ফিলিস্তিনিদের কান্না শুনতে কি পাও?

Daily Inqilab খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী

২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম

বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘উড়ে এল চিল, জুড়ে নিল বিল।’ তেমনি ফিলিস্তিনের গাজা গিলে নিল ইসরাইল। মর্মান্তিক! বেদনাদায়ক, ফিলিস্তিনের আর কী অবশিষ্ট রইলো? শুরু করতে চাই ‘মসজিদুল আকসা’ হতে। কোরআনে বলা হয়েছে: (আল্লাহ) পবিত্র, যিনি স্বীয় বিশিষ্ট বান্দা মুহম্মদ (সা.)-কে রাতারাতি মসজিদে হারাম (কাবা শরীফ) হতে মসজিদে আকসা (বাইতুল মোকাদ্দাস) পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, যার চতুর্দিককে (সিরিয়াব্যাপী) আমি নানাবিধ বরকতময় করে রেখেছি, উদ্দেশ্য, আমি তাঁকে আমার কুদরতের বিস্ময়কর কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় শ্রবণকারী, অতিশয় দর্শনকারী। সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির দ্বাদশ বর্ষের ২৭ রজব মেরাজ অনুষ্ঠিত হয়। হযরত উম্মেহানি (রা.) এর ঘর হতে বোরাকযোগে হযরত জিবরাইল (আ.) হুজুর (সা.)-কে মক্কা হতে মসজিদে আকসা এবং তথা হতে সিদরাতুল মোন্তাহা পর্যন্ত নিয়ে যান। অতঃপর হুজুর (সা.) একাকী রফরফযোগে আল্লাহতালার দরবারে উপস্থিত হন এবং এখানেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং রোজা ফরজ হয়। ফেরার পথে বেহেশত ও দোজখ ভ্রমণ করেন। মক্কা হতে মসজিদে আকসা নিমিষের মধ্যে চলে যাওয়া, সমস্ত নবী ও ফেরেশতাগণকে নিয়ে নামাজ পড়া এবং আলোচনা করাকে কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন বলা হয়েছে। মসজিদে আকসার একটি বিশেষ পবিত্র অংশের নাম ‘গম্বুজে ছাখরা’। মেরাজের রাতে রসূলুল্লাহ (সা.) এই পথেই তার মহান যাত্রা শুরু করেছিলেন। এখানে একটি সিন্ধুকে হুজুর (সা.) এর কদম মোবারক এবং একটি আলমারিতে তার তিন খানা কেশ মোবারক রক্ষিত আছে বলে বলা হয়ে থাকে।

কোরআন শরীফে ‘বাইতুল মোকাদ্দাসের’ উল্লেখ না থাকলেও মসজিদে আকসার সরাসরি উল্লেখ আছে। অবশ্য এটি মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল এবং তা কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে কা’বা মুসলমানদের কেবলা নির্ধারিত হলো, সূরা বাকারা দ্বিতীয় পারার শুরুতে তার বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ বলেন: ‘মানব মণ্ডলীর অন্তর্গত নির্বোধেরা অচিরেই বলবে যে, কিসে তাহাগিদকে তাদের সেই কেবলা হতে প্রত্যাবর্তিত করল, যার দিকে তারা ছিল? আপনি বলুন, পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই জন্য, তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথে পথ প্রদর্শন করেন এবং এইরূপে আমি তোমাদিগকে আদর্শ সম্প্রদায় করেছি, যেন তোমরা মানবগণের জন্য সাক্ষী হও এবং রসূলও তোমাদের জন্য সাক্ষী হন এবং আপনি যে কেবলার দিকে ছিলেন, তা আমি এতদ্ব্যতীত নির্দেশ করি নাই যে, যে ব্যক্তি রসূলের অনুসরণ করে, তা হতে যে স্বীয় পদদ্বয়ে পশ্চাদ্বর্তীত হয় এবং আল্লাহ যাদিগকে পথ প্রদর্শন করেছেন।’ আয়াত: ১৪২-১৫১ ।

মক্কী জীবনে রসূলুল্লাহ (সা.) বাইতুল মোকাদ্দাসকে কেবলা মনোনীত করেন। হিজরতের পর মদীনায় অবস্থানকালে রসূলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই কেবলা সম্বন্ধীয় অহীর জন্য উদগ্রীব থাকতেন। কেননা, মদীনায় নামাজ পড়ার সময় কাবা পশ্চাদ্ভাগে পড়ত বলে তিনি ব্যথিত ও মনক্ষুণ্ন হতেন এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.) প্রতিষ্ঠিত কাবার মহিমায় আকৃষ্ট হয়ে সেদিকে কেবলা নির্ধারিত হোক, সেটাই তার আগ্রহ ছিল। হুজুর (সা.) এর নিয়ম ছিল এই যে, যতক্ষণ না কোনো বিষয়ে অহী আসত তিনি আহলে কিতাবের নিয়মের অনুসরণ করতেন, যদি তা ইসলামের পরিপন্থী না হতো। বাইতুল মোকাদ্দাস সে সময় বনি ইসরাইলের জাতীয় কেন্দ্র ছিল, যারা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পুত্র হযরত ইসহাক (আ.) এর বংশধর ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দ্বিতীয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) এর বংশের জাতীয় কেন্দ্র ছিল কাবা। কাবা মুসলমানদের কেবলা হোক, এটা হুজুর (সা.)-এর একান্ত ইচ্ছা ছিল। অবশেষে হিজরী ২য় সনের শাবান মাসে হিজরতের ১৬/১৭ মাসের সময় কেবলা পরিবর্তন সম্পর্কিত উল্লিখিত আয়াতগুলি নাজেল হয় এবং হুজুর (সা.) নামাজরত অবস্থায় বাইতুল মোকাদ্দাস হতে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন। কেবলা পরিবর্তনের এই ঘোষণা ছিল মূলত এক বিরাট বিপ্লব। এই ঘোষণার পূর্বে মদীনার আশেপাশে বসবাসকারী ইহুদিরা গর্ব করত যে, বাইতুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের কেবলা। কিন্তু যখন কেবলা পরিবর্তন হয়ে যায়, তখন তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে যায় এবং তাদের ইসলাম বিরোধিতা তীব্র আকার ধারণ করে এবং সেই বিরোধ আজও তাদের মধ্যে নানাভাবে বিদ্যমান। ফিলিস্তিনের গাজা দখল সেই মনোভাবেরই আংশ!

