ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯ আশ্বিন ১৪৩১

নৈতিক শিক্ষাই মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে

Daily Inqilab অধ্যাপক মীর মোশারফ হোসেন

২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

ভোগবাদী বিশ্বের ভোগের আড়ম্বর মানুষের মনুষ্যত্বকে ধীকৃত করছে। যে জ্ঞান মানুষের মনুষত্বকে ধীকৃত করে সে জ্ঞান অবশ্যই বিকৃত। ইসলাম এক শাশ্বত জীবন বিধান। ইসলামের শরীয়তের মাপকাঠি অবিকৃত। তার কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও শিথিলতা নেই। ইসলামের নৈতিক শিক্ষা নানা গুণে বিভুষিত। এসব গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিচার করার শক্তি পায়। এ শক্তি ব্যক্তির মনে চেতনালব্ধ জ্ঞানের উন্মেষ ঘটায়, যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় থাকে ঈমানী চেতনা। ঈমানী চেতনালব্ধ ব্যক্তি সর্বস্তরে সত্যের বিজয় পতাকা উড্ডীন করে থাকে। অসত্য এবং অপরাধ তার ধারে-কাছে আসতে পারে না। ফলে তার দ্বারা নিষ্কলুস আলোকিত পরিবার ও সমাজ গড়ে ওঠে।

নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম নৈতিক শিক্ষা থেকে। কোরআন হাদিসে বিশ্বাসী আমলী ব্যক্তি জীবনের যাবতীয় কল্যাণকর শুভবুদ্ধি ও শুভচিন্তা এবং তার বিপরীত অশুভ বুদ্ধি ও অশুভ চিন্তা, বিচারের আপেক্ষিক মান নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে, যার ফলে তার পদচারণায় পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সর্বত্রই নির্ভেজাল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের ভেতরের প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মানসিক শক্তিতে বলে বলিয়ান হয়ে যাবতীয় দুর্নীতিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অন্যায় ও অবৈধ পথ পরিহার করতে সে হয় বদ্ধপরিকর। সততা ও ন্যায়ের আদর্শে আদর্শিত হয়ে আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে নিরপেক্ষভাবে সত্যের পথ অবলম্বন করে থাকে। অন্যের ক্ষতি করা তার মন-মস্তিষ্কে আসে না।
নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহ তায়ালার কুদরতি শক্তি সম্পর্কে প্রসন্ন ধারণা জন্মে। ফলে সে ইহকাল ও পরকাল এবং তকদিরে বিশ্বাসী হয়। মিথ্যা কথা বলা মহা অপরাধ, এ ধারণার বশবর্তী ব্যক্তি পাপ কাজে লিপ্ত হতে আল্লাহতালাকে ভয় করে বিধায় সে পাপে জড়িত হয় না। আল ইমরানের ৬১ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: ‘মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লানত।’ অর্থাৎ মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়। আল্লাহপাক তার বান্দার প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ দৃষ্টিতে উপদেশ বাণী দান করেছেন, সূরা বাকারার ৪২ নং আয়াতে: ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যা সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না।’ মহান আল্লাহ কত না বিনয়ী ভাষায় তার বান্দাকে সাবধান করে দিয়েছেন তবু মানুষের বিবেক সাড়া দেয় না। মানুষ স্বভাবতই স্বার্থের কাছে দুর্বল। নিজ স্বার্থ চরিতার্থের জন্য সঙ্গী-সাথীদের সাথে মিথ্যার অভিনয় করে থাকে। নিজের লাভের জন্য অভিনয়মূলক ব্যবহার হচ্ছে প্রতারণা। প্রতারণাকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের ৯৪নং আয়াতে বলেন: ‘পরস্পর প্রতারণা করার জন্য তোমরা তোমাদের শপথকে ব্যবহার করো না।’ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি কখনো লজ্জা ও আঘাত দিয়ে কথা বলেন না। তার নম্র-বিনয়ী ব্যবহার অন্যকে সুপ্রভাবিত করে। সে যেন পরশ পাথর। সচ্চরিত্র মানুষের পবিত্রতাপূর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। এ গুণ স্বাধনালব্ধ। সাধনা ছাড়া দুনিয়ায় কোনো মহৎ বিষয় অর্জন করা যায় না। সচ্চরিত্র অর্জনের মৌলিক গুণ হচ্ছে ব্যভিচার হতে পবিত্র থাকা। মানুষ শুধু একটা বিষয়ে নিজে গর্ব করে বলতে পারে তাহলো, সচ্চরিত্রের। কেননা চারিত্রিক গর্ব করা ব্যক্তির অতীত ও বর্তমানের বাস্তব ও সত্যের প্রমাণ করে। মহান আল্লাহ তার বান্দাকে উদ্দেশ্য করে বলেন: ‘বান্দা তোমার চরিত্রকে সুন্দর করো আর জান্নাতুল ফেরদাউসের চাবি হাতে নাও’। অন্তরের চিন্তা আচরণে প্রকাশ পায়। পবিত্র অন্তরের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে সচ্চরিত্র। প্রকৃতলব্ধ জ্ঞানের সাথে অর্জিত নৈতিক জ্ঞানের সু-সমন্বয়ে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায়। এগুণের অধিকারী ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে সর্বক্ষণে ইসলামের বিধানগুলো অন্তরে পোষণ করে চলে। ফলে সে আল্লাহর প্রতি অনুরক্ত থেকে জীবন চলার পথে আল্লাহর সৃষ্ট জীবের প্রতি প্রসন্ন এবং বিনয়ী হয়ে থাকে। নিজের কল্যাণের সাথে অপরের প্রতিও সে সহানুভূতি, দয়া ও সহমর্মিতার পরিচয় দেয়, যাকে বলা হয় একরামুল মুমিনীন। মুমিন হয়ে মুমিনের পাশে দাঁড়ানোটাই হচ্ছে মানবিকতা। ইসলাম মানবিকতার ধর্ম। মানব কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে একমাত্র নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিই পারে।

