কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল শ্রীলংকা
১০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
২০২১ সালে শ্রীলংকা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। তখন দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দেয়। এর ফলে সরকারকে পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে শ্রীলংকা তার আমদানি ব্যয়ও মেটাতে পারছিল না। ফলে দেশটিতে খাদ্য, ঔষধ, জ্বালানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়। তবে বর্তমানে শ্রীলংকা সেই পরিস্থিতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। আবারও জমে উঠতে শুরু করেছে শ্রীলংকার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত পর্যটন। সেই সাথে দেশটির রেমিট্যান্সও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
অনেকের কাছে প্রশ্ন হলো, অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলংকা মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে কীভাবে আবারও অর্থনৈতিক অবস্থা পুনঃরুদ্ধার করলো? শ্রীলংকায় যখন অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা চলছিলো তখন দেশটির নতুন রাষ্ট্রপতি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন; যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানÑ এসব দেশের জন্য পথ পদর্শক হতে পারে।
করোনা মহামারির ধাক্কায় শ্রীলংকায় অর্থনৈতিক পতনের সূত্রপাত হয়েছিল। কারণ, শ্রীলংকা অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা পর্যটন কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। সেই সময় করোনা মহামারির কারণে দেশটির পর্যটন খাত ধসে পড়ার পাশাপাশি প্রবাসী শ্রীলংকানদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ব্যাপকহারে কমে যায়। ফলে শ্রীলংকা ২০২২ সালের শুরুর দিকে ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। তখন আবার শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বিশ্বজুড়ে পণ্য আমদানিব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এতগুলো ধাক্কা শ্রীলংকা একসাথে সামাল দিতে পারেনি।
চরম অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নজিরবিহীন গণআন্দোলনের মুখে পড়ে ২০২২ সালের ২৩ জুলাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যায় রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে। তারপর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় শ্রীলংকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সাথে প্রায় ৩ বিলিয়নের একটি বেইল আউট প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা করেন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, শ্রীলংকা এখনো পুরোপুরি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দেশটি যখন তার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করবে তখন প্রকৃত অবস্থা বুঝা যাবে। একটা সময় শ্রীলংকার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মতো কোনো অর্থ ছিলো না। ফলে বেশির ভাগ দোকানেই ছিলো না কোনো পণ্য। যে সকল দোকানে সামান্য কিছু পণ্য ছিলো সে সকল দোকানের সামনে দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ সারি। বর্তমানে দেশটির সকল প্রকার পণ্যের দাম কমেছে এবং সকল প্রকার পণ্যের সরবরাহ রয়েছে। এতে মানুষের জীবন যাত্রাও আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলংকা মাত্র দুটি বিশেষ সুবিধার কারণে দেড় বছরের ব্যবধানে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, বেশকিছু সরকারি নীতি আর দ্বিতীয়ত, কিছু প্রকৃতিগত বিষয়। সরকারি নীতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেছে এবং সেই সাথে দেশটির রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি মূল্যের দাম কমিয়ে জনজীবনকে সহজ করার চেষ্টা করেছে সরকার। সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য ২৩ লক্ষ অতি দরিদ্র মানুষকে নগদ অর্থিক সহায়তা দিয়েছে। তবে সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো খাতে কর বাড়ানো এবং কিছু খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো পদক্ষেপ বেশ অজনপ্রিয় হয়েছে।
প্রকৃতিগতভাবে পরিবর্তনগুলোর মধ্যে পর্যটন কেন্দ্র এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স উন্নয়ন করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্র থেকে আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭৬ শতাংশেরও বেশি। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়ে আয় করেছিল মাত্র ৪৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ, ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসেই শ্রীলংকা পর্যটন খাত থেকে আয় করেছে ৮২৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। পর্যটনের মতো খাত ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্সও বেড়েছে অনেক। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। গত বছর শ্রীলংকার ৩ লক্ষ ১১ হাজারের বেশি দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়। এদের অনেকে ডাক্তার, প্যারামেডিক কিংবা আইটি প্রোফেশনালÑ সবমিলিয়ে শ্রীলংকা বিদেশে লোক পাঠানোর রেকর্ড নতুন করেছে। গত এক বছরে শ্রীলংকার সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে। চলতি বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
সেইসাথে কৃষিখাত ভালো করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চা ও রাবার রপ্তানি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে সরকার তার অবস্থা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ ও আইএমএফের মতো সংস্থার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সংকট মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বব্যাংক বেশ ভালোভাবে এগিয়ে এসেছিলো। শ্রীলংকায় চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্য থেকে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরুরি প্রয়োজনের খাতে সরিয়ে নেয়, যা ঔষধ, জ্বালানি এবং সারের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে ব্যবহার করা হয়।
এর বাইরে দেশটির বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সংকটকালীন সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালেও শ্রীলংকার জিডিপি কিছুটা কমতির দিকে থাকবে। তবে ২০২৪ সাল থেকে দেশটির জিডিপি আবারও স্বাভাবিক হবে।
শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষের দিকেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক হবে। শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেও বেশি। কোন কোন সংস্থার মতে, এই ঋণের পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি হতে পারে। তার মধ্যে চীন, জাপান, ভারতকেই পরিশোধ করতে হবে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ। মোট ঋণের মধ্যে আবার ২৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ কর্যক্রম এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। শ্রীলংকা যখন ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করবে তখন বুঝা যাবে তার অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলো। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের কাছ থেকে শ্রীলংকা এক বছরের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণ ফেরত দিয়েছে।
দেশটির সংস্কার কার্যক্রম চালাতে গিয়েও সরকারকে বেশকিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি বছর সকল মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৬ শতাংশ করে কমিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়াও সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ভাতা দিয়ে সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি খরচ কমানোর জন্য শ্রীলংকান এয়ারলাইন্স, শ্রীলংকান টেলিকম এবং ইস্যুবেন্স কোম্পানিগুলোকে বেসরকারি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন ইউনিয়ন সরকারের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভর্তুকি কমানো বা বাদ দেওয়ার কারণে মানুষের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যেমন শুধু মাত্র বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৬৩ শতাংশ, ফলে নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। সকল বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে এবং দেশটিকে আবারও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে শ্রীলংকাকে হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে শ্রীলংকার এই অর্থনৈতিক উত্থান হতে পারে অনেক দেশের জন্য পথপ্রদর্শক।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
স্ত্রী-সন্তানসহ শাহরিয়ার আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ৩শ' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ভাঙচুর
অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু
দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ
বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার
ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের
শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা
অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া
একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে
তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ
‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর
২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা
ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ
ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত
মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি
আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