বায়তুল মোকাদ্দাস বা প্রাচীন জেরুজালেম আদিকালে ফিলিস্তিনের রাজধানী ছিল। এর প্রাচীন নিদর্শনাবলী ও ইতিহাস যীশু খৃষ্টের তিন হাজার বছর পূর্বের সাথে জড়িত। যীশু খৃষ্টের এক হাজার বছর পূর্বে হযরত দাউদ (আ.) এই শহর অধিকার করেন। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত দাউদ (আ.) সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার পুত্র হযরত সুলায়মান (আ.) সেই মন্দির স্থাপন করেন। এই সম্পর্কে বাইবেলে মন্দির নির্মাণের জন্য ‘শলোমানের আয়োজন’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘আর দেখুন, আমি আপন ঈশ্বর সদা প্রভুর নামের উদ্দেশ্যে এক গৃহ নির্মাণ করিবার সংকল্প করিতেছি, কেননা, সদা প্রভু তদ্বিষয়ে আমার পিতা দায়ুদকে এই কথা বলিয়াছিলেন, আমি তোমার স্থানে তোমার যে পুত্রকে তোমার সিংহাসনে বসাইব, সেই আমার নামের উদ্দেশ্যে এক গৃহ নির্মাণ করিবে।’ মন্দির নির্মাণের জন্য লেবানন হতে কাঠ আনতে কত জন লোক নিয়োজিত ছিল সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘শলোমানের কথা শুনিয়া হীরম বড় আনন্দিত হইয়া কহিলেন, অদ্য সদা প্রভু ধন্য, যেহেতু তিনি দায়ুদকে জ্ঞানবান পুত্র দিয়া এই মহা জাতির অধ্যক্ষ করিয়াছেন। পরে হীরম শলোমানের কাছে লোক পাঠাইয়া কহিলেন, আপনি আমার কাছে যে কথা বলিয়া পাঠাইয়াছেন তাহা আমি শুনিলাম, আমি এরকম কাষ্ঠ ও দেবদারু কাষ্ঠ সম্বন্ধে আপনার সমস্ত অভীষ্ঠ সিদ্ধ করিব। আমার দাসগণ লেবানন হইতে তাহা নামাইয়া সমুদ্রে আনিবে, পরে আমি সাঁড় বাঁধিয়া সমুদ্র পথে আপনার নিরুপিত স্থানে তাহা খুলিয়া দিব, তখন আপনি তাহা গ্রহণ করিবেন এবং আমার বাটীর জন্য খাদ্যদ্রব্য যোগাইয়া আমার অভীষ্ট সিদ্ধ করিবেন। আর শলোমান রাজা সমস্ত ইসরায়েলের মধ্য হইতে আপনার কর্মমাধীন দাস সংগ্রহ করিলেন; সেই দাসদের সংখ্যা ত্রিশ সহস্ত্র। আর তিনি মাসিক পালাক্রমে তাহাদের দশ সহস্ত্র জনকে লেবাননে প্রেরণ করিতেন।’ তাতে আরো বলা হয়েছে, মিশর হতে ইসরাইলি সন্তানদের বের হয়ে আসার পর চারশ’ আশি বছরে, ইসরাইলের উপরে শলোমানের রাজত্বের চতুর্থ বছরের সিবমাসে অর্থাৎ দ্বিতীয় মাসে শলোমান সদা প্রভুর উদ্দেশ্যে গৃহ নির্মাণ আরম্ভ করলেন। এই গৃহ কত বড় ছিল এবং এর নির্মাণ কার্য কবে শেষ হয় তার বর্ণনা এইরূপ, ‘আর শলোমানের সত্তর সহস্ত্র ভারবাহক ও পর্বতে আশি সহস্ত্র প্রস্তর ছেদক ছিল। তদ্ভিন্ন শলোমনের কর্মকারী লোকদের উপরে তিন সহস্ত্র তিনশত প্রধান কার্যাধ্যক্ষ ছিল। শলোমান রাজা সদা প্রভুর উদ্দেশ্যে যে গৃহ নির্মাণ করিলেন, তাহা দীর্ঘ ষাট হস্ত, প্রস্থে কুড়ি ও উচ্চে ত্রিশ হয়। আর সেই গৃহের মন্দিরের সম্মুখে এক বারান্দা ছিল, তাহা গৃহের প্রস্থানুসারে কুড়ি হস্ত দীর্ঘ ও গৃহের সম্মুখে দশ হস্ত প্রস্থ। আর গৃহের নিমিত্ত তিনি জাল বন্ধ বাতায়ন প্রস্তুত করিলেন। আর তিনি গৃহের ভিত্তির গাত্রে চারিদিকে থাক করিলেন; এবং চারিদিকে কুঠুরী নির্মাণ করিলেন। তাহার নিচের থাক পাঁচ হস্ত প্রস্থ ও মধ্যের থাক ছয় হস্ত প্রস্থ এবং তৃতীয় থাক সাত হস্ত প্রস্থ, চতুর্থ বৎসরের সিবমাসে সদা প্রভুর গৃহের ভিত্তিমূল স্থাপিত হয়। আর একাদশ বৎসরের বুল মাসে অর্থাৎ অষ্টম মাসে নিরুপিত সমস্ত আকারানুসারে সর্বাংশে গৃহের নির্মাণ সমাপ্ত হয়, তিনি ঐ গৃহের নির্মাণে সাত বৎসর ব্যাপৃত ছিলেন।’ পবিত্র বাইবেল (পুরাতন ও নূতন নিয়ম); রাজাবলি : পৃ. ৫২৯-৫৩২)।

‘শলোমানের মন্দির’কে ‘হাইকলে সুলাইমানী’ বলা হয়। জেরুজালেমে অবস্থিত এই হাইকলই মুসলমানদের নিকট মসজিদে আকসা নামে পরিচিত। আর এই মসজিদে আকসাকে কেন্দ্র করেই যুগে যুগে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে এবং কেউ জানে না ইতিহাসের এই ধারা কতকাল অব্যাহত থাকবে। এই প্রাচীনতম এবাদতগাহ মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদী সকলের কাছেই অতি পবিত্র ও সম্মানিত।

