নিজদেশে পরবাসী তিন পার্বত্য জেলার বাঙালি জনগোষ্ঠী

Daily Inqilab বিদ্যুৎ মিত্র

০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানÑ এই তিন পার্বত্য জেলায় বাঙালিরা মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখানে বাঙালিরা পদে পদেই বঞ্চিত। সংবিধানকে পাশকাটিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। অনেকটা তড়িঘড়ি করে ‘পাহাড় শান্তকরণে’ উপজাতি জনগোষ্ঠিকে অতিরঞ্জিত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। কথিত আছে, চুক্তির সংবিধান-বিরোধী ধারা-উপধারাগুলো সম্পর্কে ভবিষ্যতে কী কী অসুবিধা হতে পারে, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করানো হয়নি। এ কারণে মূল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেক ধারা চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে। এই চুক্তিতে বৈষম্যমূলক এবং বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিতর্কিত অনেকগুলো ধারা-উপধারা রয়েছে। সংবিধান-বিরোধী ধারা-উপধারাগুলো পার্বত্য বাঙালিদের নিজদেশে পরবাসী করেছে। পরিতাপের বিষয়, দেশের বাঙালিদের তিন পার্বত্য জেলায় ভূমি ক্রয় ও স্থায়ীভাবে বসবাস করা সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকদের জন্য সমান অধিকারের কথা বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের সেই অধিকারকে মূল্যায়ন না করে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত করে একচেটিয়া উপজাতিদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে বাঙালিরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। মূলত এই কারণে সব কিছুতে উপজাতীয়দের অধিকার প্রাধান্য পেয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চুক্তির কারণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এ কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিও বারংবার চুক্তির সবগুলো ধারা বাস্তবায়ন করার তাগিদ দিচ্ছে।

চুক্তির পেছনে তাদের জন্য ছিল দুটি শর্ত: ১) সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এবং ২) সকল অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র জমা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ইস্তফা দিয়ে শান্তি আনয়ন করা। এ দু’ শর্তের কোনটিই বাস্তবায়ন করেনি জনসংহতি সমিতি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে যে সকল সংবিধান-বিরোধী ও বৈষম্যমূলক ধারা-উপধারা রয়েছে, তার অংশবিশেষ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. বাঙালিরা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে পারবে না।
২. আঞ্চলিক পরিষদে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে পারবে না।
৩. তিন জেলায় সরকার ভূমিগ্রহণ করতে হলে জেলা পরিষদের অনুমতি লাগবে।
৪. পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডে বাঙালিদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার অধিকার থাকলেও এ ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার থাকবে।
৫. পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, উপজাতি বিষয়ক শরণার্থী টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান এবং পার্বত্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদেও পাহাড়িরা অগ্রাধিকার পাবে।
৬. বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কোনো লোক পাহাড়ে ভূমি খরিদ করতে পারবে না ।
৭. জেলা প্রশাসকের নাগরিকত্ব সনদপত্র ছাড়া ভূমি ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না।
৮. জেলা পরিষদের সদস্য হতে হলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতি-উপজাতি পরিচয় ঠিক করবেন হেডম্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী সার্কেল চিফ।
৯. তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে প্রতি ১০০ জন জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯০ জন উপজাতি কোটায় ও মাত্র ১০ জন বাঙালি নিয়োগ পেয়ে আসছে, যা নিয়োগের ক্ষেত্রে সমীচীন নয় এবং আদৌ সমঅধিকার নয়।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশ জেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত করা।
১১. দেশের প্রচলিত ভূমি আইন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় অকার্যকর করা।
১২. সরকারি চাকরি-শিক্ষায় একতরফাভাবে উপজাতিদের অগ্রাধিকার এবং ৫ ভাগ কোটা বরাদ্দ করে দেয়া।
১৩. পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান।
১৪. তিন পার্বত্য জেলায় কোনো শিল্প কারখানা করতে আঞ্চলিক পরিষদের অনুমতি লাগবেই। এখানে বাইর থেকে এসে কেউ শিল্প কারখানা করতে পারবে না।
১৫. উপজাতিরা সমগ্র বাংলাদেশে বসবাস, চাকরি, ব্যবসা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে; পক্ষান্তরে তিন পার্বত্য জেলায় বাইরের কোনো নাগরিক এ এলাকায় তা করতে পারছে না।

উপরোক্ত সংবিধান-বিরোধী ও বৈষম্যমূলক ধারাসমূহের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর রাষ্ট্র কার্যত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এবং এই অঞ্চলের লাগাম বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে চলে গেছে। বিদেশি অপশক্তির কর্মকা- এবং ষড়যন্ত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এখানকার উপজাতি জনগোষ্ঠী সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকে অনেক এগিয়ে গেছে বর্ণিত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ দেশের সকল নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে উপজাতি স্বার্থান্বেষী মহল সবসময়ই মিথ্যা অভিযোগ ও অসত্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এটা দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে একটি নিত্যনৈমিতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সকল নিরাপত্তা বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান তার নিজস্ব গাডিতে রাষ্ট্রীয় পতাকা বহন করার পরেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হুমকিমূলক কথাবার্তা বলে থাকেন। এতেও বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের তথাকথিত বাম সুশীল সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও টাকার লোভে লালায়িত ব্যক্তি। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ও তাদের সহযোগী বাঙালি সুশীল সমাজ নামধারী ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে, এরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বতিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের মতো অবিকল খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের নীল নকশা বাস্তবায়ন করবে।

লেখক: গবেষক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে
সারবাহী জাহাজে ৭ খুন : দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে
গণতন্ত্র ও সাম্যের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ রুখে দেয়া আর সম্ভব নয়
রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
আরও

আরও পড়ুন

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না

হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু

হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু