ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

পদ্মাসেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল আরো পাল্টে দেবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে

Daily Inqilab মো. খসরু চৌধুরী সিআইপি

১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ করছে রেলওয়ে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার রেলপথ চালু হয়েছে। আগামী বছর জুনে যশোর পর্যন্ত রেল চালুর লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।
এর আগে ২০২২ সালের স্বপ্নের পদ্মাসেতু ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়। দেশ-বিদেশি নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণ করেন স্বপ্নের পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতুর কারণে পাল্টে গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দৃশ্যপট। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাটসহ এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
পদ্মাসেতু বাংলাদেশের সাহস-গৌরব-সততার প্রতীক। পদ্মাসেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যয়, দৃঢ় মনোবল ও আস্থার প্রতীক। এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়েছে। মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। পদ্মাসেতু নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। এটি ছিল ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্ন। পদ্মাসেতু ও এর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে।
আয়তন ছোট হলেও ১৭ কোটি মানুষের এই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শুধু খাদ্যেই নয়, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন বহির্বিশ্বে বিশেষভাবে প্রশংসিত-ঈর্ষণীয়ও বটে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা এখনো তেমনভাবে মসৃণ হতে পারেনি। চোখে পড়ার মতো রাস্তাঘাটের বেশ কিছু উন্নয়ন, সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আওয়ামী লীগ সবকটি নির্বাচনী ইশতেহারে রেল যোগাযোগ বড় প্রত্যাশার কথা ঘোষণা করেছিল। ক্ষমতার দেড় দশকে তা অনেকটা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। বিদেশি ঋণ ছাড়াই পদ্মাসেতু ও পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ দেয়ার মতো বড় বড় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লেইন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লেইন, ঢাকা মেট্রোরেল, যমুনা নদীর উপর নির্মিতব্য নতুন রেলসেতু, কালুরঘাট রেলসেতু ইত্যাদি।
পদ্মাসেতু জাতির মর্যাদার প্রতীক। নিজস্ব অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সেতুবন্ধনে তৈরি হয়েছে নতুন মাত্রা। দ্রুত যাতায়াতের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ। পদ্মাসেতু এখন বাংলাদেশ ও বাঙালির গর্বের, আনন্দের ঝরনাধারা।
পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পর্যটন ও শিল্পায়নে যে আকাশচুম্বী সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন পরিকল্পনার সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের ওই অঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, একইস্থান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব মনোরম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, খানজাহান আলীর মাজার ও ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অনেক দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন স্পট রয়েছে, যা এতদিন উত্তাল পদ্মানদী পেরিয়ে যাতায়াতের অসুবিধার কারণে জমে ওঠেনি। পদ্মাসেতুর মেলবন্ধন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে যেমন নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, একইভাবে সেখানে শিল্পায়নে নতুন নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতেও অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে।
পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা, তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পেরেছে। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারছে তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এ অঞ্চলের সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বেড়েছে। বেড়েছে কর্মসংস্থান। এসব জেলার মানুষের আয়-রোজগার ও জীবনের মান বাড়ার প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ৩.৫ শতাংশ বাড়বে। আর দেশের জিডিপি বাড়বে অন্তত আরো ১.২৬ শতাংশ। ট্রান্স-এশিয়ান রেল ও সড়ক এই সেতুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে। এডিবি বলছে, ২০৫০ সালে ৬৭ হাজার যান চলাচল করবে এই সেতু দিয়ে। জরিপে আরো বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই পাঁচ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুবিধা পাবে এই সেতুর কল্যাণে। আঞ্চলিক দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশেরও বেশি হারে কমবে। অর্থাৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথে আমাদের যাত্রা আরো ত্বরান্বিত হবে। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
আগে যেখানে মাওয়া-জাজিরা ফেরিঘাটে পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে হতো, এখন তা মাত্র ১০ মিনিটেই পার হওয়া যাচ্ছে। পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় থেকে শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে জমির মূল্য বেড়ে চলেছে। হাজার হাজার বেসরকারি ও কর্পোরেট উদ্যোক্তা বিভিন্ন সেক্টরে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। সেইসাথে সরকার এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তত্ত্বাবধানে ১৭টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে পরিকল্পিত ইকোট্যুরিজম পার্ক এবং মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন পরিকল্পনা সেখানে লাখো মানুষের নতুন কর্মসংস্থান ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলছে।
পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে টার্গেট করে নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মাসেতুর সাথে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সংযোগ সড়ক মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন, প্রশস্তকরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে করে বাগেরহাট, সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় নতুন পর্যটন সম্ভাবনা শুধু দেশীয় দর্শনার্থীদেরই আকৃষ্ট করেনি, আন্তর্জাতিক পর্যটনেরও অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রেল সংযোগ এই উদ্যোগ ও সম্ভাবনাকে তরান্বিত করবে, এ বিশ্বাস আমাদের দৃঢ়।

লেখক: পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ; চেয়ারম্যান, নিপা গ্রুপ ও কেসি ফাউন্ডেশন।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।