‘মসজিদুল হারাম’ থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত হুজুর (সা.) এর বোরাকযোগে মেরাজের উদ্দেশ্যে যাওয়ার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই দুইটি মসজিদের মধ্যে কোনটি আগে নির্মিত এ সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও পবিত্র কোরআন, সহীহ হাদীস এবং সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্র থেকে একান্তরূপে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদ মক্কা শরীফে অবস্থিত মসজিদুল হারাম। আর এই মসজিদুল হারামের পরই বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল আকসা। পবিত্র কোরআনে মসজিদুল হারাম সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে, মানব জাতির জন্য ‘বাককা’ বা মক্কায় সর্ব প্রথম যে ঘর নির্মিত হয়েছে, তা বিশ্ববাসীর জন্য বরকত ও হেদায়েত স্বরূপ। (সূরা আল এমরান, আয়াত : ৯৫) এই আয়াতের শানে নুজুল বা অবতীর্ণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, জেরুজালেমে অবস্থিত এবাদতগাহ মসজিদুল আকসার পরিবর্তে মক্কার পবিত্র কা’বা গৃহ মুসলিম জগতের ‘কেবলা’ নির্ধারিত হওয়ায় ইহুদিরা আপত্তি করেছিল। সেই আপত্তির উত্তরে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। তাদেরকে বলে দেয়া হলো যে, কাবা গৃহ জেরুজালেমস্থিত এবাদতগাহের বহু পূর্ববর্তী। হযরত ইব্রাহীম (আ.) মক্কার এই জগদ্বিখ্যাত পুণ্যধামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পক্ষান্তরে জেরুজালেমের উপাসনাগৃহ তার বহু পরে হযরত সুলাইমান (আ.) কর্তৃক নির্মিত হয়। সুতরাং জেরুজালেমের উপাসনালয় অপেক্ষা মক্কার কাবাগৃহ মুসলিম জগতের লক্ষ্যস্থল হবার সমধিক উপযোগী। কারণ, এর প্রাচীনতা, গৌরব ও মাহাত্ম্য জেরুজালেম অথবা জগতের যে কোন উপাসনালয় অপেক্ষা বহুগুণে অধিক। আদি মানব হযরত আদম (আ.) আদিগৃহ কাবার প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পুনর্নির্মাণ কার্য সম্পন্ন করেন। তৎপর এই গৃহের বহু সংস্কার ও সংযোগ সাধিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবে কাবা ও মসজিদে আকসার মধ্যে কত বছরের ব্যবধান এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের মনেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। বোখারী ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীস হতে জানা যায় যে, হযরত আবুজর গিফারী (রা.) নবী করীম (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, পৃথিবীতে কোন মসজিদ সর্ব প্রথম নির্মিত হয়েছে? উত্তরে হুজুর (সর.) বললেন, মসজিদুল হারাম। অতঃপর নবী করীম (সর.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, এর পরে কোন মসজিদ নির্মিত হয়? উত্তরে রসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এরপরে মসজিদুল আকসা নির্মিত হয়। হুজুর (সা.)-কে প্রশ্ন করা হয়, দুই মসজিদের নির্মাণে কত বছরের ব্যবধান ছিল? উত্তরে নবী করীম (সা.) বললেন, দুই মসজিদের নির্মাণে চল্লিশ বছরের ব্যবধান ছিল।

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মসজিদুল হারাম যদি হযরত আদম (আ.) নির্মাণ করে থাকেন তাহলে মসজিদুল আকসার নির্মাতাও তিনিই ছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ এই অভিমতও ব্যক্ত করেন যে, কাবা শরীফ হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) প্রথম নির্মাণ করেছেন। সুতরাং মসজিদে আকসাও তাঁরা নির্মাণ করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১২৭ নং আয়াতটি দলিল হিসাবে পেশ করা হয়ে থাকে। আয়াতটি হচ্ছে: ‘স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন ইব্রাহীম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) কাবা গৃহের ভিত্তি উত্থিত করেছিলেন। তাঁরা দোয়া করেছিলেন, হে পরোওয়ারদিগার। আমাদের এই পরিশ্রম কবুল করুন, আপনি সর্বজ্ঞাতা, সর্বশ্রোতা।’

মসজিদুল হারামের পর মসজিদে আকসা হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে প্রাচীনতম মসজিদ। কারো কারো মতে, যার পূর্ব নাম ছিল হাইকলে সুলাইমানী। বস্তুত মন্দিরকে হাইকল বলা হয়। হযরত সুলাইমান (আ.) তার পিতা হযরত দাউদ (আ.) এর ইচ্ছানুযায়ী ‘ছাহয়ুন” পর্বতে এই বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। যার আংশিক বর্ণনা প্রচলিত বাইবেল থেকে পূর্বে দেয়া হয়েছে। তিনি বাইতুল মোকাদ্দাস শহরটিও সুন্দরভাবে গড়ে তুলেছিলেন। বিভিন্ন ইতিহাস হতে জানা যায় যে, হযরত সুলাইমান (আ.) জ্বিন দ্বারা মসজিদে আকসা মেরামত করেছিলেন। ইসলামের পূর্ব পর্যন্ত মসজিদে আকসা বহুবার ধ্বংসের সম্মুখীন হয় এবং বহুবার এর সংস্কার সাধন করা হয়। উল্লেখ্য, হযরত ঈসা (আ.) এর সময় ফিলিস্তিন রোমানদের রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর খৃষ্টীয় ৬৬ সালে ইহুদিরা রোম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, রোমানরা জেরুজালেমের উপর আক্রমণ চালায় এবং তা ধ্বংস করে দেয়। ফলে মসজিদুল আকসা ধ্বংস হয়ে যায় এবং ইহুদিদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এর পর মসজিদুল আকসা আর পুনর্নির্মিত হয়নি, যতদিন না মুসলমানগণ জেরুজালেম জয় করেন। ৬৩৬ খৃষ্টাব্দে হযরত উমর (রা.) বাইতুল মোকাদ্দাস অবরোধ করেন এবং এই সময় তিনি মসজিদে উমরের ভিত্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এই মসজিদই ‘মসজিদে আকসা’ নামে অভিহিত হতে থাকে বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। ৬৪০ খৃষ্টাব্দে মসজিদে আকসার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এই সময় থেকে মুসলমানগণ মসজিদে আকসার হেফাজত করে আসছিলেন। খেলাফতে ফারুকীর পর কয়েক বছর পর্যন্ত বাইতুল মোকাদ্দাস সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। বনি উমাইয়ারা ক্ষমতাসীন হলে এবং মারওয়ানের সরকার গঠিত হলে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে বিভিন্ন এলাকার কারিগর ডাকা হয় এবং মসজিদে আকসাও ‘গম্বুজে সাখরা’র নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। বনি উমাইয়ার পর আব্বাসী খলীফা মামুনের যুগে মসজিদে আকসার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে, তিনি তার মেরামত ও সংস্কার করেন। অতঃপর ফাতেমী ও সেলজুকীদের আমলে ক্রসেডের যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা বাইতুল মোকাদ্দাস দখল করে নেয়। অতঃপর গাজী সালাহউদ্দীন, হিজরী ৫৮৩ সালে শহরটি পুনরায় দখল করেন। সেই থেকে প্রায় আটশ বছর অর্থাৎ ইহুদিগণ কর্তৃক বাইতুল মোকাদ্দাস দখলের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের শাসন আমলে মসজিদুল আকসার জিয়ারত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই বৈধ ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে বাইতুল মোকাদ্দাস ও মসজিদে আকসা ইসরাইলের অধিকারে চলে যায় ।

১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট মোতাবেক ৮ জমাদিউস সানি ১৩৮৯ হিজরি, ইহুদিরা মসজিদে আকসায় অগ্নিসংযোগ করে এবং এর ফলে মসজিদের যে মিম্বরটি ধ্বংস হয় তা ছিল সুলতান নূরুদ্দীন মাহমুদ জঙ্গী (৫৬০ হি. ১১৬৪ খৃ.) নির্মিত। তিনি এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। তার পুত্র সুলতান ইসমাইল (৫৭০ হিজরি, ১১৭৪ খৃ.) সমাপ্ত করেন। সুলতান সালাহউদ্দীন আইউবী মসজিদে আকসার মিম্বর ও মেহরাব ঐ অবস্থায় রাখেন এবং ইহুদিদের হাতে সেই অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী নির্মিত মসজিদে আকসার মিম্বরের বিভিন্ন দিকে বেশ কিছু প্রস্তরলিপি ছিল। সুলতানের পক্ষ থেকে একটি লিপিতে ৫৬৪ হিজরীর উল্লেখ ছিল। খতীবের ডান দিকে মেহরাবে সূরা নূরের ৩৬ ও ৩৭ আয়াত এবং বাম দিকে মিম্বরের পশ্চিম দিকে সূরা তওবার ১৮নং আয়াত মিম্বরের বামে সূরা নহলের ৯০-৯২ আয়াত লেখা ছিল। এতদ্ব্যতীত মেহরাব ও মিম্বর নির্মাণকারীদের নাম-তালিকা এবং নির্মাণের হিজরি সনও লেখা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ইহুদিরা এই ঐতিহ্যমণ্ডিত পবিত্রতম মসজিদে আকসায় ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে সুলতান নূরুদ্দীনের স্মৃতি বিজড়িত মেহরাব মিম্বর ধ্বংস করে ফেলে।

