ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৭ এএম

দাবিয়ে রাখতে রাখতে ঈদয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এক সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করেই রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হয় মানুষ। হাজার বছর ধরে পিতৃপুরুষের উত্তারাধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের জায়গাজমি দখল করে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত জায়নবাদী ইসরাইলের মূল এজেন্ডাই হচ্ছে, পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের ইচ্ছায় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে বিভক্ত ও অহেতুক জুজু দেখিয়ে একটি আতঙ্ক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিইয়ে রাখা। আরব জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ওসমানীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উস্কানি দিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধে খেলাফতের পতন নিশ্চিত করা এবং ফিলিস্তিনে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নানাভাবে অস্থির, নিরাপত্তাহীন ও তটস্থ রাখার জন্য বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিকে কাজে লাগিয়ে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। পাহলভি রাজবংশের দ্বারা শাসিত ইরানের সাথে বৃটিশ ও পশ্চিমাদের চমৎকার সম্পর্ক ছিল। এমনকি জায়নবাদী ইসরাইলের সাথেও ইরানী শাহদের গোপন আঁতাত ছিল। ইরানের সচেতন জনগণের চাপে রাজার ক্ষমতা খর্ব করে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ইরানেই প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকার ইরানের তেলসম্পদকে দেশের জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাতে অ্যাংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বৃটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ তৎপরতায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে পুনরায় পাহলভি রাজবংশের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। ইরানের সম্পদ নিয়ে পশ্চিমাদের এই খেলা ইরানের মুক্তিকামী জনগণ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাঁদের এই অভিজ্ঞতাই ইরানের ইসনলামপন্থী নেতাদের একটি ইসলামি বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্যারিসে নির্বাসিত ইসলামি আন্দোলনের নেতা ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব ছিল পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর বড় চপেটাঘাত এবং চ্যালেঞ্জ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির সরাসরি সমর্থনপুষ্ট সরকারি বাহিনীর সব আগ্রাসন ও প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে বিপ্লব সংঘটিত করার বছর না ঘুরতেই পশ্চিমা শিখন্ডী ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে উস্কে দিয়ে শাত-ইল আরব পানিসীমা বিরোধের অজুহাতে ৮ বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একই সাথে সম্ভাব্য দুই শক্তিকে দুর্বল করার চক্রান্তে যথেষ্ট সফল হয়। ইরানের প্রতিরোধ যোদ্ধারা অসম সাহস ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক ওয়ার গ্রাউন্ড সৃষ্টি করা হয়। ইরানের সাথে যুদ্ধে ইরাকের পাশে থাকা পশ্চিমারা ইরাককে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দিয়ে দেশটিকে কার্যত অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের মুখে ঠেলে দেয়। সেই ঋণ পরিশোধ ও পুনর্গঠনের খরচ যোগাতে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের পরিকল্পনা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনাপত্তি তথা সবুজ সংকেত দিলেও সাদ্দাম কুয়েতে সেনা পাঠানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েত মুক্ত করতে ইরাকের উপর বিশাল সামরিক হামলা শুরু করে দেয়। এরপর ইরাকের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ, ইরানের উপর অবরোধ, শিয়া-সুন্নী বিরোধ উস্কে দিয়ে পেট্রোডলারে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে ইরানের সাথে বিরোধ-বৈরিতা সৃষ্টির পাশাপাশি একের পর এক ইসরাইলী আগ্রাসনে পশ্চিমা ও মার্কিনীদের নি:শর্ত পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে কোনো রাখঢাক নেই। ইরাক-আফগানিস্তান দখল, সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ, আইএস জুজু, ইয়েমেন যুদ্ধসহ সবক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করে জায়নবাদী ইসরাইলের আসনকে মজবুত ও অজেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশি বছর ধরে বিভেদ-বিভক্তিতে বন্দিত্বের জালে আটকে রেখেও পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের জাগরণের শক্তিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ইরানের উত্থান এবং ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রাম তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

