রুখতে হবে বাল্য বিয়ে
০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য বহুদিক থেকে উন্নত দেশগুলোর কাছেও ঈর্ষার বিষয়। দেশে দীর্ঘদিন ধরে সংসদ নেতা বা প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকৃৃত করে আছেন যারা, তারা নারী। সংসদে বিরোধী দলের নেতৃত্বেও আছেন নারীরা। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে পরপর সাতবার নারী নেতৃত্বের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের অংশীদারিত্ব গৌরবের। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত ৫০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর ৮০ শতাংশের বেশিই নারী।
এগুলো অবশ্য মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠে রয়েছে নারীর প্রতি বঞ্চনার অন্ধকার দিক। কুসংস্কারের ভয়াল দৈত্য নারীর পথচলাকে কণ্টকিত করে তুলছে। বাল্যবিয়ের অভিশাপেও ভুগছে বাংলাদেশের নারীরা। একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য দুনিয়ায় দেশের ৬০ শতাংশ পরিবারে ঘটছে বাল্যবিয়ের ঘটনা। ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জেলাওয়ারি হিসাবে বাল্য বিয়েতে এগিয়ে রয়েছে পিরোজপুর। সেখানে বাল্য বিয়ের হার ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। বাল্য বিয়ের হার সবচেয়ে কম নেত্রকোনায় ২৪ দশমিক ১ শতাংশ।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাল্য বিয়ের শিকার মেয়েদের ৬ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। পিরোজপুরের (৭২ দশমিক ৬ শতাংশ) পর বাল্য বিয়ের শীর্ষে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৬৫ দশমিক ২ শতাংশ), নওগাঁ (৬৫ শতাংশ), ঠাকুরগাঁও (৬২ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং জয়পুরহাট (৬১ দশমিক ৪ শতাংশ)। ৫৬ শতাংশ বাল্য বিয়ের শিকার মেয়েদের মাধ্যমিক পাস করার আগেই বিয়ে হয়েছে। যোগ্য পাত্র পাওয়ার কারণে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ৪৪ শতাংশ অভিভাবক। বাল্য বিয়ের কারণ হিসেবে বাকিদের মধ্যে ১৮ শতাংশ দরিদ্র, যৌতুক কম বা না চাওয়ার কারণে ১০ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের কথা বলছেন ৭ শতাংশ, পড়ালেখায় ভালো না হওয়ার কারণে ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণের কথা বলেছেন ১৫ শতাংশ। নন-প্রবাবিলিটি পারপাসিত স্যাম্পলিং পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীদের বেছে নেওয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকে বাল্য বিয়ে সম্পর্কে তাদের ধারণাগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বাল্য বিয়ে পশ্চাৎপদ অর্ধসভ্য সমাজের অনুষঙ্গ। শিক্ষাদীক্ষা ও উন্নয়নে দেশ এগিয়ে গেলেও বাল্য বিয়ের অভিশাপ যেভাবে জাতির ঘাড়ে চেপে রয়েছে তা দুর্ভাগ্যজনক।
২০১৯ সালের বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করা ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ তরুণীর বিয়ে হয়েছিল তাদের শৈশবে। দেশটিতে বাল্য বিয়ের প্রচলন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং বিশ্বের মধ্যে অষ্টম সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৪৫ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে এবং ১ কোটি ৩ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর হওয়ার আগে। অভিভাবকদের কর্মহীনতা, সন্তানের স্কুল খোলার নিশ্চয়তা না থাকা এবং নিরাপত্তাবোধ থেকে দেশে বেড়ে গেছে বাল্য বিয়ের হার। দেশে আগের তুলনায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে ১৩ শতাংশ। বিগত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই এ হার সবচেয়ে বেশি। বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বলছে, সংঘাত, দুর্যোগ কিংবা মহামারির সময় বাল্য বিয়ের সংখ্যা বাড়ে। আমাদের দেশের ২০ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, করোনার কারণে আরো ২০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। বাল্য বিয়ের ঝুঁকি এসব পরিবারেই বেশি। বর্তমানে ৪৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের নিচে। বাংলাদেশ এখনো বাল্যবিয়ের উচ্চহারের দেশের তালিকায় রয়েছে।
বাল্য বিবাহের ফলে মেয়েদের হারিয়ে যাওয়া শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, রাষ্ট্রেরও ক্ষতি। সুযোগ পেলে বাংলাদেশের মেয়েরাও যে অনেক কিছু করে দেখাতে পারে, শিক্ষা, খেলাধুলাসহ অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা তা প্রমাণ করেছে। ছেলেদের ফুটবল যখন কোনো কিনারা পাচ্ছে না, মেয়েরা তখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা পরিসরে শিখরে ওঠার সামর্থ্য দেখিয়েছে। তাই মেয়েদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসকারী ও জীবন ধ্বংসকারী বাল্য বিবাহ যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।
দেশে জন্মনিবন্ধনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা না থাকায় বয়স বাড়িয়ে বা কমিয়ে যে-কোনো বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন প্রচলিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্য বিয়ে বৈধ করতে পাত্রপাত্রীর বয়স বাড়ানো হয় বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে। আর নিবন্ধনহীন বিয়ে তো বাংলাদেশে ঘটছে অহরহ। সেখানে বয়সের কোনো বালাই নেই।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ১০-১১ বছরে মেয়েদের এবং ১৫-১৬ বছর বয়সে ছেলেদের বিয়ের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অধিকাংশ মা-বাবা অল্প বয়সে কন্যাশিশুকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। বখাটেদের উৎপাতে প্রতি বছরই বিপুলসংখ্যক স্কুলছাত্রী ও তরুণী আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যে দেশে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে, সে দেশ বিশ্বে বাল্য বিয়ের হার বেশি তিনটি দেশের একটি, এটা দুঃখজনক।
বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হলে আগে মানুষশকুন নামধারী বখাটেদের নিরস্ত করতে হবে। মেয়েদের শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার পেছনেও দায়ী বখাটে নামের ঘৃণ্য জীবেরা। তাদের না ঠেকিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধের ব্যবস্থাপত্রে কোনো কাজ হবে না। অর্থনৈতিক সংকটে পড়েও অনেকে মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছেন। তবে একে মূল কারণ না ভেবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা নিলে বাল্য বিয়ের প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু
দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ
বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার
ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের
শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা
অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া
একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে
তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ
‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর
২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা
ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ
ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত
মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি
আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ
অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না
হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু