ভিসানীতিতে এত অস্বস্তি কেন

Daily Inqilab রিন্টু আনোয়ার

০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

ভিসানীতিতে কার নাম আছে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তা প্রকাশ বা প্রচার করে না। সচরাচর যে দেশের যে ব্যক্তিকে ভিসা রেস্ট্রিকশন দেয় তাকেই জানায়। বড়জোর জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) জানে। সেটিও টপ সিক্রেট। কিন্তু বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়াসহ সবার মুখে মুখে সমানে নামধাম প্রকাশের যেন উৎসব চলছে। ‘ঠাকুর ঘরে কে, আমি কলা খাইনার’ মতো তাদের এ প্রবণতা। অতি উৎসাহী মহলের মধ্যে বিচারপতি, মন্ত্রী, আমলা, শীর্ষ সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ কিছু সাংবাদিকেরও নামধাম দিয়ে ভিসা রেস্ট্রিকশনে পড়াদের তালিকা প্রচারের এক ধুম পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বার বার বলছে, তাদের ভিসানীতির একমাত্র উদ্দেশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন। আর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, নির্বাচনের পথে বাধা দেয়া ব্যক্তিরা। যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশে সবার কাছে প্রায় চিহ্নিত; তারা গত দু’টির মতো সামনেও একটি একতরফা নির্বাচনের আয়োজনে মত্ত। তাই তা আন্তর্জাতিক মহলেরও জানার বাইরে নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের জন্য বছরের শুরু থেকেই সরকারকে নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছে। সরকারও তাদের কাছে নিরপেক্ষতার ওয়াদা দিয়ে আসছে। কিন্তু তারা পরক্ষণেই আবার বলছে, বিদেশিরা কেন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে?

তা হলে আসল কথা কোনটি? বাংলাদেশে বা বাঙালির সাথে যা চলে বা চালানো যায়, বিদেশিদের সাথে অবিরাম তা চালানো যায় না। সমস্যাটি বেঁধেছে এখানেই। এ পর্যন্ত কূটনৈতিক মহলে যতগুলো বৈঠক হয়েছে তার সবগুলো বৈঠকে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার আশ্বাস দিয়ে আসছে দল ও সরকার। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নতুন করে ব্যক্তিপর্যায়ে ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণা দেয়ায় রহস্য কি ক্ষমতাসীনরা আসলে জানে! তবে এটি যে একটি বড় রকমের তাড়নায় ফেলে দিয়েছে তাদের সেটি বুঝার জন্য বুদ্ধিজীবী হওয়ার দরকার হয় না। কখনো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রকে কেয়ার করার সময় নেই। লাগলে পাল্টা স্যাংশন দেয়ার কথাও বলছেন কেউ কেউ। পরক্ষণেই আবার বলছেন, মার্কিন ভিসানীতি বিরোধী দলের জন্যও প্রযোজ্য। যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে তাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ হবে। বিএনপি নির্বাচনবিরোধী দল, তাদের ওপরও সেটি বর্তাবে। এসব নানামুখী কথার মধ্যে আবার যুক্তরাষ্ট্রের গুডবুকে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টাও লক্ষণীয়। সরকারিভাবে সেলফি প্রচার করে তা প্রমাণের চেষ্টা। কর্মীদের একটি বুঝ দেয়ার প্রাণপণ বাতাবরণ।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো যে তাদের অবস্থান থেকে সরছে না সরকারও তা ভালো করে জানে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে অনেকটা ছাই দিয়ে ধরার মতো ধরেছে বাংলাদেশকে। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ও সংস্থা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় বলে সরকারকে জানিয়ে আসছে। সরকারও কথা দিচ্ছে। ওয়াদা করছে। এরপরও কেন বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা? নির্জলা সত্য হচ্ছে, সরকারের মতিগতি, চালাকি; বিরোধীদলকে নাকানিচুবানিসহ পাতানো নির্বাচনের যাবতীয় হাঁড়ির খবর জানে যুক্তরাষ্ট্র। তাই তাদের সাফ বার্তা, বাংলাদেশে নির্বাচনে জালিয়াতি ও নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করায় জড়িতদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না। সরকারি মহল যেভাবে বলছে, একটি দেশে ভিসা না দিলে কী হয়? একটি দেশ আর যুক্তরাষ্ট্র, এক কথা নয়। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাজ্য-কানাডাসহ আরো কয়েকটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাই কার্যকর করে নিজ নিজ দেশে। এর চেয়ে বড় কথা, এসব দেশে পাচার করা অবৈধ অর্থ আর ফেরত না পাওয়া নিয়ে। বেশির ভাগ ভিসা রেস্ট্রিকশন-স্যাংশন খাওয়াদের ভেতরে ভেতরে মূল বেদনা সেখানেই, যা মুখ দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তারা দেখছেন-কেবল ভিসা স্যাংশন নয়, প্যান্ডোরার-বাক্স আরো খুলতে যাচ্ছে। বাংলাদেশস্থ মার্কিন দূতাবাস বলেছে, সূক্ষ্মভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সতর্কতার সাথে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যার বিবরণ প্রকাশ করা হবে না। এই আশ্বাস আরো ভয়ের খড়গ অর্থ পাচারকারীসহ বিদেশে সম্পদ গড়ার কারিগরদের কাছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতই বলছে, ভিসা বিধি-নিষেধ থাকা বাংলাদেশের লোকদের নাম বা সংখ্যা প্রকাশ করবে না তারা তারপরও জড়িতদের ভয় কাটছে না; বরং তাদের ভয় দিন দিন আরো বাড়ছে। তারপর আবার মার্কিন সরকার এই নীতি ঘোষণা করার পর থেকে সব কিছু খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখেছে বলে জানিয়েছে। সেটি আরো ভয়ের বিষয় এ চক্রের কাছে। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যেকোনোভাবে বুঝিয়ে ২০১৪ এবং ২০১৮ এর মতো নির্বাচন করে নৌকা বেয়ে নদী পার করে নিয়ে যেতে পারবে বলে ধারণা দিয়েছিলেন তারা পড়েছেন চরম অস্বস্তিতে। সম্প্রতি দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে ভারত যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির ব্যাপারে বুঝাতে চেয়েছিলেন তাও কাজে লাগেনি। খালিস্তান আন্দোলন নিয়ে কানাডার সাথে ভারতের সম্পর্ক যে হঠাৎ করে বদলে যাবে তা কেউ চিন্তা করতে পারেননি। স্নায়ু-যুদ্ধের সময় পরিস্থিতি এমনিভাবে দ্রুত বদলে যায়। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও তাই হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অন্য কারো চশমা দিয়ে দেখে না। তখন তার বক্তব্যকে অনেকেই গুরুত্ব দেননি। সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়, প্রবাদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা।

ভারত আগের মতো গায়েগতরে খেটে হলেও সব করে দেবে, সেই বাস্তবতা এখন আর নেই বলে সূত্রে প্রকাশ। ভারতেও আগামী বছরের মে মাসে জাতীয় নির্বাচন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবস্থানও আগের অবস্থায় নেই। এ সময়ে চীন-রাশিয়ার আগ বাড়িয়ে বর্তমান সরকারের পাশে থাকার ঘোষণাও আরেক অস্বস্তি। দেশ দু’টিই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপের বেশি বেশি সমালোচনা করে সরকারকে চীন-রাশিয়াপন্থী ‘সিল’ খাইয়ে বেকায়দা অবস্থায় ফেলছে। এ অবস্থা থেকে কায়দা করে সেফ পজিশন নেয়ার রাস্তা সঙ্কীর্ণ করে দিচ্ছে। করে দিচ্ছে কিছুটা বেসামালও। এর আগে কখনো এতটা কাবু হয়নি সরকার; বরং কোনো না কোনো অপশনে উৎরে গেছে। এবার এখন পর্যন্ত সে ধরনের লক্ষণ নেই। অক্টোবর মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাজ্য-কানাডাসহ পশ্চিমা আরো কয়েকটি শক্তিধর দেশের ফাইনাল রাউন্ডে নামার কথা শোনা যাচ্ছে। তারা মার্কিনিদের মতো বেশি সময় নেয় না। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্রের একটি রসায়ন চলমান বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে রয়েছে প্রতিবেশী ভারতীয় গণতন্ত্রের কিছু মিশেলও। সেই ভারতেরই এখন বেগতিক দশা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে পরপর দু’টি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের পেছনে ভারত বর্তমান সরকারকে একচেটিয়াভাবে ক্ষমতাসীন করেছে, ক্ষমতায় টিকিয়েও রেখেছে। সেই হিসেবে আগামীতে ভারত, গেল দু’বারের মতো না পারলেও যদ্দুর সম্ভব, ভূমিকা রাখার আশাবাদ ছিল আওয়ামী লীগের। সেখানে এখন তৈরি হয়েছে বিশাল ছন্দপতন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে
সারবাহী জাহাজে ৭ খুন : দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে
গণতন্ত্র ও সাম্যের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ রুখে দেয়া আর সম্ভব নয়
রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
আরও

আরও পড়ুন

স্ত্রী-সন্তানসহ শাহরিয়ার আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

স্ত্রী-সন্তানসহ শাহরিয়ার আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ৩শ' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ভাঙচুর

মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ৩শ' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ভাঙচুর

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