ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

সম্ভাবনার নতুন দুয়ার রামগড় স্থলবন্দর

Daily Inqilab মো. বেলায়েত হোসেন

১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০৫ সালের থানা এবং ১৯২০ সালে মহকুমায় উন্নীত ফেনী নদী বিধৌত জনপদ রামগড়। ইতিহাসের পাতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপিতে রামগড় উজ্জ্বল ও সমুন্নত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রামগড় ছিল ১নং সেক্টরের আওতাধীন। কালের বিবর্তনে প্রায় সব মহকুমা শহর জেলায় রূপান্তরিত হলেও এ প্রাচীন জনপদ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে স্বীয় মর্যাদা হারিয়ে ১৯৮৪ সালে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়; জেলা ঘোষণা করা হয় খাগড়াছড়িকে। ভারতের সাব্রুম থেকে রামগড়কে আলাদা করেছে ফেনী নদী। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে এপার-ওপার দু’ পাড়ের মানুষের সংযোগের নিমিত্তে রামগড়ে পাবলিক ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু হয়েছিল; পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারতের এ যোগাযোগ ব্যবস্থাটি বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এর আলোকে টেকসই অর্থনীতি গড়তে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ দৃঢ় করার বিকল্প কোনো পথ নেই। সীমান্ত রেখায় ছেদ পড়লেও দু’ পাড়ের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আত্মিক সম্প্রীতি ও বন্ধন সবসময়ই ছিল। দু’ পাড়ের মানুষের শুকনো আঁখিতে আনন্দ অশ্রু ঝরাতে ২০১০ সালে পুনরায় স্থলবন্দর এবং ট্রানজিট কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার। ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং মধ্য প্রদেশ থেকে সেভেন সিস্টার্স (আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুনাচল) এর দূরত্ব প্রায় ২৫০০-৩০০০ কি.মি.। দূরত্বের কারণে সেভেন সিস্টার্সে আমদানি-রপ্তানি ব্যহত হচ্ছে এবং ভারতের মূল ভূখ-ের সাথে সহজ ও সাশ্রয়ী কানেক্টিভিটি বাংলাদেশের রয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে ট্রানজিট প্রস্তাব দেওয়া হলে বাংলাদেশ তা গ্রহণ করে। কারণ, বাংলাদেশ ভারতের সেভেন সিস্টার্স রুট ব্যবহার করে নেপাল-ভুটানে আমদানি-রপ্তানির সুবিধা পাবে। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের উপর একচেটিয়া বাণিজ্য নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং বিমসটেক ও আসিয়ান ট্রেডের সাথে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তারই প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালে ভারত ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্যা ইউজ অফ চট্টগ্রাম এন্ড মংলা পোর্ট’ ব্যবহারের অনুমতি পায়। এতে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে পণ্য সামগ্রী নৌপথে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে চট্টগ্রাম থেকে ১০৯ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে রামগড় স্থলবন্দর ও ট্রানজিট দিয়ে স্বল্প সময়ে, স্বল্প ব্যয়ে সেভেন সিস্টার্সে সহজে প্রবেশ করতে পারবে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যান্য স্থলবন্দরের চেয়ে রামগড় স্থলবন্দর ব্যতিক্রমী। এটিই দেশের একমাত্র এবং প্রথম ট্রানজিট বন্দর। রামগড় স্থলবন্দর এবং ট্রানজিট চালু করতে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ফেনী নদী দ্বারা বিভক্ত রামগড় ও সাব্রুমের উপর মৈত্রী সেতু নির্মাণ। যা দু’পাড়ের মানুষের সেতুবন্ধনের মাধ্যম। ভারত সরকারের অর্থায়নে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ এর দৈর্ঘ্য ১.৯ কি.মি.। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের ৯ মার্চ ভার্চুয়ালি সেতুটি যৌথভাবে উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট-১ এর আওতায় এসব কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটির মোট অনুমোদিত ব্যয় ৭৩২ কোটি টাকা; তার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন ১৩৯ কোটি (প্রকল্প ব্যয়ের ১৯%) টাকা, বাকি ৫৯৩ কোটি (প্রকল্প ব্যয়ের ৮১%) টাকা বিশ্বব্যাংকের। সরকারের অর্থায়নে ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে (তথ্য সূত্র: রামগড় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ)। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে রামগড় স্থলবন্দরের দূরত্ব মাত্র ১০৯ কি.মি.। এর মধ্যে বন্দর থেকে বারৈয়ারহাট পর্যন্ত রাস্তা ৪ লেনে উন্নীত। বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় এর বাকি ৩৮ কি.মি. রাস্তা প্রসস্তকরণ ও আধুনিকরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল ভারতের এলওসি-৩ ও বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন তহবিলের অর্থায়নে ১ হাজার ১০৭ কোটি ১২ লাখ টাকার প্রাক্কলন ব্যয়ে ভারতের দিল্লিতে সমঝোতা স্মারক হয়। এর মধ্যে ভারতের অর্থায়ন ৫১৩ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং ভারতের ঋণ ৫৯৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। এটি ২৪ মে, ২০২৩ তারিখে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন এবং যার কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এটি ১৮ ফুট থেকে ৩৮ ফুটে প্রসস্ত করা হবে। এ রাস্তায় মোট ২৪৯.২০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৯টি ব্রিজের কাজ সম্পন্ন, বাকি ২৩টি সেতুও নির্মাণ করা হবে।