গত আশি বছরে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনী আরবদের প্রথম জেনারেশনের প্রায় সবাই নিজেদের হারানো পিতৃভূমি ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন বুকে ধারন করেই আশ্রয় শিবিরের কবরে শায়িত হয়েছেন। এরপরের দুই প্রজন্ম প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জীবন ও সম্পদের ধ্বংস দেখতে দেখতে আজ এক বিস্ফোরণের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে। গাজা এবং ফিলিস্তিনের চার হাজার বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। মিশরীয়, গ্রীক, রোমান ও বাইজান্টাইন-পারস্যসহ প্রতিটি উদীয়মান রাজশক্তির হাতে ফিলিস্তিনের পবিত্র তীর্থস্থানগুলোর ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল ফিলিস্তিনকে একটি স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা বলয়ে স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব। তিনি মুসলমান, খৃষ্টান ও ইহুদিদের সহাবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খ্রষ্টীয় দশম শতকে খ্রীষ্টান ক্রুসেডারদের হাতে কিছুদিনের জন্য ফিলিস্তিন বেদখল হলেও একাদশ শতকে শেষ ক্রুসেডে খলিফা সালাউদ্দিন আইয়ুবির হাতে ফিলিস্তিনের পুর্নদখল ও নতুন অগ্রযাত্রা নিশ্চিত হওয়ার পর পরবর্তী ৮শ’ বছর ধরে তা অব্যাহত ছিল। ইতিপূর্বে খৃষ্টানদের হাতে ইহুদি সম্প্রদায়ের নিগ্রহ ও জাতিগত নির্মূলের সম্মুখীন হলেও মুসলমান সুলতান ও ওসমানীয় খিলাফতের আমলে শত শত বছর ধরে তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উজ্জ্বল নজির সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মূলত সার্বিয়া, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় ও ইউরোপীয় রাজশক্তিগুলোর আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভুত হলেও ঔপবিবেশবাদী ইউরোপীয়দের গোপণ সমঝোতায় মূল টার্গেট ছিল শত শত বছর ধরে দোর্দ- প্রতাপে টিকে থাকা ওসমানীয় খিলাফতকে ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে দখলদারিত্ব কায়েম করা। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানী, ইতালি ও উসমানীয় খিলাফতের কাছে প্রায় হারতে বসা বৃটিশরা দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধের বিশাল খরচ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর ইহুদি কমিউনিটি নেতা লর্ড রথশিল্ডের সহায়তা চেয়েছিলেন। সে কথা বালফোর ডিক্লারেশনে উঠে না আসলেও ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সেই ঘোষণাই ইতিহাসে বালফোর ডিক্লারেশন নামে পরিচিত। বালফোর ডিক্লারেশনে ফিলিস্তিনের সম্ভাব্য ইহুদি রাষ্ট্রে বিদ্যমান অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের (মুসলমান ও খৃষ্টান) সাথে একই রকম আইনগত অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের প্রস্তাবনায়ও ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রস্তাবিত ইহুদি আবাসভূমি ফিলিস্তিনের মোট ভূখ-ের শতকরা ৫৫ ভাগ নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও জায়নবাদি ইহুদিরা তাদের প্রমিজড ল্যান্ড গঠনের ধর্মীয় উন্মাদনায় আরব মুসলমানদের ভূমির উপর অস্ত্রের বলে দখলদারিত্বের উৎসবে মেতে ওঠে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ মদত ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের শক্তি ও বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেয়া ফিলিস্তিনি আরবদের ভূমিতে গড়ে ওঠা ইসরাইলকে কোনো আরব দেশ স্বীকৃতি না দিলেও আরবরা নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক-সামরিক ঐক্য ও গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় ইউরোপ থেকে ওঠে আসা ইহুদিরা বিভক্ত আরব শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্র গঠনেই শুধু সক্ষম হয়নি। তাদের আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।

