কেমন হলো নির্বাচন

Daily Inqilab হারুন-আর-রশিদ

২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম

সরকারি দল এবং নির্বাচন কমিশন ৭ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছিল তা দেশ এবং বিদেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। বিনয়ের সাথে বলছি। নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। সে জন্য স্বচোখে দেখা এবং তথ্যনির্ভর কিছু প্রতিবেদন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তুলে ধরা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করছি। আমি নিজেও ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। এরকম জনশূন্য সড়ক পথ ভোটের আগের দিনও দেখিনি। উন্মুক্ত রাস্তায় ছেলেরা মহাআনন্দে ক্রিকেট খেলছে। আমার বাসায় ভোটের দিনসহ দুইদিন কাজের মেয়েটি আসেনি এবং পরিচিত অনেক বাসায় একই অবস্থা ছিলো। তারা বলেছে সারাদিন ভোট কেন্দ্রের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য জনপ্রতি ৫শ’ টাকা এবং একটি বিরিয়ানির প্যাকেট পেয়েছি। এই হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাথমিক চিত্র, বিষয়টি আমি দেখে এবং জেনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। কারণ, ভোটের দিন থাকবে উৎসব মুখর। হাসি মুখ থাকবে সবার, সেই দৃশ্য দেখলাম না।

স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এর মধ্যে ৪টি নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেওয়া, এর পাশাপাশি মানুষের ভোটের প্রতি যে আগ্রহ উদ্দীপনা প্রত্যক্ষ করেছি, সেটা বাকি ৮টি নির্বাচনে পরিলক্ষিত হয়নি। বিস্তারিত বিবরণ দিলে লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাবে। পাঠকদের ধৈর্য্যরে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখাটি তুলে ধরছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো তা সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে দেশের মানুষ এবং বিশ্বের সকল দেশের প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। বাকি যে ৮টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনগুলো যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো বলে প্রতীয়মান হয় আমার দৃষ্টিতে। দেশ-বিদেশে এদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক কম। নির্বাচনের আগে ও পরের দৃশ্যগুলো আরও মর্মান্তিক। নির্মমভাবে কারারুদ্ধ একাধিক মানুষের মৃত্যু এবং হত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রধান বিরোধী দলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর জেলে আটক এবং তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের, গুম, খুন এবং যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত করা, জাল ভোটের মহা উৎসব, শিশুদের ভোট দেওয়ার দৃশ্য এবং প্রশাসন যন্ত্রের সরাসরি দলীয় বাহিনীর ভূমিকা পালন এবং নির্বাচন কেন্দ্রে সহিংসতার ব্যাপকতা এতোটাই বেশি ছিলো, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচন।

পিছনে নির্বাচনগুলো এখন অতীত। তাই ৭ জানুয়ারি ২০২৪ এর নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে তুলে ধরবো। এ কারণে যে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন বলেছে, ৭ নির্বাচন কোনো সহিংসতা হয়নি। সরকারে অবস্থান করেও সুষ্ঠু, পক্ষপাতমুক্ত এবং সহিংসতা মুক্ত নির্বাচন করা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করতে পেরেছি। এখন জাতি উপলব্ধি করতে পারছে, সংবিধান অনুযায়ী সরকারে থেকেও ভালো নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়া সম্ভব। সংবাদ সম্মেলনে তারা কথাগুলো বলেছেন। সংসদ সদস্যদের শপথ এবং মন্ত্রীপরিষদ গঠন সবকিছুই ত্বরিত গতিতে সম্পন্ন হয়েছে। সরকারি দল মনে করে, বিরোধী দলে থাকলে যেমন আমরা মাঠ কাঁপাতে পারি, তেমনি সরকারি দলে থাকলেও ক্ষমতার মেয়াদ উত্তীর্ণ করতে পারি, বিগত তিন টার্ম ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ একাধারে টানা ১৫ বছর দেশ পরিচালনা করে তার প্রমাণ দেশবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছি। ২০২৪ সাল চতুর্থ মেয়াদও আমরা পুরো ৫ বছর অনায়াসে দেশ পরিচালনা করে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবো, এই দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের আছে। আমরা সেভাবেই এগুচ্ছি। আগামিতেও সফল হবো। এবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্বাচনের কিছু তথ্যসমৃদ্ধ মন্তব্য প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি দেই। কী ঘটেছিল নির্বাচনের দিনগুলোতে। কথা ও কাজে কতটা মিল ছিলো সেটা সুচিন্তিত দেশপ্রেমিক পাঠক সমাজের জানা প্রয়োজন বলে মনে করি।

আওয়ামী লীগের ৯২ দশমিক ৮৩ শতাংশ প্রার্থীই কোটিপতি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের ২৬৫ প্রার্থীর বার্ষিক গড় আয় ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। তাদের গড় সম্পদমূল্য ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি। আওয়ামী লীগের ৬৪ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রার্থী পেশায় ব্যবসায়ী। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় ব্যবসায়ীর সংখ্যা আরও বেড়েছে।

নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের সংহিতায় নিহত ২। ২৯৭ কোটি টাকা দুর্নীতি মামলায় যুব লীগের বহিষ্কৃত নেতা জিকে শামীমের জামিন মঞ্জুর হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করলে তার মামলা প্রত্যাহার করে নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে তাকে বিজয়ী করে আনা হয়, যেমন শাহাজাহান ওমর এবং প্রধান বিরোধী দলের নেতাকর্মী হলে জামিনে বাধা দেওয়া হয়। আর আওয়ালী লীগ হলে জামিন পাওয়া কোনো বিষয়ই নয়, সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন। সরকারি দলের রাজনীতির নামে এ ধরনের অপসংস্কৃতির রাজনীতি দুই দশক ধরে দেশের মানুষ দেখে আসছে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার তাদের বিরোধীদের দমন-পীড়ন চালিয়ে কণ্ঠ স্তব্দ করে দিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদি প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। ৬ জানুয়ারি ২০২৪, বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনে ৪ জনের মৃত্যু। নিজের লোকদের ধরলে পুলিশের হাত কেটে ফেলবেন বলছেন এমপি মোস্তাফিজুর রহমান। ৫ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ৫১,৮৮৪ কোটি টাকা। নোয়াখালী-৪ আসনে নৌকার ওপরে সিল মারার নির্দেশ ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আকবর হোসেন শাহনাজের। ঝিনাইদহে হামলার ঘটনায় পাল্টা হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট, আহত-১০। ঝিনাইদহে নৌকার সমর্থককে কুপিয়ে হত্যা। ৭ জেলায় হামলা, সংঘর্ষ ও ভাঙচুর। ৪৮ জন আহত। মাদারীপুরের কালকিনিতে অন্তত ১০টি বসতঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। সাংবাদিকের চোখ তুলে নেওয়ার হুমকি। ট্রাক মার্কা চুয়াডাঙ্গা-২ স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু হাসেম রেজার অভিযোগ নির্বাচনে যথেষ্ট কারচুপি হয়েছে। কিশোরগঞ্জ-১ আসনে ঘরেই জয়, ঘরেই পরাজয়, বাকি ছয়ের জামানত ক্ষয়। অনিয়মের অভিযোগ কুষ্টিয়ায়, পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে মানববন্ধন। শরীরে ককটেল নিক্ষেপ আওয়ামী লীগ নেতা আহত। একটি নিলর্জ্জ এক দলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সিলেটে। রাজধানীতে এলাকা ও আয়তন ভেদে বাসা এবং ফ্লাটের ভারা ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা বেড়েছে। খরচ বেড়েছে আয় বাড়েনি। আই এম এফের শর্ত নিয়ে অর্থ মন্ত্রী বলেছেন রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ হয়নি, হবেও না। ভোটার কম, প্রতিযোগিতা হচ্ছে নিজেদের মধ্যেই। নির্বাচনে ২৪১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ব্যবসায়ীদের দখলে। মোট ৩০০ আসনের দুই তৃতীয়াংশ আসন ব্যবসায়ীরা পেয়েছে। (চলবে)

 

লেখক: গ্রন্থকার, গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

‘এনবিআরের অভিযান’ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যাখ্যা

‘এনবিআরের অভিযান’ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যাখ্যা

নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে হতাশ জেলেরা

নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে হতাশ জেলেরা

অস্ট্রেলিয়ার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত

অস্ট্রেলিয়ার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত

সৈয়দ আহমদ শহিদ বেরলভী (র.) ইসলামি আন্দোলনের আপোসহীন মডেল -আলহাজ হাফিজ সাব্বির আহমদ

সৈয়দ আহমদ শহিদ বেরলভী (র.) ইসলামি আন্দোলনের আপোসহীন মডেল -আলহাজ হাফিজ সাব্বির আহমদ

নাইজারে মার্কিন বাহিনীর বিমান ঘাঁটিতে রুশ সেনা

নাইজারে মার্কিন বাহিনীর বিমান ঘাঁটিতে রুশ সেনা

২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার গান্ধী পরিবারের কোনো প্রার্থী নেই আমেথিতে

২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার গান্ধী পরিবারের কোনো প্রার্থী নেই আমেথিতে

দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি ও ৫০-৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস আবহাওয়া অফিসের

দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি ও ৫০-৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস আবহাওয়া অফিসের

বৃষ্টি বাঁধার আগে আউট লিটন,ধীরে শুরু বাংলাদেশের

বৃষ্টি বাঁধার আগে আউট লিটন,ধীরে শুরু বাংলাদেশের

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্ত ও সহ্য করবো না

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্ত ও সহ্য করবো না

ট্রেনে কাল থেকে গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া

ট্রেনে কাল থেকে গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া

মায়ের সাথে পাঁচ তারকা হোটেলে নৈশভোজের সুযোগ ফুডপ্যান্ডার ‘সেলেব্রে-ইট মাদার্স ডে’ ক্যাম্পেইন

মায়ের সাথে পাঁচ তারকা হোটেলে নৈশভোজের সুযোগ ফুডপ্যান্ডার ‘সেলেব্রে-ইট মাদার্স ডে’ ক্যাম্পেইন

“তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে” - মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন

“তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে” - মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি সিলেট জেলা যুবদলের

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি সিলেট জেলা যুবদলের

ঘুরে দাঁড়িয়েও জিম্বাবুয়ে অলআউট ১২৪ রানে

ঘুরে দাঁড়িয়েও জিম্বাবুয়ে অলআউট ১২৪ রানে

অবৈধ পথে ইউরোপের মরণ যাত্রায় তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি: অবশেষে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা

অবৈধ পথে ইউরোপের মরণ যাত্রায় তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি: অবশেষে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা

গাজীপুরের ট্রেন দুর্ঘটনায় তিন কর্মচারী বরখাস্ত

গাজীপুরের ট্রেন দুর্ঘটনায় তিন কর্মচারী বরখাস্ত

কালিয়াকৈর পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় দুই হেলপার নিহত

কালিয়াকৈর পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় দুই হেলপার নিহত

হিলি ও নবাবগঞ্জে পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় দুই জন নিহত

হিলি ও নবাবগঞ্জে পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় দুই জন নিহত

প্রশ্ন : পুরুষের রূপার আংটি পরিধান প্রসঙ্গে।

প্রশ্ন : পুরুষের রূপার আংটি পরিধান প্রসঙ্গে।

ফেলোশিপে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন সামেকের ডা. পলাশ

ফেলোশিপে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন সামেকের ডা. পলাশ