রামগড় সীমান্তবর্তী এলাকা; তাই স্থলবন্দর হওয়ায় চোরাচালানের পরিবর্তে বৈধ পথে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। বাংলাদেশর ভূমি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় স্থলবন্দর হয়ে পণ্য ট্রানজিটে সরকারকে যে নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স দেওয়ার কথা, প্রতিবছর তা ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। কক্সবাজার, চট্টগ্রামে প্রচুর সামুদ্রিক শুঁটকি উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের জামদানি শাড়ি ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত বিখ্যাত ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’। ২০১৭ সালে ইলিশ মাছ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। নোয়াখালী-চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রচুর পান-সুপারি উৎপন্ন হয়। সেভেন সিস্টার্সে শুঁটকি, জামদানি শাড়ি, ইলিশ মাছ, পান-সুপারির প্রচুর চাহিদা রয়েছে এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সেসব আমদানির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ভারতের সেভেন সিস্টার্সে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল (আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর ইত্যাদি) এবং মসলা (এলাচ, দারুচিনি, লং, তেজপাতা ইত্যাদি) রপ্তানির আশাবাদ ব্যক্ত করে (সূত্র: রামগড় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ)। এতে আমাদের শুঁটকি, জামদানি শিল্প এবং পান-সুপারির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। শ্রমবাজার বিস্তৃত হবে, বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে ফল এবং মসলা আমদানিতে অস্ট্রেলিয়া, ইরান কিংবা দূরবর্তী অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে আমদানি চাপ কমলে পণ্যের দাম হ্রাস পাবে। যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। স্থল বন্দরে মালামাল সংরক্ষণ, লোডিং-আনলোডিং এ এবং পরিবহন ব্যবস্থায় এ অঞ্চলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সৌন্দর্যের আধার হওয়ায় ভারতীয় পর্যটকরা রামগড় স্থল বন্দর হয়ে খুব সহজে আসতে পারবে। এতে বাংলাদেশের পর্যটন খাত বিকশিত হওয়া এবং বিপ্লব ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে রামগড় স্থলবন্দর রামগড় মহকুমা শহরের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফেরাবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অফিস, রামগড়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ভাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ অফিসার নিহত অপর এক ঘটনায় নিহত ২

ভাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ অফিসার নিহত অপর এক ঘটনায় নিহত ২

আখাউড়ায় রেলওয়ের জায়গা থাকা ৪০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

আখাউড়ায় রেলওয়ের জায়গা থাকা ৪০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে