নিয়ে পর্যটন খাতের কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে তার সংখ্যা ৪৬।
গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের ভাবনায়, ‘বিশ্ব কবির সোনার বাংলা/নজরুলের বাংলাদেশ/জীবনানন্দের রূপসী বাংলা/রূপের যে তার নেইকো শেষ।’ শহরের ইট-পাথরের দেওয়ালে আবদ্ধ থেকে বুঝা যায় না বাংলাদেশে এত সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ১০৩৬ কি.মি. সীমান্ত সড়ক নির্মাণাধীন, যার পুরোটাই একটি পর্যটন সড়ক। ইসলাম প্রচারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পীর-মাশায়েখ-অলি-আউলিয়া-বুজুর্গগণের কার্যক্রমকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নান্দনিক নিদর্শন স্বরূপ দরগা, কেল্লা, মাজার এবং সরকার সারাদেশে ৫৬০টি নান্দনিক মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, নেপাল, ভুটান ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে পর্যটকদের আকর্ষণ করাতে পারায় সেখানে পর্যটকদের ভীড় দিনে দিনে বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। ভ্রমণে উৎসাহিত করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে ইসলামিক দেশের নাগরিকদের কাছে এটি তুলে ধরতে পারলে এবং মুসলিম উম্মার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত ‘বিশ্ব ইজতেমা’র সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইসলামিক পর্যটন দ্রুত বিকশিত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে ।
২০২২ সালে বিশ্ব জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৭.৬%, যা ২০২১ সালের তুলনায় ২২% বেশি। ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিলো ৩.০২% এবং মোট কর্মসংস্থানের ৮.০৭% সুযোগ তৈরি হয়েছে এ খাতে (সূত্র: বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড)। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র মালদ্বীপে ২০২১ সালে জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের মোট অবদান ছিল ২ হাজার ৮৭ মিলিয়ন ডলার, যা দেশটির মোট জিডিপির ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি)। এটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপিতে ১০ শতাংশ অবদান রাখা সম্ভব। (সূত্র: বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড)। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পর্যটনের প্রায় ১ হাজার ১০০টি স্পর্ট থাকলেও পর্যটকেরা মূলত কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের মতো গুটিকয়েক গন্তব্যেই ভ্রমণে যাচ্ছেন। দেশে এখাতে বর্তমানে প্রায় ৪৫ হাজার শ্রমিকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান রয়েছে। এ খাত বিস্তৃতিতে কর্মসংস্থান বাড়ালে বেকারত্ব কমবে বহুগুণে।
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটলেও পর্যটন কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে; বিশেষ করে দুর্গম এলাকাসমূহ যেমন পার্বত্যাঞ্চল, হাওরাঞ্চল, সুন্দরবনের যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও উপযুক্ত অবকাঠামোগত অসুবিধা, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহের অন্যতম অন্তরায়। ছিনতাইকারী কিংবা প্রতারকের আক্রমণের শিকার পর্যটকÑ এমন খবর স্থান পায় পত্রিকার পাতায়। ফেরিওয়ালা কিংবা ফটোগ্রাফারদের অহেতুক বাড়াবাড়ি বিব্রতকর। বড় এবং ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্রগুলো যেমন কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকদের চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন সুবিধা ও সেবা দিতে না পারলে বিদেশি পর্যটকরা উৎসাহিত হবেন না। বিশ্বের যে দেশগুলো (যেমন প্রতিবেশী রাষ্ট্র মালদ্বীপ) অর্থনীতি পর্যটন নির্ভর; তাদের অনুসরণ করা যেতে পারে। পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে যে সকল হোটেল-মোটেল নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোতে যুগোপযোগী সেবা নিশ্চিত করতে পারলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে কয়েকগুণ।
জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’ ৮.৯ এর, ‘২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই পর্যটনের প্রসারে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ স্থানীয় সংস্কৃতি ও পণ্যের প্রসার ঘটানো’, ১২বি এর, টেকসই পর্যটনের ওপর টেকসই উন্নয়নের প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য সরঞ্জামের উন্নয়ন ও বাস্তবায়নকে ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ বাস্তবায়ন করতে সরকারের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠানকে পর্যটন খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে এ শিল্পের উৎকর্ষ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে বাংলাদেশের পর্যটন,সংস্কৃতি নিয়ে ‘মুজিব›স বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২৭-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এ ৪ দিন ব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যটনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে একটি বড় খাত বেসামরিক বিমানের সঙ্গে পর্যটনকে এক করা হয়েছে, যার কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমে মনোযোগ কিছুটা হলেও মন্থর। পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অফিস রামগড়, খাগড়াছড়ি
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ধামরাইয়ে উপজেলা আ' লীগের সাধারণ সম্পাদক কবির গ্রেফতার
আগামীকাল প্রকাশিত হচ্ছে নূরানী কেন্দ্রীয় সনদ পরীক্ষার ফলাফল
২০২৫ সালে মুক্তি পেতে যাচ্ছে অমিতাভ রেজার 'রিকশা গার্ল' সিনেমা
ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের
‘পাঠ্যপুস্তক থেকে নোংরা শব্দ বাদ দিতে হবে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে অধিকাংশ মানুষের চেতনার আলোকে সাজাতে হবে’
নরসিংদীতে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত শ্রমিকদল নেতার ৬ দিন পর মৃত্যু
১০ মামলার আসামী সিলেট মহানগর আ‘লীগ নেতা বিজিত গ্রেপ্তার
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খুলনা অঞ্চলের বিজনেস রিভিউ মিটিং অনুষ্ঠিত
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
হিমেলের দুচোখ হারানো মামলা মির্জাপুরে আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার
আল্লাহর একাত্ববাদ কায়েম করতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে
কুয়াকাটায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ৬৭ হাজার জরিমানা
ভ্রমণকারীদের জন্য মেডিকেল ডেবিট কার্ড নিয়ে এল ভিসা ও ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি
সংস্কারবিহীন নির্বাচন দেশে নব্য ফ্যাসিবাদের জন্ম দেবে
নেত্রকোনার পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
আটঘরিয়ায় নারীর মৃতদেহ উদ্ধার
রামপালে ইউপি চেয়ারম্যান নাসির বরখাস্ত
রাজবাড়ীর কালুখালীতে এনআরবিসি ব্যাংকের ১০৮তম শাখার উদ্বোধন
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান শাখায় অপ্রীতিকর ঘটনা
খুলনা বারের সাবেক সম্পাদক কারাগারে