সচ্চরিত্রবান ব্যক্তির জীবন কর্ম নিজের সাথে অপরের সংযোগ থাকে। সে যেন সোনার জীবন কাঠি। পরশ পেলেই সোনা হয়ে যায়। প্রসন্ন মনে কল্যাণধর্মী বাস্তব সত্যের ধারক হয়ে চলতে সে অভ্যস্ত। ইসলামের মাহাত্ম্য এখানেই। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি বিনয়-নম্রতার অনুপম নিদর্শন। ক্ষমাশীলতায় তার অন্তর পরিপূর্ণ থাকে। ত্যাগী মনের অধিকারী ও অল্পে সন্তুষ্ট হয়ে থাকে। পরের উপকারে মনে প্রশান্তি পায়। অধিকারের প্রাপ্তিতেও ত্যাগের পরিচয় দেয়। প্রাপ্তির চেয়ে দানে সে মানসিক তৃপ্তি পায়। ভোগবাদী মানুষের ভোগের স্পৃহা সীমাহীন। তার আকাক্সক্ষা অপূরণীয়। এরা সমাজ ও জাতির অশুভ এবং অকল্যাণ বয়ে আনে। সংকীর্ণ মন ও ক্ষমতার দাপট এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এদের পদচারণায় সমাজ ও দেশ অভিশপ্ত হয়। নৈতিক গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি অপরের হিতে নিজেকে হিতৈষীভাবে। দয়া, ক্ষমা-মহত্ম, ঔদার্য প্রভৃতি মানবিক গুণে অভিষিক্ত করে সকলকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয় বান্দা হতে হলে তিন গুণের অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যক। এক. সৎ চরিত্রের অধিকারী হওয়া, দুই. সত্যবাদী হওয়া, তিন. হালাল রিজিক খাওয়া।

সমাজকে সুখ সমৃদ্ধ ও নিরবিচ্ছিন্ন অনাবিল শান্তিপূর্ণ করে তোলার জন্য যুগে যুগে মানুষ শিক্ষার মহড়াই দিয়ে আসছে। কিন্তু সার্থক সেই হয়, যার ভেতরে মনুষত্ব রয়েছে। মনুষত্বের অধিকারী সেই হয়, যার ভেতরে দ্বীন রয়েছে। ইসলাম মানুষকে দুনিয়ার সাফল্য ও আখেরাতের সুনির্ধারিত পথ দেখিয়েছে। স্বভাবগতভাবে যে সহজ সরল ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী তার পক্ষে দ্বীন অর্জন সহজ। অবিনয়ী ব্যক্তি কখনো সাফল্যে উপনীত হতে পারে না। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি কেবল আত্ম চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। সে যেখানেই বিচরণ করে সেখানেই অকল্যাণ ও ফাসাদের ঘনঘটা ঘটায়। ক্রোধ, লোভ, মোহ এসব জাগতিক বিষয় তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। আল্লাহপাক তাঁর কালামে পাকে বলেছেন: ‘ওয়া ইবাদুল রাহমানিল্লাযীনা আলাল আরদে হাওনান’। তারা পরম দয়ালু আল্লাহর বান্দা, যারা জমিনের উপর নম্রভাবে চলে। দাম্ভিক ব্যক্তি নিজেকে ধ্বংসের পথে নিক্ষেপ করে। যে ব্যক্তি নিজের প্রশংসা নিজে করে সে যেন আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কোরআনুল কারীমে বনি ইসরাইলের ৩৭নং আয়াতে বলেন: ‘ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না। তুমি তো কখনোই পদভারে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না।’ নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয়ী ও নম্র হয় আল্লাহ তাকে উন্নত করেন।’ জ্ঞানার্জনের একমাত্র পথ নির্দেশক আল্লাহ পাকের মনোনীত ও প্রেরিত ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন। বিশ্ব ভুবনে সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। মানুষের ইহোলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের পথ ও পাথেয়। সুনির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট জীবন বিধান, যা অনুসরণে মানবজীবনে নিরঙ্কুশ দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য লাভ করা যায়। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি প্রতারণা, কপটতা, অহংকার, বিদ্রুপ, উপহাস, শটতা, হটকারিতা প্রভৃতি থেকে মুক্ত থাকে।

লেখক: শিক্ষক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

চোটে পড়ে মৌসুম থেকে ছিটকেই গেলেন টের স্টেগেন

চোটে পড়ে মৌসুম থেকে ছিটকেই গেলেন টের স্টেগেন

ইন্টার মায়ামি ছাড়ছেন মেসি?

ইন্টার মায়ামি ছাড়ছেন মেসি?

ডেভিস কাপ দিয়ে কোর্টে ফিরছেন নাদাল

ডেভিস কাপ দিয়ে কোর্টে ফিরছেন নাদাল

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন

গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২

গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২

আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান

আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান

জাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় রায়হানের দোষ স্বীকার

জাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় রায়হানের দোষ স্বীকার

গণহত্যাকারী কোন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না: আসাদুজ্জামান রিপন

গণহত্যাকারী কোন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না: আসাদুজ্জামান রিপন

ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান

ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান

হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের

হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের

দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা

দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা

ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার

ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার

শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?

শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?

ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল

ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল

এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়

এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়

নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে

সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে

স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান

স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার