শিক্ষাক্রম ও আমাদের চিন্তামানস
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:১৯ এএম | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:১৯ এএম
শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদ-, তবে সেই মেরুদ-ের ডায়াগ্রাম হ’ল শিক্ষাক্রম, যা সঙ্গোপনে আমাদের চিন্তামানস, আমাদের জাতিসত্তার রূপ-প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। একটি জাতি কোন পথে পরিচালিত হবে, তা যতটা না নির্ভর করে শাসক শ্রেণির উপর, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে তার শিক্ষা, চিন্তা ও মননধারার উপর। এজন্য যারা জাতিগঠন করেন কিংবা জাতিধ্বংসের কাজে লিপ্ত হন, তারা এই সংবেদনশীল জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পিছনে যারা কলকাঠি নাড়ছেন, তাদের কর্মকা- থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এদেশের সিংহভাগ মানুষের আক্বীদা-আমলকে ধ্বংস করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই তাদের এই পদক্ষেপ। ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সুর বেঁধে দিয়েছিল, সেই সুর ধীরে ধীরে জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিকশিত হয়ে এই প্রজন্মের সন্তানদের ধর্মীয় ও আদর্শিক চিন্তাধারাকে এমনিতেই প্রায় বিবশ করে ফেলেছে। আর বর্তমান শিক্ষাক্রম সেই চিন্তাধারাকে কেবল নিশ্চিহ্ন করা নয়, বরং সরাসরি ইসলামী চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত হেনে এদেশের মুসলিম জাতিসত্তার বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সর্বধর্মসমন্বয় মতবাদের ভাবাদর্শে সৃষ্ট বাঙালী জাতীয়তাবাদের মোড়কে বিলীন করার চেষ্টা চলছে মুসলিম জাতীয়তাবাদের শেষ চিহ্নটুকু।
বর্তমান পাঠ্যবইগুলোর একটি অবধারিত অংশ যেন হিন্দু এবং হিন্দুত্ববাদী লেখকগণ। খুব কম পাঠ্যপুস্তকই রয়েছে যার লেখক তালিকায় হিন্দু লেখকের নাম নেই। বিগত সময়ে নাস্তিক্যবাদের বীজবপনের জন্য বিবর্তনবাদের ভুয়া তত্ত্ব আমদানি করা হয়েছিল। এবার তার সাথে যোগ হয়েছে আরো কয়েকটি গুরুতর বিষয়। যেমন : (১) ইতিহাস বিকৃতি : এই শিক্ষাক্রমে মুসলমানদের অবদানকে গোপন রেখে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে এমনভাবে লেখা হয়েছে যে, তাতে যেন মুসলমানদের কোনো অবদানই নেই; বরং পুরোটাই হিন্দুদের অবদান। ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানে’ ইসলামের ইতিহাসের কোনো স্থান নেই। এমনকি মাদরাসা বোর্ডের বইতেও নেই। বিশ্ব মানচিত্রে ফিলিস্তিনের কোনো উল্লেখ নেই। অথচ, রয়েছে ইসরাইলের নাম!
(২) ইসলামী সংস্কৃতি বর্জন: পহেলা বৈশাখ, গায়ে হলুদ, জন্মদিন পালন, মুখেভাত অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে এদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাদরাসার বইয়েও প্রচ্ছদে দেয়া হয়েছে বাদ্য-বাজনার ছবি, পর্দাহীন নারীদের ছবি। ‘চলো বন্ধু হই’ শিরোনামে ছেলে ও মেয়ের ছবি দিয়ে একে অপরের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করতে বলা হয়েছে, যা সুস্পষ্টভাবে অন্যায় প্রণয়ের দিকে উৎসাহ প্রদানের শামিল। কেউ অবৈধ প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে তাকে শাসন করতেও নিষেধ করা হয়েছে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাপার হ’ল, বয়ঃসন্ধিকালের স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে খোলাখুলিভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে হিজড়াদের অধিকার সংরক্ষণের নামে সুকৌশলে ট্রান্সজেন্ডার তথা লিঙ্গপরিবর্তনকামী বা সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট দুশ্চরিত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়েছে, যা কেবল মুসলিমই নয়, কোনো রুচিশীল মানুষের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব নয়। এভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুৎ করা এবং পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত অশ্লীল, অসভ্য তত্ত্বসমূহ তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ইসলামের ভিত্তিতে যেন তাদের আত্মপরিচয় গড়ে না ওঠে, তার আপ্রাণ চেষ্টা ফুটে উঠেছে এবারের শিক্ষাক্রমের পরতে পরতে। একই উদ্দেশ্যে নবম শ্রেণির ‘ইসলাম শিক্ষা’ বই থেকে জিহাদের অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে শেখানো হয়েছে কুফরী কালাম- ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।
