জনপ্রশাসনে মেধাশূন্যতা : কারণ ও প্রতিকার
১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের যেকোনো প্রশাসনিক সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে। সরকারের প্রশাসনিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার প্রশাসন। সরকারি প্রশাসন সেই সেবার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। সরকার তার প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করেই জনগণের সকল প্রকার প্রশাসনিক সেবা প্রদানের কাজ করে। সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারও তার নাগরিকদের সকল প্রকার প্রশাসনিক অধিকার নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সৃষ্টি হওয়া সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বর্তমান নাম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিগত আওয়ামী সরকার ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল এই মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যা সারাদেশের প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে। জনগণের প্রশাসনিক সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি এই সংস্থার ওপরই নির্ভর করে। প্রজাতন্ত্রের গণকর্মচারি নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করা এর প্রধান কাজ । এছাড়া, এ সমস্ত কাজ সূচারু রূপে সম্পন্নের জন্য গণকর্মচারি নিয়োগ ও চাকরিবিধি প্রণয়ন এ মন্ত্রণালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দেশে জনগণের জন্য জনবান্ধব রাষ্ট্র গঠনে সরকারগণ সুপ্রশাসনিক সহায়তায় উচ্চশিক্ষিত, মেধাসম্পন্ন, উন্নত ও প্রযুক্তিনির্ভর জনপ্রশাসন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এদেশে গুণী, চৌকষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রশাসনে সুশাসন নিশ্চিতকরণ ছিল একটি স্বপ্ন। গণমানুষের সেই স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে , কেন প্রশাসনে সুশিক্ষিত, মেধাবি ও নৈতিক মানসম্পন্ন কর্মকর্তা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না? দিনে দিনে প্রশাসনে মেধাশূন্যতার বিষয়টি যেন আরো প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্থাপন বা জনপ্রশাসনের কার্যকলাপ পর্যালোাচনা করে দেখা যায়, মেধাহীন প্রশাসনের জন্য মূলত: দলীয়ভিত্তিক নিয়োগ, বদলী ও পদোন্নতি বিশেষভাবে দায়ী। দায়ী দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের তৎকালিন সরকার সর্বপ্রথম প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি নিয়োগে লাগামহীন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার সূচনা করেন । এরপর পরবর্তী প্রায় সকল সরকার কমবেশি নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। বিগত সাড়ে পনের বছরে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী সরকারের আমলে প্রশাসনকে দলীয়করণ অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তারা একদিকে দেশে উন্নত ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের রঙিন হাওয়াই মিঠাই দিয়ে খুশি করার মতো পাশের হার ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দিয়েছে। নকল ও প্রশ্ন ফাঁসের মতো গুরুতর অন্যায়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, পঙ্গুত্ববরণের শিক্ষা ব্যবস্থা। ফলে বিগত বছরগুলোতে দেশে একটি চরম মেধাহীন শ্রেণি গড়ে উঠেছে। সচেতন শিক্ষিত সমাজ ও শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা অভিভাবক সকলেই এদেশের অন্ধকারময় শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। যে শিক্ষায় আমাদের জাতি শিক্ষিত হচ্ছে বলে আমরা বুলি উড়াচ্ছি, তা কোনভাবেই উচ্চতর মানের শিক্ষার জন্য নয়। যে কারণে দেশি এবং বিদেশি যেকোনো প্রতিযোগিতায় তারা কোথাও স্থান করে নিতে পারছে না। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় ও নীতি-নৈতিকার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। ‘টাকা যেমন টাকা আনে’, তেমনি উন্নত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকরাও ভালো মানের জাতি উপহার দিতে পারে। সেই উচ্চমানের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষক আজ কোথায়? ফলে প্রশাসনের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেধাবী ও উন্নত চরিত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রায়ই শোনা যায়, সরকারের প্রশাসনিক মূল চালিকাশক্তি জনপ্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা নির্বাচনের পরীক্ষায় অধিকাংশই ফেল করেন। প্রমোশন দেয়ার মতো যোগ্য কর্মকর্তা কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০১১ সালের ৩০ জুলাই গুরুতর এ বিষয়টি কিছু কিছু গণমাধ্যমে এসেছিল। সে সময় ডিসিদের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনে প্রশাসনের কাজে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রায় দুইশ’ সমস্যার কথাও উঠে আসে। বিষয়গুলো খুবই দুঃখজনক ও পরিতাপের। জানা গেছে, ইংরেজিসহ অন্যান্য বিদেশি ভাষায় পারদর্শিতা না থাকায় চিঠিপত্র লেখা বা প্রাপ্ত চিঠিপ্রত্রের জবাব দিতে দপ্তরগুলোকে হিমশিম খেতে হয়। মার্জিত ও মানসম্পন্ন ড্রাফটকারী খুঁেজ পাওয়া যায় না। এমন অভিযোগও পাওয়া যায় যে, সচিবালয়ের কোন কোন দপ্তরে ইংরেজি পত্রের ড্রাফট তৈরিতে কনসালট্যান্ট পর্যন্ত ভাড়া করতে হয়। বিষয়টি স্পর্শকাতর ও উদ্বেগের। সাধারণত যেসব মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন দেশ ও বিদেশি সংস্থার সাথে দ্বিাক্ষিক অর্থনৈতিক চুক্তির বিষয়ে কাজ করতে হয়, তাদের ক্ষেত্রে এমন হলে তা বাংলাদেশের স্বার্থহানির আশংকাকে বাড়িয়ে দেবে। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আমরা আগেই জেনেছি, জনপ্রশাসনে মেধাশূন্যতার প্রত্যক্ষ কারণ, দলীয়ভিত্তিক নিয়োগ এবং ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া। পদায়ন ও পদোন্নতিতেও একই অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কাজের মূল্যায়ন, অতীত অভিজ্ঞতা, জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত ও মন্তব্যে জানা যায়, উপরোক্ত কারণ ছাড়াও আরো বেশ কিছু কারণে জনপ্রশাসনে মেধাশূন্যতার দিকটি প্রকট হচ্ছে। যেমন অযোগ্যতা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত পছন্দ, স্বজনপীতি ও তোষণনীতিতে পদ-পদবি প্রদান, প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক মতাদর্শের হওয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে ওএসডি করে রাখা, গতানুগতিক প্রশিক্ষণের বদলে উন্নত ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ঘাটতি থাকা, পদায়নের ক্ষেত্রে জেষ্ঠ্যতা চরমভাবে লঙ্ঘন, বেশি বেশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অপছন্দের লোকদের জন্য অমর্যাদাকর বৈষম্য বঞ্চনা সৃষ্টি, পদ ছাড়া পদোন্নতি, পদোন্নতি-পদায়নের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক কাঠামো ‘পিরামিড’ আকৃতি অনুসরণ না করা, উপযুক্ত পদে যেতে ঘুষ বিনিময়, দুর্নীতি, সীমাহীন অনৈতিক কর্মকা-ে প্রশ্রয় দেয়ার কারণে কারো পক্ষে নিজেকে প্রশাসনিক সুশাসনে আর সম্পৃক্ত রাখতে না পারা, সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড বা এসএসবি’র অনিয়ম, কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর), গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, দক্ষতা ও যোগ্যতার নীতিমালা না মানা, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ না হওয়া, ট্রেনিং বা গবেষণার কাজে বিদেশ গিয়ে মেধাবী কর্মকর্তাদের ফিরে না আসা, পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন না করার কারণকে দায়ী করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ স্বীয় মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জনগণকে প্রশাসনিক সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে জাতি বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে। দীর্ঘ মেয়াদে প্রশাসন হারাচ্ছে মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের। ভেঙ্গে পড়ছে প্রশাসনিক চেইন অফ কমান্ড। মাঠ প্রশাসনের কাজে দেখা দিচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত সমন্বয়হীনতা ও জটিলতা। ফলে নিজেরা আমলা হয়েও নিজেদের সৃষ্ট আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে আটকে পড়েন কেউ কেউ। জনপ্রশাসনে মেধাশূন্যতার কারণসমূহ পর্যালোচনা করে যা পাওয়া গেল তা নি:সন্দেহে যেকোনো দেশের সুপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এর প্রতিকার কী? দেশের জনপ্রশাসনকে কিভাবে মেধাবী ও জনবান্ধব করে গড়ে তোলা যায়? এর উত্তরে প্রথমে আসে বিপিএসসির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্ত্বাকে আরো সুদৃঢ় করা, সত্যিকারভাবে পেশাদারি করে গড়ে তোলা, উন্নত বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী প্রশাসন গড়ে তোলা, রাজনীতিমুক্ত ও নির্দলীয় নিয়োগ বন্ধ করা ইত্যাদি। যদিও দেশে যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে প্রশাসনকে সম্পূর্ণ দলীয়মুক্ত রাখা চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে আওয়ামী লীগ বিগত সাড়ে পনের বছরে দেশের প্রশাসনযন্ত্রকে যেভাবে দলীয়করণ করেছে, তা নজিরবিহীন। প্রতিপক্ষ দলকে চরম স্বৈরাচারি কায়দায় শায়েস্তা করতে গিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নানাভাবে বঞ্চিত করেছে। ফলশ্রুতিতে, এখন বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত অন্তবর্তীকালিন সরকার এবং আগামীতে নির্বাচিত সরকার সাড়ে পনের বছরের বঞ্চিত ও নাজেহাল কর্মকর্তাদের তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। এগুলো সবই আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রশাসনকে চরমভাবে দলীয়করনের বিপরীত প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বা বিপিএসসি একটি সাংবিধানিক এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও এর ওপর দলীয় সরকারের কর্তৃত্ব দৃশ্যমান। সেটা বন্ধ করতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণের পাশাপাশি জনপ্রশাসনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা নিজের শিক্ষা, মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে, যুযোপযোগী করতে হবে, নীতি-নৈতিকতা দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে এবং ছাত্র সমাজকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।তবেই আশা করা যায়, দেশের প্রশাসনযন্ত্র গণমানুষের কল্যাণে কাজ করবে।
লেখকঃ কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
হত্যা মামলায় ভোলার সাবেক এমপি আলী আজম মুকুল ঢাকায় গ্রেপ্তার
ঘোড়াঘাটে শ্বাসরোধে যুবকের মৃত্যু, হত্যাকান্ডের অভিযোগে স্ত্রী আটক
ইসরাইলি বাহিনীর বর্বর হামলায় গাজায় নিহত ৪৭
করাচি থেকে প্রথম সরাসরি কার্গো পৌঁছেছে চট্টগ্রামে
হিজবুল্লাহর সাথে সংঘর্ষে নিহত ৬ ইসরাইলি সেনাসদস্য
রাত আড়াইটায় পঙ্গু হাসপাতালে মাহফুজসহ ৪ উপদেষ্টা, অতঃপর...
এবার বুকার পুরস্কার পেলেন ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে
গোয়ালন্দে অনশন করেও বিয়ের দাবী পুরণ না হওয়ায় ধর্ষণ মামলা, ঢাকা থেকে প্রেমিক গ্রেপ্তার
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে মুখ্য ভূমিকা রাখেন করদাতারা
তিলকের সেঞ্চুরিতে টি-টোয়েন্টির নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে জিতল ভারত
বসুন্ধরা গ্রুপের চাকরি ছাড়লেন আবু সাঈদের দুই ভাই
মেন্ডিসের রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরিতে জয়ে শুরু শ্রীলঙ্কার
রিয়েলিটি শো’র প্রধান বিচারক নাজনীন হাসান খান
অনেক দিন পর সায়ানের একক কনসার্ট
ছাত্র আন্দোলনে ফারুকী ভাইকে মাঠে দেখিনি-হিরো আলম
ঈশ্বরগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে তিন চোর আটক
আসিফের গানের মডেল গণবিপ্লবের ভাইরাল কন্যা সিঁথি
গাজায় যুদ্ধ শেষ করার সময় এসেছে : অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন
বন্য হাতির সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার : পরিবেশ উপদেষ্টা
সরকারি কৌঁসুলির নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে পটুয়াখালীতে আইনজীবীদের বিক্ষোভ মিছিল