শিক্ষার অর্থ ও লক্ষ্য পাল্টে যাচ্ছে
৩১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
আদিযুগে শিক্ষা ছিল অনিয়মতান্ত্রিক। মানুষ প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহের সময় যা কিছু জ্ঞান লাভ করত তাই শিক্ষা রূপে গণ্য হতো। সে সময় জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথেই ছিল শিক্ষার হাতছানি। মানুষ তার জীবনের কর্মোপলদ্ধির দ্বারাই শিক্ষা লাভ করত। কিন্তু তারা সেই উপলদ্ধিকে শিক্ষারূপে অনুধাবন করল অনেক পরে।
বিভিন্ন যুগে এই শিক্ষার মাহাত্ম্য নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, মনোবিদ এবং মহাপুরুষরা আলোচনা করে গেছেন। এতে প্রায় প্রত্যেকের মতেই শিক্ষা হলো এমন এক সত্তা, যা আমাদের জীবন নির্বাহের পরিপূরক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেহেতু আলোচনার বিষয়ই ‘শিক্ষা’, তাই এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থও জানা দরকার। শিক্ষা এসেছে শাস্ ধাতু থেকে, যার অর্থ শাসন করা, নিয়ন্ত্রিত করা, আবার ‘শিক্ষা’র সমার্থক শব্দ বিদ্যা এসেছে, ‘বিদ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ জানা বা জ্ঞান আহরণ করা। শিক্ষার অর্থ হল: জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন, যা প্রথাগত শিক্ষার দ্বারা সংগঠিত হয়। অপরদিকে শিক্ষার ব্যাপক অর্থ হল: শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক অর্থাৎ সকল রকম সম্ভাবনার বিকাশ সাধন করা। বিভিন্ন আঙ্গিকে শিক্ষার অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিক্ষার দ্বারা শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করে। আর এই জ্ঞানই উন্নত জীবনযাপনের সহায়ক হয়। কিন্তু শিক্ষার সঠিক মাহাত্ম্য উপলদ্ধি করতে হলে শিক্ষা শব্দের যথার্থতা সঠিকভাবে অনুধাবন প্রয়োজন।
পরিতাপের বিষয় বর্তমানে মানুষের সুস্থ মানসিকতার অভাবের ফলে শিক্ষা তার মূল রূপ হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, শিক্ষা আত্মোপলদ্ধির উপকরণ না-থেকে, বর্তমানে একটি যান্ত্রিক উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার মূল আদর্শই আজ অপসারিত হচ্ছে। শিক্ষা শুধু পুঁথিগত জ্ঞানার্জন করাই নয় এবং শিক্ষান্তে জীবিকার্জন করাই নয়, শিক্ষা একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষা একটি শিক্ষার্থীর সঠিক জ্ঞান সঞ্চারের দ্বারা প্রকৃত মানব সম্পদে পরিণত করে। বিভিন্ন যুগে মহাপুরুষগণ নানাভাবে শিক্ষার দ্বারা মানুষের উন্নত মানসিকতা প্রতিস্থাপনের দ্বারা জীবন গঠনের বিভিন্ন উপায় নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু মানুষের আত্ম-অহঙ্কার, মনুষ্যত্ববোধের অপসারণ শিক্ষার মূল যে কাঠামো তার পরির্তনের প্রয়াস চালিয়েছে।
শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে এক অন্যরূপে বর্তমানে আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাকে বিদেশে প্রেরণ করা। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইংরেজি শিক্ষা আবশ্যক। আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে বিদেশ যাক, পড়ালেখা করুক, প্রতিষ্ঠিত হোক, কেউবা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে আসুক অন্যদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলুক। আমি নিজে একজন ভ্রমণ পিয়াসু মানুষ, সুযোগ পেলেই ভ্রমণ করতে যাই বিভিন্ন দেশে। আমি লক্ষ করেছি, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের গ্র্যাজুয়েট ছেলে-মেয়েরা চাকরি করে যেখানে বেতন পায় ১০/১৫ হাজার টাকা, একই পদে চাকরি করে প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলংকার ছেলেমেয়েরা পায় ৩০/৪০ হাজার টাকা। তার মুখ্য কারণ আমাদের ছেলে-মেয়েরা পেটের তাগিদে ঐসব দেশে যায়, কিন্তু ইংরেজি না জানার কারণে তারা পিছিয়ে থাকে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। বিষয়টির উপর গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমরা শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষাদানের কথা ভুলেই যাব। মাতৃভাষার দ্বারা শিশুদের সঠিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুনতে অবাক লাগে, যখন অভিভাবকরা গর্ব করে বলে থাকেন, আমার ছেলেটা/মেয়েটা একেবারেই বাংলা পড়তে পারে না। শিক্ষা মানেই কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা দিয়ে বিদেশে প্রেরণ করা নয়। শিক্ষা হল শিক্ষার্থীদের উন্নত মানসিকতা দানের মাধ্যম। আর শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া, যা জন্মের মুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে পারে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন: ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মনের সৃষ্টিই হল শিক্ষা।’
বর্তমানে শিক্ষার সঠিক মূল্য হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষিত অভিভাবকমহল তাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না-করে যন্ত্রমানবে পরিণত করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিশুটি সৎ, সাহসী, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষে পরিণত হচ্ছে না, যা আমাদের কাছে হতাশাজনক। শিক্ষার মূল যে লক্ষ্য আত্মপোলদ্ধি, সুপ্ত সত্তার বিকাশ এসব বর্তমানে সঠিকভাবে ফলপ্রসূ হয় না। রুশো বলেছেন: শিক্ষা হল শিশুর স্বতঃস্ফুর্ত আত্মবিকাশ, যা মানবসমাজের সমস্ত কৃত্রিমতাবর্জিত একটি স্বাভাবিক মানুষ তৈরিতে সহায়ক।
আমার মনে সর্বদাই এ প্রশ্ন, কেন আমাদের অভিভাবকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত নৈতিক আদর্শের প্রতীক করে তুলতে সক্ষম নন? নিশ্চয়ই আমরাও বর্তমানে বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে সঠিক লক্ষ্য থেকে অপসারিত হচ্ছি, যার ভবিষ্যৎ পরিণাম অন্ধকারময়।
সবাই যদি উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এই দেশ ত্যাগ করে, তবে আমাদের জন্মভূমির উন্নতির জন্য কে অগ্রসর হবে? প্রতিবছরই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সাক্ষাৎকারে বলে থাকে, ‘আমরা আমাদের দেশের জন্য কাজ করতে চাই। কেউ কেউ বলে, আমি ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চাকরি চাই।’ কিন্তু অনেকেই বলতে চায় না, আমি পড়াশোনা করে মানুষ হয়ে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে চাই। অনেকেই অনেক কথা বলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা বলে, তাতে কি সে টিকে থাকে?