(৩) হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন: ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বইয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাসে ‘অখন্ড ভারত’ নামক একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে, যা উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল ভিত্তি। তাদের ধারণায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ মিলে একটি অখন্ড ভারতবর্ষ হ’ল হিন্দুদের পবিত্র ভূমি বা হিন্দু সভ্যতার সূতিকাগার। তাদের মতে, বর্তমান যে ভারত তা খন্ডিত। ধাপে ধাপে ইসরাইলের মতো এই ভূমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে অবিভাজ্য হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই এই মতবাদের অভীষ্ট লক্ষ্য। এই মতবাদ অনুযায়ী ভারতবর্ষে মুসলমানরা বহিরাগত ও আক্রমণকারী। এভাবে কল্পিত ভারতবর্ষকে হিন্দু সা¤্রাজ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এই শিক্ষাক্রমে।
সর্বোপরি শিক্ষার নামে মিথ্যা ইতিহাস ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আমাদের মুসলিম জাতিসত্তা ও চিন্তামানসকে বাতিলের সাথে বিলীন করার এই অপচেষ্টা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক কঠিনতম পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে, যা সশস্ত্র যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর। ক্লাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া গেলেও ঈমান ও মনুষ্যত্বের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া তাদের জন্য এমনই এক মরণপণ যুদ্ধের মুখোমুখি করেছে, যাতে পরাজয় ছাড়া বিজয়ের সম্ভাবনা অতীব ক্ষীণ, যদি না আল্লাহ রহম করেন।
এমতাবস্থায় সচেতন মুসলিম হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হবে, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া এবং জাতি ধ্বংসের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সেই সাথে বিকল্প শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে এই কুশিক্ষা, ভ্রান্তশিক্ষার প্রভাব থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করা। যালিমরা যখন কৌশল করে, আল্লাহও তাদের বিরুদ্ধে কৌশল করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণতাদানকারী। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে’ (ছফ ৬১/৮)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর বাণীসমূহের কোনো পরিবর্তনকারী নেই’ (আনআম ৬/১১৫)।
সুতরাং যতই আমাদের সমাজে, শিক্ষাব্যবস্থায়, মিডিয়ায় ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো হোক না কেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দ্বীনই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী। ইনশাআল্লাহ ঈমানী দৃঢ়তা এবং দূরদর্শী পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা অতীতের মতো যাবতীয় বাতিল শক্তির মুকাবিলা করে এগিয়ে যাব। প্রতিটি শহরে-গ্রামে, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের জন্য আশু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিমন্ডলী, বিজ্ঞ শিক্ষাবিদগণ এবং বিত্তশালী ও দানশীল ব্যক্তিদের সামনে এগিয়ে আসা জরুরি।
লেখক: চেয়ারম্যান, হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ড।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: নড়িয়ায় নির্বাচিত হলেন যারা
সিলেট গোলাপগঞ্জে জেলা আ'লীগ নেতা এলিমকে হারাতে পারলেন না ব্রাজিল যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক উজ্জ্বল
অপার সম্ভাবনাময় দেশের বৃহত্তম বীজ উৎপাদন খামার
আ’লীগে-আ’লীগে টক্কর, সিলেট সদর উপজেলায় জয় পেলেন সুজাত
রাশিয়ায় এক সেনাসহ দুই মার্কিন নাগরিক গ্রেপ্তার
ধানকাটা-ঝড়বৃষ্টির কারণে ভোটার উপস্থিতি কম: ওবায়দুল কাদের
স্বামীর হাত-পা বেঁধে যৌনাঙ্গে ছ্যাঁকা-মারধর, স্ত্রী গ্রেপ্তার
বিজিবির অভিযানে এপ্রিলে ১৩৪ কোটি ৩৬ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান জব্দ
বেইলি রোড অগ্নিকান্ড: কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁর মালিক গ্রেপ্তার
বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেও চ্যাম্পিয়নস লীগ অধরাই রয়ে গেল পিএসজির
বগুড়ায় তিন উপজেলায় ভোটার বিহিন উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত
প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জ্ঞান অর্জন করতে হবে: রাজউকের চেয়ারম্যান
ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়ার আহ্বান
ইসলাম বিরোধী শিক্ষা কারিকুলাম মেনে নেয়া হবে না পীর সাহেব চরমোনাই
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আরও একটি দেশের স্বীকৃতি
তেঁতুলিয়া সীমান্তে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ
যে পাঁচ কারণে হারতে পারেন মোদি’
ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা ধ্বংস, ১৫৪০ সেনা নিহত
খুলনায় ভোক্তা অধিকারের অভিযান: দুই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
‘বিশ্বের ক্যানসার রাজধানী’ ভারত, রোগী বাড়ছে হু হু করে