রোজা খোদাভীতি অর্জনের জন্য

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

১২ মার্চ ২০২৪, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৪, ১২:১৬ এএম

রমজান মাসব্যাপী রোজা পালিত হয়। এ মাসে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, রোগী, মুসাফির, পাগল, হায়েয-নেফাসসম্পন্ন মহিলা ও শরিয়তের পরিভাষায় অক্ষম ব্যতীত প্রত্যেক নর-নারীর রোজা পালন করা ফরজ। কুরআন শরীফের বাণী: হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পার। গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সঙ্গে সৎ কাজ করে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি রোজা রাখ তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে আল-কুরআন, যা মানবজাতির জন্য জীবন বিধান এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। আর হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে যেন এ মাসে রোজা রাখে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ বা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে যেন অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না। যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (আল কুরআন, বাকারা, ১৮৩-১৮৫)

হযরত সলমান পারসি (রা.) বর্ণনা করেন যে, শা’বান মাসের শেষদিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন, হে মানবজাতি! একটি মহান ও মোবারক মাস তোমাদের কাছাকাছি। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। আল্লাহ তোমাদের প্রতি এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন আর রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়াকে অতিরিক্ত এবাদত বলে বর্ণনা করেছেন। এ মাসে যদি কেউ ভালো কাজ করে, তবে তা হবে অন্য মাসে ফরজ আদায় করার সমতুল্য। রমজান হচ্ছে ধৈর্য্যরে মাস আর ধৈর্য্যরে বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। রমজান হচ্ছে সহানুভূতির মাস। যে মাসে মুমিনের রিজিক বর্ধিত করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে রোজাদারকে ইফতার করাবে, তা তার জন্য গুণাহসমূহ থেকে এবং দোজখের আগুন থেকে উদ্ধারের মাধ্যম হবে। আর তাঁকে রোজাদারের সমান প্রতিদান দেয়া হবে। এতে রোজাদারের সওয়াব হ্রাস পাবে না।

যে ব্যক্তি তাঁর হালাল উপার্জন দিয়ে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য ফেরেশতারা রোজার রাতসমূহে দোয়া করতে থাকবে আর শবে কদরে জীবরাইল (আ.) তার সঙ্গে মুসাফা করবেন। আর যার সঙ্গে মুসাফাহা করবেন তার আত্মা বিগলিত হয়ে যাবে, তার চোখে পানি আসবে। হযরত সলমান ফারসি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! যার এমন সম্বল নেই, তার সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?

রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহ তাকে এ সওয়াব দান করবেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে একটি খেজুর অথবা পানীয় দ্বারা অথবা এক কাপ দুধ দ্বারা ইফতার করাবে। আর তা এমন মাস যার প্রথমে রহমত, মধ্যভাগে মাগফিরাত ও শেষে দোজখ থেকে জান্নাত রয়েছে। যে কেউ এ মাসে তার অধীনস্থদের কাজকর্ম লঘু করবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর তাকে দোজখের আগুন থেকে মুক্ত করবেন। (বায়হকী, শায়াবুল ঈমান)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতকে এমন পাঁচটি জিনিস দান করেছেন, যা এর আগে অন্য কোন নবীকে দান করা হয়নি। যথা: ১. যখন রমজান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, তাকে কখনো কষ্ট দেবে না। ২. রোজা পালনকারীরা যখন শেষ বেলায় উপনীত হয়, তখন তাদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় বলে গণ্য হয়। ৩. ফেরেশতারা তাদের জন্য দিন-রাত দোয়া করতে থাকে। ৪. আল্লাহ তায়ালা বেহেশতকে হুকুম করেন- প্রস্তুত হও, অচিরেই তারা দুনিয়ার ক্লেশ থেকে মুক্ত হয়ে আমার ঘরে আমার সম্মানের পাদদেশে আরাম করার জন্য আসবে। ৫. যখন রমজানের শেষ রাত হয়, তখন সবাইকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেন। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, তা কি কদরের রাত? হুজুর (সা.) বললেন, না, তোমরা কি দেখ নাই শ্রমিকদের ব্যাপারে? তারা কাজ করে যখন শেষ করে, তখন তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হয়। (আল হাদিস, বায়হকী)।

হযরত সাহাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) রোজাদারদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে বলেন, জান্নাতের একটি ফটকের নাম হল রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন এ ফটক দিয়ে রোজাদার ব্যক্তিরা প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। রোজাদারকে চিহ্নিত করে আহ্বান করা হবে এবং তারা এদিকে অগ্রসর হবে, অন্য কেউ এদিকে প্রবেশ করতে পারবে না। রোজাদারগণ প্রবেশ করার পর তা বন্ধ করে দেয়া হবে। (বুখারি)।

রোজাকে হাদিস শরীফে ‘শরীরের যাকাত’ বলা হয়েছে। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘রোজা হচ্ছে ধৈর্যের অর্ধেক এবং ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। আর পরকালীন শাস্তি থেকে মুক্তিলাভের উপায় হিসাবে রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ।’

রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘আমাদের এবং আহলে কিতাবের (ইয়াহুদি ও নাসারা মানুষের) রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো, আমরা সেহরী খাই, তারা খায় না। তোমরা সেহরী খাও কারণ এর মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে।’ হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে সেহরী খেয়েছি। তারপর নামাজে দাঁড়িয়েছি। জিজ্ঞাসা করা হলো, উভয়ের (সেহরি ও নামাজ) এর মধ্যে কতটুকু ব্যবধান ছিল? তিনি উত্তর দেন, ৫০টি আয়াত তিলাওয়াত করতে যতটুকু সময় লাগে, ততটুকু।’

হযরত উমর খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন ওই (পূর্ব) দিক থেকে আসে এবং দিন ঐ (পশ্চিম) দিকে চলে যায় আর সূর্য ডুবে যায়, তখন রোজাদার যেন ইফতার করে নেয়। (মুসলিম)। হযরত সালমান ইবনে আমির দাববী (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবীয়ে আকরাম (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন ইফতার করে তখন তাকে খেজুর দিয়ে ইফতার করা উচিত। তবে যদি সে খেজুর না পায়, তাহলে পানি দিয়ে ইফতার করা উচিত। কারণ, পানি হচ্ছে পবিত্র (তিরমিজী)। হযরত আনাস (রা.) এর বর্ণিত, রাসূলে আকরাম (সা.) নামাজের (মাগরিবের) আগে কয়েকটি তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। আর তাজা না পেলে শুকনো খেজুর দিয়ে। আর তাও যখন না পেতেন, তখন কয়েক ঢোক পানি পান করতেন। (আবু দাউদ)।

রমজানের শেষ দশদিনে এতেকাফ করা সুন্নতে মোয়াক্কাদা কেফায়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসের শেষ দশদিনে এতেকাফ করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে অনুরূপ হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যায়। এতেকাফের সময় প্রস্রাব-পায়খানা বা ফরজ গোসল ছাড়া অন্য কোনো কারণে মসজিদের সীমানার বাইরে গেলে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়।

রোজা রেখে শরিয়তসম্মত কারণ ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা বা স্ত্রী সম্ভোগ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। আর এতে কায়া ও কাফফরা উভয় ওয়াজিব হয়ে যায়। রোজার কাফফারা হলো ক্রমান্বয়ে ৬০টি রোজা রাখা। এমন সামর্থ্য না হলেও ৬০ জন মিসকিনকে আহার করানো। অনিচ্ছাকৃতভাবে ওজু-গোসলের পানি বা অন্য কোনো খাদ্যবস্তু গলার নিচে গেলে, মুখ ভর্তি বমি গিলে ফেললে ইত্যাদি কারণে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়, আর এ জন্য শুধু কাযা ওয়াজিব হবে (কাফফারা ওয়াজিব নয়)। রোজা অবস্থায় সুরমা-আতর ব্যবহার করা জায়েজ।

প্রকৃতপক্ষে পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকা রোজার লক্ষ্য নয়, মাধ্যম মাত্র। অন্যদিকে রোজা মানে ক্ষুধার্ত-অভাবি মানুষের যন্ত্রণাকাতর জীবন উপলব্ধি করা। অসহায় বা সর্বহারা মানুষের ক্ষুধার জ্বালা উপলব্ধির মাধ্যমে সহমর্মিতা পোষণের জন্য রোজার আগমন। আত্মসংশোধন ও আত্মশুদ্ধির মাস হলো রমজান। পানাহার ও যৌনক্ষুধার আহ্বান থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেয়া উদ্দেশ্য নয়, নিজেকে সংযমী ও পরের সেবায়, ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা অর্জন উদ্দেশ্য। আর তাই হলো রোজার প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

এবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিল ইরান

এবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিল ইরান

বিশ্বে চীনা প্রভাবের প্রশংসা করেছে ৮০ ভাগ ফরাসি: জরিপ

বিশ্বে চীনা প্রভাবের প্রশংসা করেছে ৮০ ভাগ ফরাসি: জরিপ

বিদ্যুতের দাম বছরে চারবার বাড়বে

বিদ্যুতের দাম বছরে চারবার বাড়বে

জামিনের পরও এখনো মুক্তি পাননি মামুনুল হক

জামিনের পরও এখনো মুক্তি পাননি মামুনুল হক

কিশোরী বয়স থেকেই চাকরির খোঁজ, ডায়নার প্রথম কর্ম-চুক্তিপত্র নিলামে

কিশোরী বয়স থেকেই চাকরির খোঁজ, ডায়নার প্রথম কর্ম-চুক্তিপত্র নিলামে

সউদীতে প্রবল বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ল মসজিদের ছাদ

সউদীতে প্রবল বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ল মসজিদের ছাদ

গাজায় মানবিক ট্রাজেডি : ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করলো তুরস্ক

গাজায় মানবিক ট্রাজেডি : ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করলো তুরস্ক

ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভেটো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র: চীন

ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভেটো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র: চীন

কোকাকোলার বোতল সরিয়ে দিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন রাজা

কোকাকোলার বোতল সরিয়ে দিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন রাজা

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