ইয়াসির আরাফাতের ঐতিহাসিক বক্তব্য: ‘বায়তুল মোকাদ্দাসের এক সুযোগ্য সন্তান হিসাবে আমি আজ দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই যে, মানবীয় ভ্রাতৃত্বের এই অতুলনীয় নমুনাকে (মসজিদুল আকসাকে) পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আমরা তা ফিরিয়ে আনবই। ফিলিস্তিনকে কখনই জাতিসংঘের হাতে তুলে দেওয়া হবে না।’ ১৯৭৪ সালের ১২ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দান করার সাথে সাথে সেদিন ইয়াসির আরাফাত বিশ্ববাসীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এক হাতে শান্তির পাত্র অন্য হাতে বিপ্লবের বন্দুক নিয়ে হাজির হয়েছি। এখন এটা আপনাদের দায়িত্ব যেন আপনারা আমার হাত হতে এই শান্তির পাত্র পতিত হতে না দেন। আল্লাহ, তুমি মুসলমানদের প্রথম কেবলা বিজড়িত এই মহাপবিত্র মসজিদে আকসাকে তার পূর্ব মর্যাদায় সমুন্নত কর। পাঁচ হাজার আম্বিয়ায়ে কেরামের কবর অধ্যুষিত এবং মেরাজের স্মৃতি বিজড়িত এই মহাপবিত্র মসজিদে আকসাকে তার পূর্ব মর্যাদায় সমুন্নত কর।’ আল আকসা মুক্ত করা সময়ের চাহিদা, মুসলিম উম্মাহর প্রাণের ডাক, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আলোচনার মাধ্যমেই মুসলমানদের প্রথম কেবলা পুনরুদ্ধার করতে হবে। ফিলিস্তিনের গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। (চলবে)


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে
সারবাহী জাহাজে ৭ খুন : দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে
গণতন্ত্র ও সাম্যের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ রুখে দেয়া আর সম্ভব নয়
রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
আরও

আরও পড়ুন

শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক

শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি

রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও

রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও

আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: কাকরাইল চার্চে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: কাকরাইল চার্চে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০

ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০

কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই

কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার

কারখানায় আগুন, পরিদর্শনে  হাতেম

কারখানায় আগুন, পরিদর্শনে হাতেম

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মোটর থেকে বৈদ্যুতিক তার খুলতে প্রাণ গেল যুবকের

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মোটর থেকে বৈদ্যুতিক তার খুলতে প্রাণ গেল যুবকের

৫ জানুয়ারি থেকে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু

৫ জানুয়ারি থেকে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু

নাচোলে পিয়ারাবাগানে এক গৃহবধূ খুন

নাচোলে পিয়ারাবাগানে এক গৃহবধূ খুন

সিদ্দিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুতায়িত, দুই  শ্রমিকের মৃত্যু

সিদ্দিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুতায়িত, দুই শ্রমিকের মৃত্যু

দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরছেন কায়কোবাদ

দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরছেন কায়কোবাদ

বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই

বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই

গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা

গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা

আসছে ভিভোর নতুন ফ্ল্যাগশিপ, থাকছে জাইস টেলিফটো প্রযুক্তি

আসছে ভিভোর নতুন ফ্ল্যাগশিপ, থাকছে জাইস টেলিফটো প্রযুক্তি

শেরপুরে নানা আয়োজনে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বড়দিন উদযাপিত

শেরপুরে নানা আয়োজনে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বড়দিন উদযাপিত

ধোবাউড়ায় নেতাই নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে

ধোবাউড়ায় নেতাই নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে

সাংবাদিক শাহ আলম চৌধুরী আর নেই

সাংবাদিক শাহ আলম চৌধুরী আর নেই

ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের কথা ভুলে গিয়ে লুটপাট করে: ডা. শফিকুর রহমান

ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের কথা ভুলে গিয়ে লুটপাট করে: ডা. শফিকুর রহমান