ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ সা.
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২২ পিএম | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম
মহানবীর জীবন প্রধানত দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়, মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মক্কায় তাঁর জন্ম, বৃদ্ধি ও নবুয়ত লাভ এবং মদীনায় তাঁর হিজরত, ইসলামের বাস্তবায়ন ও ওফাত লাভ। নবী ইবরাহীম (আ.)-এর দুই পুত্র ছিলেন ইসমাইল ও ইসহাক। ইসমাইলের মা ছিলেন বিবি হাজেরা এবং ইসহাকের মা ছিলেন বিবি সারা। দুই ছেলেই ‘নবী’ হয়েছিলেন। ছোট ছেলে ইসহাকের পুত্র ইয়াকূবও ‘নবী’ ছিলেন এবং তার অপর নাম ছিল ‘ইসরাইল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। তাঁর বারোটি পুত্রের বংশধরগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে হাজার হাজার নবীর জন্ম হয়। ইউসুফ, মূসা, হারূন, দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা (আ.) ছিলেন এই বংশের নবী ও রাসূল। বলা চলে যে, আদম (আ.) হ’তে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত হযরত নূহ ও ইদরীস (আ.)সহ ৮/৯ জন নবী ছাড়া এক লক্ষ চবিবশ হাজার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আ.)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আ.)-এর বংশধর অর্থাৎ বনু ইসরাইল। যাদের সর্বশেষ নবী ছিলেন হযরত ঈসা (আ.)। অন্যদিকে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর বংশে একজন মাত্র নবীর জন্ম হয় এবং তিনিই হ’লেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)। ফলে আদম (আ.) যেমন ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা, নূহ (আ.) ছিলেন মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা, তেমনি ইবরাহীম (আ.) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সকল নবী ও তাঁদের অনুসারী উম্মতে মুসলিমাহর পিতা। ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর হুকুমে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাইলকে মক্কায় রেখে আসেন ও মাঝে-মধ্যে গিয়ে তাদের দেখাশুনা করতেন। তাঁরা সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন। অন্যদিকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ও তার পুত্র ইসহাক ও অন্যদের নিয়ে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীনে) বসবাস করতেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইবরাহীম (আ.)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে মক্কা ও ফিলিস্তীন দুই এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটে। কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর মধ্যে আদম, নূহ, ইদরীস ও মুহম্মদ (সা.) বাদে বাকী ২১ জন নবী ছিলেন বনু ইসরাইল এবং একমাত্র মুহম্মদ হ’লেন বনু ইসমাইল।
মুহম্মদ (সা.) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের পর মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১ হিজরী সনের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সকালের দিকে চান্দ্র বর্ষের হিসাবে ৬৩ বছর ৪দিন বয়সে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। সৌরবর্ষ হিসাবে জন্ম ৫৭১ খৃষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল সোমবার এবং মৃত্যু ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ৬ জুন সোমবার। বয়স ৬১ বছর ১ মাস ১৪ দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আবরাহা কর্তৃক কা‘বা আক্রমণের ৫০ অথবা ৫৫ দিন পরে। এটা ছিল ইবরাহীম (আ.) থেকে ২৫৮৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন পরের এবং নূহের তূফানের ৩৬৭৫ বছর পরের ঘটনা। রাসূল (সা.) দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন মোট ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘণ্টা। তন্মধ্যে তাঁর নবুয়ত কাল ছিল ৮১৫৬ দিন। এ হিসাব হ’ল সুলায়মান মানছূরপুরীর।
তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা, দাদার নাম আব্দুল মুত্তালিব, দাদীর নাম ফাতেমা। নানার নাম ওয়াহাব, নানীর নাম বাররাহ। নানার বংশসূত্র রাসূলের ঊর্ধ্বতন দাদা কিলাবের সাথে এবং নানীর বংশসূত্র কুছাই-এর সাথে যুক্ত হয়েছে। নানা ওয়াহাব বনু যোহরা গোত্রের সরদার ছিলেন। দাদার হাশেমী গোত্র ও নানার যোহরা গোত্র কুরায়েশ বংশের দুই বৃহৎ ও সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল।
তাঁর বংশধারাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ১ম ভাগে মুহম্মদ (সা.) হ’তে ঊর্ধ্বতন পুরুষ আদনান পর্যন্ত ২২টি স্তর। যে ব্যাপারে কারো কোনো মতভেদ নেই। এর উপরে ২য় ভাগে আদনান থেকে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত ৪১টি স্তর এবং তার উপরে তৃতীয় ভাগে ইবরাহীম (আ.) হ’তে আদম (আ.) পর্যন্ত ১৯টি স্তর। যেখানে নাম ও স্তরের ব্যাপারে বিদ্বানগণের মতভেদ রয়েছে। আদনান পর্যন্ত বংশধারা হলো: (১) মুহাম্মাদ বিন, (২) আব্দুল্লাহ বিন, (৩) আব্দুল মুত্ত্বলিব বিন, (৪) হাশেম বিন, (৫) আবদে মানাফ বিন, (৬) কুছাই বিন, (৭) কিলাব বিন, (৮) মুররাহ বিন, (৯) কা‘ব বিন, (১০) লুওয়াই বিন, (১১) গালিব বিন, (১২) ফিহর (লকব কুরায়েশ) বিন, (১৩) মালেক বিন, (১৪) নাযার বিন, (১৫) কানানাহ বিন, (১৬) খুযায়মা বিন, (১৭) মুদরেকাহ বিন, (১৮) ইলিয়াস বিন, (১৯) মুযার বিন, (২০) নাযার বিন, (২১) মা‘দ বিন এবং (২২) আদনান। এর মধ্যে পরদাদা হাশেম-এর নামে হাশেমী গোত্র এবং দ্বাদশতম পুরুষ ফিহর, যার উপাধি ছিল কুরায়েশ, তার নামানুসারে কুরায়েশ বংশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। কুরায়েশ অর্থ সাগরের তিমি মাছ। ইয়ামনের বাদশাহ হাসসান মক্কা আক্রমণ করে কা‘বা উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ফিহর তাকে যুদ্ধে হারিয়ে তিন বছর বন্দী করে রাখেন। অতঃপর তাকে মুক্তি দেন। হাসসান ইয়ামনে ফেরার পথে রাস্তায় মারা যায়। এই ঘটনার পর থেকে ফিহর ‘আরবের কুরায়েশ’ বলে খ্যাতি লাভ করেন’। রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় বংশ সম্পর্কে বলেন: ‘আল্লাহ ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাইলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাইলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বনু কানানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বনু কানানাহ থেকে কুরায়েশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বলতেন, আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো‘আ ও ঈসার সুসংবাদ (এর ফসল)’। কেননা ইবরাহীম ও ইসমাইল বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় দো‘আ করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে: ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি তাদের মধ্য হ’তে একজনকে তাদের মধ্যে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করুন, যিনি তাদের নিকটে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)।
পিতা-পুত্রের এই মিলিত দো‘আ দুই হাজারের অধিক বছর পরে শেষনবী মুহম্মদ (সা.)-এর আগমনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করে।
একইভাবে ঈসা (আ.) স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে শেষনবী আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেন, যেমন আল্লাহ বলেন: ‘স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনু ইসরাইলগণ! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যয়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম আহমাদ’ (ছফ ৬১/৬)।
পিতা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে পিতার হুকুমে ইয়াসরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ও সেখানে নাবেগা জা‘দীর গোত্রে সমাধিস্থ হন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়।
প্রচলিত প্রথা মোতাবেক সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়। পিতৃহীন নবজাতককে কোলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুত্তালিব কা‘বা গৃহে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দো‘আ করেন। আকীকার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, ‘মুহম্মদ’। এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে, আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হোক। ওদিকে স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং ‘সর্বাধিক প্রশংসিত’। উভয় নামই কুরআনে এসেছে। যেমন ‘মুহম্মদ’ নাম এসেছে চার জায়গায়। যথাক্রমে- সূরা আলে ইমরান ৩/১৪৪, আহযাব ৩৩/৪০; মুহম্মদ ৪৭/২ এবং ফাৎহ ৪৮/২৯। তাছাড়া ‘মুহম্মদ’ নামেই একটি সূরা নাযিল হয়েছে সূরা মুহম্মদ (৪৭ নং)। অনুরূপভাবে ‘আহমাদ’ নাম এসেছে এক জায়গায় (ছফ ৬১/৬)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘আমার কয়েকটি নাম রয়েছে। আমি মুহম্মদ (প্রশংসিত), আমি ‘আহমাদ’ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি ‘মাহী’ (বিদূরিতকারী) আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের’ (জমাকারী), কেননা সমস্ত লোক কিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফা‘আতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘আকেব’ (সর্বশেষে আগমনকারী) আমার পরে আর কোন নবী নেই’। সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, উক্ত নাম সমূহের মধ্যে মুহম্মাদ ও আহমাদ হ’ল তাঁর মূল নাম এবং বাকীগুলো হ’ল তাঁর গুণবাচক নাম।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সারাদেশে নৌযান শ্রমিকদের কর্মবিরতির আল্টিমেটাম মোংলায় প্রতিবাদ সভা এবং বিক্ষোভ
সংস্কার কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের সূচি: আসিফ মাহমুদ
ইজতেমার মাঠে মুসল্লিদের উপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল
কলাপাড়ায় দিনমজুরের বসত ঘর পুড়ে ছাই
মেলবোর্নে অনিশ্চিত হেড, অভিষেক হচ্ছে কনস্টাসের
লে. জেনারেল মাইনুলকে বিদেশ যেতে বাধা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের কলমবিরতি
এস আলমের চিনি, ইস্পাত ও ব্যাগ কারখানা বন্ধ ঘোষণা
পটুয়াখালীতে সুবিধা বঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার দুর্যোগের প্রভাব বিষয়ক প্রজেক্ট ওরিয়েন্টশন
ফরিদপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসকে মারধোর
মুফতি মুতাজ সভাপতি মুফতি শুয়াইব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত
নওগাঁয় দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
সিরিয়ায় বিমান চলাচল স্থগিত করল ইরান
যুক্তরাষ্ট্রে খুন মাদক পাচারকারী সুনীল যাদব, দায় নিল বিষ্ণোই গ্যাং
চাঁদপুরে জাহাজে সেভেন মার্ডার: স্বজনদের দাবি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড
বাগেরহাটে ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন বরখাস্ত
কালীগঞ্জে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা
"স্বপ্ন রুরাল ফাউন্ডেশন: তরুণদের হাত ধরে সমাজ বদলের এক নতুন যাত্রা"
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনে পুড়ে ছাই হাজারো ঘর, শিশুসহ নিহত দুজন
সিলেট সীমান্ত থেকে ১৩ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