অবৈধ শক্তি প্রয়োগ ও জবরদস্তি করে রাষ্ট্র কায়েমের অনুমোদন কোনো ধর্মেই স্বীকৃত নয়। জুদাইজম বা ইহুদিবাদীরা কখনোই এমন অন্যায়-অন্যায্যভাবে রাষ্ট্র গঠন করতে চায়নি। ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা এখনো ইসরাইলকে নিজেদের রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই নেতুরি কার্তা নামের ইহুদিবাদী সংগঠন অন্যের জমি দখল করে অন্যায়ভাবে রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করে আসছে। নতুন শতাব্দীর প্রথম দিকে ইসরাইলের ৬০তম প্রতিষ্ঠার বিশাল আয়োজন প্রত্যাখ্যান করে বিশ্বের সিভিল সোসাইটি ও খ্যাতনামা শতাধিক ব্যক্তিত্ব ফিলিস্তিন ও আরবদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত জায়নবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন না করার কথা খোলা চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতি ইহুদি ধর্মযাজক (রাব্বি) ইলহানান বেকের দেয়া একটি ভিডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিও বার্তার ক্যাপশনে রাব্বি ইলহানন বেক বলেন, ‘অ্যাজ জুইশ, উই ডিমান্ড দ্য রিটার্ন অব অর প্যালেস্টিনিয়ান ল্যান্ড, ফ্রম সি টু ল্যান্ড, টু দি প্যালেস্টিনিয়ান পিপল, অ্যান্ড দি পিসফুল অ্যাবোলিশন অব দ্য স্টেইট অব ইসরায়েল।’ তিনি মনে করেন ‘জায়নবাদ হচ্ছে পরম শক্তির সাথে বিদ্রোহ এবং তা জুদাইজমের বিপরীত। জায়নবাদ সভ্যতা ও মানবতার দুশমন। তারা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করছে, তাদের জমিজমা-বাড়িঘর দখল করছে। তারা শুধু শুধু ফিলিস্তিনীদের হত্যা করছে। এই অপরাধের একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।’ দু:খের বিষয় এবং সভ্যতার জন্য লজ্জার বিষয় হচ্ছে, আধুনিক সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো বরাবরই ইসরাইলীদের গণহত্যার মত অপকর্মে সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। তারা মুখে মুখে টু স্টেট সলিউশনের কথা বললেও আদতে তা বাস্তবায়নে কখনোই সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখাতে পারেনি। ইসরাইলীদের ক্রমবর্ধমান ঔদ্ধত্বের জবাবে ফুঁসে ওঠা প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখন জানবাজী রেখে প্রত্যাঘাত করতে শুরু করেছে। হামাসের এবারের আক্রমণ জায়নবাদী ইসরাইল ও পশ্চিমাদের সব হিসাব নিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে হামাস-হেজবুল্লাহ যোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ কোনো তৎপরতা না থাকলেও ইসরাইলীরা প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত উস্কানিমূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। অধিকৃত এলাকায় শত শত নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন থেকে শুরু করে টার্গেট কিলিং, সন্দেহজনকভাবে বিমান হামলা এবং পবিত্র আল আকসা মসজিদে ইহুদিদের অনুপ্রবেশ এবং মুসলমানদের বাঁধাদান এবং পবিত্র রমজান মাসে মসজিদে প্রবেশ করে মুসল্লীদের উপর আক্রমণের ঘটনার পর ফিলিস্তিনীরা ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করেছে। ফিলিস্তিনের জমি দখল করে নতুন বসতি স্থাপনকারী শত শত ইহুদি সম্প্রতি ইসরাইলী সেনা পাহাড়ায় আল আকসা প্রাঙ্গনে জমায়েত হয়ে উল্লাস করেছে। এসব ধারাবাহিক উস্কানিমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে আরব কিংবা বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। উপরন্তু ইতিহাসের এক জটিল সময়ে কতিপয় আরব শাসক ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা ও আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে পাশ কাটিয়ে ইসরাইলের সাথে নরমালাইজেশন বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চুক্তি করেছে। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভেতরে ভেতরে ফুঁসে ওঠা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইতিহাস পাল্টে দেয়ার এক চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ১৬ বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত জেলখানা বলা চলে। সেই জেলখানা থেকেই রাষ্ট্রহীন-নিরূপায় ফিলিস্তিনীরা ৭ অক্টোবর শনিবার সকালে ইসরাইলের সুরক্ষিত নগরীগুলোর উপর নজিরবিহীন রকেট বর্ষণ শুরু করে। মাত্র ২০-২৫ মিনিটে ৫ হাজারের বেশি রকেট ছুঁড়ে ইসরাইলের আয়রনডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ নামিয়ে আনে। শত শত হামাস যোদ্ধা প্যারাগ্লাইডারে উড়ে গিয়ে ইসরাইলে বিভিন্ন শহরে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেছে। শতাধিক ইসরাইলী সেনাসদস্য ও বেসামরিক নাগরিককে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে বন্দি করেছে। সোমবার পর্যন্ত ৯ শতাধিক ইসরাইলীর মৃত্যু এবং ২.৫ হাজারের বেশি আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইসরাইলের দখলদারিত্বের ইতিহাসে এতটা মূল্য আর কখনোই দিতে হয়নি। ক্রমবর্ধমান নিস্পেষনের প্রান্তে এসে ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে অপারেশন ’আল আকসা ফ্লাড’ শুরু করে শত শত হামাস যোদ্ধা ইসরাইলে ঢুকে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেছে।

ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম কলমযোদ্ধা, প্যালেস্টাইন ক্রনিকল-এর সম্পাদক, রামজি বারৌদ কয়েক বছর আগে একটি নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘অ্যান ওপেন লেটার টু ইয়াং মুসলিমস্ এভরিহয়ার: সীড অব ট্রায়াম্ফ ইন এভরি এডভারসিটি’। ‘সকল প্রান্তের মুসলমান তরুণদের কাছে খোলা চিঠি: প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই নিহিত থাকে বিজয়ের বীজ’। শত বছর পূর্বে ভারতীয় স্বাধীনতার অগ্রসেনানী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট ও মজলুম জননেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহার তার এক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ’। রামজি বারৌদের লেখায় যেন সেই কবিতার বাণীরই পুনরোচ্চারণ। একটি ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অভিজ্ঞতা ও একান্ত ইচ্ছা ও বাসনার কথাগুলো তুলে ধরেছেন। যেখানে সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে নিজের প্রত্যাশার ক্ষেত্রগুলোও পরিবর্তিত হতে দেখা গেছে। রামজি বারৌদ শুরুতে বলছেন, ‘আমি যখন ছোট্ট শিশু ছিলাম, তখন আমার স্বপ্ন ছিল, আমি যদি গাজার এই রিফিউজি ক্যাম্পের বাইরে জন্ম নিতাম, এমন কোথাও যেখানে অভাব-অনটন, দারিদ্র্য থাকবেনা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, দখলদারিত্ব বা সামরিক আগ্রাসন বা বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতি থাকবেনা। যখন একটু বড় হলাম, তখন শৈশবের সেই স্বপ্নগুলোর জায়গায় ভিন্ন প্রত্যাশার জন্ম হলো, আমার মনে হলো, সেখানে আমার শৈশবের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোই যেন মধুর মনে হলো, সে সময়ের প্রতিটি স্বপ্ন, প্রত্যাশা, কান্নার অশ্রুসহ প্রতিটি মুহুর্তকে নতুন করে আলিঙ্গনের ইচ্ছা জাগ্রত হল। এরপর আমরা যখন তারুণ্যে উপনীত হলাম, বড়রা আমাদের এ কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, আমাদেরকে কঠোর দারিদ্র্য ও দু:খ কষ্টে কাতর হলে চলবেনা। জীবনের মহত্তম লক্ষ্য ও মানবতার মুক্তি শুধু অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়না। সাংসারিক প্রয়োজনের বাইরে, মনস্তাত্বিক বশ্যতা পরিহার করে অন্যায়, যুদ্ধ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাথে সাথে জীবনকে অর্থবহ এবং সুন্দরতর করতে অতীতের কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলো অনেক বেশী ফলপ্রসু হতে পারে।’ নিজের জীবনের প্রত্যাশা, অভিজ্ঞতা ও বিবর্তনের পথরেখা বর্ণনা করে তিনি আজকের দুনিয়ায় মুসলিম তরুণ প্রজন্মকে স্বদেশে, বিদেশেও প্রবাসের অভিজ্ঞতায় আরো জটিল এবং কঠোরতর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ়, সাহসী ও প্রজ্ঞাময় ভূমিকা পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। আশৈশব বন্দি শিবিরের অভিজ্ঞতা ও ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের গতি প্রকৃতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের আলোকে মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনের সংগ্রামের বাঁক বদলের চিহ্নসমূহ তার কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তাঁর লেখাগুলোতে সেই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। গত জুলাই মাসে প্রকাশিত তাঁর লেখা এক নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘অ্যান আর্মড প্যালেস্টিনিয়ান রেবেলিয়ন ইজ কামিং’। কেন একটি সশস্ত্র ফিলিস্তিনী বিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠেছে, তার বিবরণ দিতে মাত্র কয়েক মাসে ইসরাইলী সেনাদের হাতে শতাধিক বেসামরিক ফিলিস্তিনি, নারী ও শিশুর হত্যা ও নির্যাতনের একটি ধারাবাহিক ফিরিস্তি তুলে ধরেছিলেন। হামাসের হামলায় শত শত ইসরাইলীর মৃত্যুর পর পশ্চিমা মিডিয়াতে মায়াকান্না ও ডিজইনফরমেশন ক্যাম্পেইন চলছে। দশকের পর দশক ধরে প্রায় প্রতিদিন গাজা, পশ্চিম তীর ও জেনিনে মুসলমানদের উপর ইসরাইলী বর্বরতা ও নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের মৃত্যু তাদের কাছে মূল্যহীন। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনকে একটি জিওস্ট্র্যাটেজিক স্কেপগোট হিসেবে বহাল রাখতে চায়। এবারের যুদ্ধে তা আবারো পরিষ্কার হয়ে গেছে। গাজায় ইসরাইলের বেপরোয়া বোমা বর্ষণ এবং ইউরোপ-আমেরিকার পুরনো ভূমিকায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তারা এখনই শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হাঁটতে চাইছে না। এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত আরেকটি আরব ইসরাইল যুদ্ধে পরিনত হয় কিনা, তা’ই এখন দেখার বিষয়।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে
সারবাহী জাহাজে ৭ খুন : দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে
গণতন্ত্র ও সাম্যের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ রুখে দেয়া আর সম্ভব নয়
রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
আরও

আরও পড়ুন

মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ৩শ' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ভাঙচুর

মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ৩শ' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ভাঙচুর

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না