বর্তমানে আমরা প্রায়শই লক্ষ করি যে, অনেকে বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসতেই চায় না। আবার অনেকেই বিদেশ থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়ে দেশে এসে বিভিন্ন ব্যাংকে বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে চাকরি করে। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের ভাবনাটা সর্বদাই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তাই এক্ষেত্রে সরকারকে মানুষ জোগানোর জন্য উন্নত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। বর্তমানে প্রকৃত শিক্ষার মূল্য মানেই অর্থ। কিন্তু সঠিক অর্থোপলদ্ধির জন্য প্রকৃত শিক্ষার হাতছানি প্রয়োজন। আমরা কিন্তু নাগরিকরা যে-কোনোভাবেই প্রকৃত সত্যটা অনুধাবন করেও এগিয়ে আসতে ভয় পাই। যদি শিক্ষাকে এখন থেকেই সৎ-প্রচারের উদ্দেশ্যে কার্যকর করা না-হয় তবে এমন ভবিষ্যতের সম্মুখীন হব, যখন মানুষের কাছে শিক্ষা অর্থহীন হয়ে পড়বে। শিক্ষা প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে চায়, শিক্ষা এর সার্থকতার পেছনে যথেষ্টই প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে।
সকল অভিভাবকের কাছে অনুরোধ, তারা যেন ছেলেময়েদের প্রকৃত শিক্ষাদান করার চেষ্টা করেন, যে শিক্ষার দ্বারা শিক্ষার্থীর সম্ভাবনা প্রকাশের পাশাপাশি উন্নত চরিত্র গঠিত হয়। বর্তমানে প্রায়শই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছেলেমেয়েদের দ্বারা কৃত বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকি। এমনকি ছেলেমেয়েদের অর্থের বিনিময়ে সামগ্রী বিপণনের বিজ্ঞাপনও করছে, অভিভাবকদের সরলতা এবং অসতর্কতার সুযোগে। প্রারম্ভিককালে শিক্ষা মানুষের উন্নত জীবনযাপনের সহায়ক উপাদান হিসাবে মান্য করা হত। কিন্তু বর্তমানে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগে প্রকৃত শিক্ষার অর্থ লুপ্তপ্রায়।
আরেকটা বিষয় ভাবতে অবাক লাগে যে, শিক্ষার মতো একটি পবিত্র উপাদানের মধ্যে বর্তমানে শিক্ষাঙ্গণগুলোতে ঢুকে পড়েছে রাজনীতির কুপ্রভাব। আমরা জানি, আজকের ছাত্ররাই ভবিষ্যতের নাগরিক, উন্নত সমাজ গঠনের মানদণ্ড। এর জন্য রাজনীতি আবশ্যক। রাজনীতিই তাদের নেতৃত্ব গঠনে সহায়তা করে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতির নামে চলছে হানাহানি, দ্বন্দ্ব, যা আমরা কোনটাই ভালো মনে করি না। রাজনীতির বেড়াজালে আকৃষ্ট হবার ফলে ছেলেমেয়েদের জ্ঞানপিপাসা লুপ্ত হয়ে বিরাজ করছে হানাহানি, মারামারি ইত্যাদি। প্রকৃত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আলোকিত করবে, তাকে সমাজের সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা, এটাই আমাদের চাহিদা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শম্ভুর ধরা পড়ায় এলাকায় আনন্দের বন্যা
রাজবাড়ীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
লিসান্দ্রো মার্তিনেজকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পাচ্ছেনা আর্জেন্টিনা
খালাস পেলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক এপিএস অপু
পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে ব্যাপক তল্লাশি
আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ১৮.৪৬ বিলিয়ন ডলার
অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই দুঃশাসনের চিহ্ন রাখা উচিত নয় : রিজভী
পার্লামেন্টে ক্ষমা
ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তায় নতুন প্রহরী: রোবট কুকুর!
লুকিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করায় মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা থেকে বহিস্কার
মাকে হত্যা করে লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখা ছেলে গ্রেফতার
সীমান্তে ৪ বাংলাদেশী নারী আটক
গুলি বর্ষণকারী ৭৪৭ পুলিশ শনাক্ত গ্রেফতারের উদ্যোগ নেই
সিলেটে মতবিনিময় সভা করলো নেজামে ইসলাম পার্টির
স্বামী স্ত্রীকে শর্ত লাগিয়ে তালাক দেওয়ার পর শর্ত উঠিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে।
আন্তঃনগর ট্রেনের সময় পরিবর্তন করুন
জনপ্রশাসনে মেধাশূন্যতা : কারণ ও প্রতিকার
ভারতীয় হেজিমনি ও আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী রাজনীতি
বিতর্ক পরিহার করতে হবে