চাই সকলের জন্য নিরাপদ বাসস্থান
০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
বিশ্ব বসতি দিবসের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো পরিকল্পিত নগরায়ন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন নীতি প্রচার করা, যা প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করবে। বিশেষ করে, শহরাঞ্চলে উন্নত জীবনযাত্রা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, গৃহহীনতা এবং নগর পরিকল্পনার মতো সমস্যাগুলির সমাধানের উপর জোর দেয়া হয়। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, পরিকল্পিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থিতিশীল নগর প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য।
নিরাপদ বাসস্থান ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সকল দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের নিরাপদ ও মানসম্মত বাসস্থানের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের এ প্রত্যয়কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৬ সালের জাতীয় গৃহায়ণ নীতিতে সাধ্যের মধ্যে সবার আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে, বিশেষত নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য।
বাংলাদেশে দিনে দিনে শহরমুখী জনস্রোত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামে নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেকে কাজের সন্ধানে ও আর্থসামাজিক বিভিন্ন সুবিধা যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত সুবিধা ইত্যাদি পেতে শহরমুখী হচ্ছে। এছাড়াও কর্মস্থলের কারণে অনেককেই শহরমুখী হতে হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশের শহুরে জনসংখ্যা ছিলো ৩৯.৭%, যা ১৯৭৩ সালে ছিলো ৮.৬%। বাংলাদেশের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহর, যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৩ হাজারেরও বেশি লোক বাস করে। জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। দ্রুত নগরায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতি বছর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বিশ্ব বসতি দিবস উদযাপন করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করেছিলেন, দেশের সকল মানুষের জন্য যদি নিরাপদ ও মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা না যায় তা হলে একটা জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তার হাত ধরেই ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী জেলার লক্ষীপুর মহকুমায় রামগতি থানার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়, যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের পর স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুর জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো পুনরায় চালু করেন। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন এবং একই বছর তিনি সারা দেশের গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন আশ্রয়ণ প্রকল্প।
সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসার জন্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মডেলকে সামনে রেখে সরকার সুদূরপ্রসারী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৯৭ থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ব্যারাক, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রকার ঘর ও মুজিববর্ষের একক গৃহে মোট ৫ লক্ষ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটি গৃহ কীভাবে সামগ্রিক পারিবারিক কল্যাণে এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত আশ্রয়ণ প্রকল্প। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের এই নতুন পদ্ধতি ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তার পাশাপাশি সরকার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শহরের বস্তিবাসী ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাটে বসবাসের ব্যবস্থা করছে। প্রাথমিকভাবে রাজধানী ঢাকায় বস্তিবাসী ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ১ হাজার ১টি ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে, যার মধ্যে ৩০০টি ফ্ল্যাট ইতোমধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নগরবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মতো পরিকল্পিত উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বঙ্গবন্ধু টানেলে মাধ্যমে সাংহাইয়ের আদলে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে ওয়ান সিটি টু টাউন গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজারকে একটি আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে রূপান্তরিত করতে সরকার অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভকে চার লেনে উন্নীতকরণ, ট্যুরিজম পার্ক ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন ইত্যাদি সরকারের সুদূর প্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ।
কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সামুদ্রিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং মেগা প্রকল্পগুলোর সর্বোচ্চ স্থানীয় সুফল নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। পরিবেশ-প্রকৃতির সংরক্ষণ করে ভূমির উপযুক্ত ব্যবহার ও পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যেই ২৫ বছর মেয়াদী কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে কউক। তার পাশাপাশি পর্যটনের প্রসার, উন্নত আবাসন এবং মেরিটাইম ফ্যাসিলিজ চালুর লক্ষ্যে হাতে নেয়া হচ্ছে ৩০টি প্রকল্প। প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে কক্সবাজার থেকে মহেশখালী ও টেকনাফ পর্যন্ত ক্যাবল কার চালুকরণ, আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টার ও রিক্রেয়েশন জোন তৈরি, থিম পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নির্মাণ, কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন সি-প্লেন চালুকরণ, সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বৃত্তাকার রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। ব্লু-ইকোনমির সুফল ঘরে তুলতে নেয়া হচ্ছে ডিপ সি ফিশিং, সি ওয়েড চাষ, ক্রুজ লাইনার চালুকরণসহ নানা উদ্যোগ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে আগামী এক দশকের মধ্যে কক্সবাজার আবির্ভূত হবে দেশের ইকোনোমিক গেমচেঞ্জার হিসেবে।
সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামাঞ্চলেও। সরকার গ্রামের মানুষের জন্য উন্নত রাস্তাঘাট, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, ডিজিটাল সেন্টার ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণসহ আধুনিক সব সুবিধা গ্রামগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। গ্রামীণ জনপদে টেকসইভাবে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারিত করতে নেয়া হয়েছে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্প।
পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে সকল নাগরিকের আবাসন ও জীবনমান উন্নয়ন গৃহীত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বস্তিবাসী ও দরিদ্র মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে ভূমি বরাদ্দ প্রদান, সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা এবং উপযুক্ত পরিবারের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক নগর পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে গোটা দেশের নগরগুলোর পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে। গণপরিবহন সুবিধা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া পরিকল্পিত নগরায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শহরগুলোতে পর্যাপ্ত পার্ক তৈরি করতে হবে এবং নগরবাসীদের বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করতে হবে। ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে কমবে ঢাকামুখী মানুষের ¯্রােত। উল্লেখিত নাগরিক সুবিধাসমূহ নিশ্চিতকল্পে সরকারি- বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলোর বাস্তবায়িত নগরায়ন মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও চেয়ারম্যান, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
হিমেলের দুচোখ হারানো মামলা মির্জাপুরে আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার
আল্লাহর একাত্ববাদ কায়েম করতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে
কুয়াকাটায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ৬৭ হাজার জরিমানা
ভ্রমণকারীদের জন্য মেডিকেল ডেবিট কার্ড নিয়ে এল ভিসা ও ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি
সংস্কারবিহীন নির্বাচন দেশে নব্য ফ্যাসিবাদের জন্ম দেবে
নেত্রকোনার পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
আটঘরিয়ায় নারীর মৃতদেহ উদ্ধার
রামপালে ইউপি চেয়ারম্যান নাসির বরখাস্ত
রাজবাড়ীর কালুখালীতে এনআরবিসি ব্যাংকের ১০৮তম শাখার উদ্বোধন
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান শাখায় অপ্রীতিকর ঘটনা
খুলনা বারের সাবেক সম্পাদক কারাগারে
ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেল ‘রূপসী বাংলা’ ট্রেন, উৎফুল্ল যাত্রীরা
'মেসির সম্মান রক্ষার্থেই বার্সা ছাড়েন নেইমার'
সারাদেশে নৌযান শ্রমিকদের কর্মবিরতির আল্টিমেটাম মোংলায় প্রতিবাদ সভা এবং বিক্ষোভ
সংস্কার কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের সূচি: আসিফ মাহমুদ
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন
ইজতেমার মাঠে মুসল্লিদের উপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল
কলাপাড়ায় দিনমজুরের বসত ঘর পুড়ে ছাই
মেলবোর্নে অনিশ্চিত হেড, অভিষেক হচ্ছে কনস্টাসের