আমরা সকলেই কোন না কোনভাবে ক্রেতা বা ভোক্তা। প্রতিদিন বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করি। এসকল দ্রব্য সামগ্রী আমরা নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে ক্রয় করে থাকি। আমরা অনেকেই জানি না, বাজার থেকে আমরা যেসব দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করছি, এগুলোর আদৌ গুণগত ও পরিমাণগত পণ্যের মান সঠিক আছে কিনা। বিষয়টি আমাদের আরো ভাবিয়ে তোলে, যখন সংবাদপত্রে ‘পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান-বিএসটিআই’র কোনো মান নেই শিরোনামে সংবাদ পড়ি।

একথা স্বীকার করতে হবে, বিশ্বের প্রায় দেশেই ক্রেতা ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় কঠোর আইন প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশের সে ধরনের কার্যকর কোনো আইন নেই। সঙ্গতঃ কারণেই বাজারে বিক্রেতাদের কাছে ক্রেতারা সব সময় অসহায় বা জিম্মি। বিভিন্ন সংবাদসূত্রে প্রকাশ, ট্যাং, স্যুপ, মাইলো, হরলিকসসহ হরেক রকম আমদানীকৃত রেডি ফুড জাতীয় পণ্যসামগ্রী ও তরল পানীয়তে বাজার ছেয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের এ ব্যাপারে মাথা ব্যথা নেই। শুধু তাই নয়, এগুলোর সঠিক মান নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী বিজ্ঞাপনের চমক সৃষ্টি করে বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, ভোক্তাদের ঠেলে দিচ্ছে নানাবিধ জটিল রোগের দিকে। ক্রেতা কিংবা ভোক্তাশ্রেণী রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। কখনো মৃত্যুও ঘটছে।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দীর্ঘদিন থেকে নকল ভেজাল, মানহীন-গুণহীন, পণ্যে বাজার ছেয়ে যাবার বিষয়ে দাবী জানিয়ে আসলেও এর প্রতিবিধান হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, মানহীন পণ্য সামগ্রীর মধ্যে বেশির ভাগ দ্রব্য সামগ্রী রেডি ফুড জাতীয় হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা বা ভোক্তা শ্রেণী এর গুণাগুণ যাচাই-বাছাই করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশ ছাড়া এশিয়ার সকল দেশেই ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্তে আইন আছে, রয়েছে বিশেষ আদালত। বাংলাদেশের ক্রেতা বা ভোক্তারা ব্যবসায়ীদের চাতুরী প্রচারনা সর্বোপরি সংঘবদ্ধতার কাছে জিম্মি। দেশ স্বাধীনের এতটা বছর পরেও দেশের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের ব্যবসায়ী বিশেষ করে অসাধু-দুর্নীতিপরায়ন কারবারীদের কাছে অসহায়। এটা কিছুতেই স্বাধীন জাতির গৌরবের বিষয় হতে পারে না। এ দুর্বিসহ অব্যবস্থার আশু সমাধান আবশ্যক।

একথাও ঠিক যে, দেশে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত খাদ্য, পণ্য সামগ্রী ও কাঁচামালের গুণগত মান, ওজনমান, নিয়ন্ত্রনকারী বিএসটিআই এর পরীক্ষা কার্যক্রম সঠিক ভাবে চলছে না। খাবার পানি, ভোজ্য তেল, তরল খাদ্যসহ মানুষের জীবনের সাথে জড়িত প্রায় দেড়শ’ পণ্যের ওজন ও গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ করা এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত। জনবল এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরঞ্জামের অভাব দেখিয়ে এরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। স্থানের অভাব সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটিতে নাকি অতিরিক্ত আরও বেশ কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিগত ২৫ বছর ধরে অনেক পণ্যের উৎপাদক একবার প্রতিষ্ঠানটিকে নমুনা দেখিয়ে লাইসেন্স ও প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে পরবর্তীতে কাক্সিক্ষতমানের পণ্য উৎপাদন না করে, পণ্যের মানের ফলোআপ না করে দেশবাসীকে বঞ্চিত করে চলেছে। একথা কে না জানে যে, ক্রমবর্ধমান চাহিদা, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মান ও গুণাগুণ যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার বিকল্প নেই। প্রগতিশীল বাণিজ্যিক বিশ্বে পণ্যদ্রব্যের সঠিক মান ও গুণ অটুট রাখতেই হবে। মানুষের পরিবর্তনশীল চাহিদার প্রেক্ষিতে উন্নতমানের ও নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য দ্রব্য উৎপাদন ও যোগান দেয়ার জন্য দ্রব্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। গুণগত মান এর উপর নির্ভর করে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগী উৎপাদকরা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাচ্ছে।

গোটা বিশ্বব্যাপী চলছে বাণিজ্যি যুদ্ধ। সেখানে গবেষণা বিভাগ গবেষণার মাধ্যমে নতুনত্বের সংযোজন ঘটিয়ে উন্নতমান গুণ সংরক্ষণপূর্বক নতুন পণ্য উদ্ভাবন করে, অনেক সময় নতুন উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রাখার আয়োজনের শেষ নেই। এ প্রেক্ষিতে, বলতেই হচ্ছে, ‘পণ্যের বা সেবার গুণগত মান’ বলতে কোন জিনিস দেশে আছে, একথা বিশ্বাস করা কষ্টকর। লাখ লাখ ক্রেতাকে ওজনে কম, পেট্রোল পাম্পে জ্বালানী মাপে কম, খাদ্যে ভেজাল, জীবন রক্ষাকারী ঔষধে ভেজাল, নকল সার, নকল কারখানা, দুই নম্বরীকে এক নম্বর বলে চালানো বা এক নম্বরীর সাথে দুই নম্বরী মেশানো এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। চারদিকে ভেজাল আর ভেজাল। যেন ভেজালের দুনিয়ায় পণ্যের গুণাগুণ ও মান শিল্পোন্নয়ন, বাণিজ্য উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। ভোক্তা বা ক্রেতাদের গ্রহণযোগ্য যথোপযুক্ত পণ্য উৎপাদন, বিপনন ও সরবরাহকরণ নিশ্চিত করতে না পারলে আভ্যন্তরীন কিংবা বর্হিবাণিজ্য এর কোনটিতে আমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবো না। দ্রব্যের সাইজ, রং, উপযোগিতা, গুণাগুণ, টেকসই ক্ষমতা, সংরক্ষণ, যোগ্যতা ইত্যাদি পণ্যমান সূচিতকরণ, জাতীয় স্বার্থেই আমাদের বজায় রাখতে হবে। অবাধ বাণিজ্যিক বিশ্বে নির্দিষ্ট মান বিশিষ্ট পণ্য ক্রেতাদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে। তাই আমাদের উৎপাদনকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে ভোক্তাদের নিকট সব দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্য না হলে তারা বাজার হারাবে। কারণ, ভোক্তাই হলো পণ্য-দ্রব্যের জীবনীশক্তি। কোন প্রতিষ্ঠান স্বর্ণের জুতা তৈরী করলেও তা যদি ভোক্তাশ্রেণী ভোগ না করে তবে সে প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু অনিবার্য। পণ্যের গুণগতমান ও সঠিক ওজন নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের দায়-দায়িত্ব আরো বেশি। প্রতিটি সরকারই এ বিষয়টি কৌশলে কেন যে এড়িয়ে চলে, তা বোধগম্য নয়। ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থসংরক্ষণে প্রতিটি সরকারই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে, বিদেশী পণ্যের প্রতি ভোক্তাশ্রেণী একদিকে যেমন আকৃষ্ট হচ্ছে, অপর দিকে বিদেশী পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। সে সাথে মুষ্টিমেয় অসাধু অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ক্রেতাদের জিম্মি করে ফায়দা লুটছে।

সরকার ক্রেতা সংরক্ষণ আইনটি বাস্তবায়নকল্পে অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা আইনটির সত্ত্বর প্রয়োগের দাবী জানাই। একথাও সত্য যে, দেশে ভোক্তা সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন ও ভোক্তা আদালত প্রতিষ্ঠিত হলেই রাতারাতি ভোক্তা অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, এমনটি আশা করা সঠিক হবে না। তবে এটাও সত্য, ভোক্তা স্বার্থ বা অধিকার সংরক্ষণের পথে প্রথম ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো উক্ত আইন প্রণয়ন করা ও সংশ্লিষ্ট আদালত প্রতিষ্ঠা করা। এ প্রারম্ভিক কার্যটি সম্পাদিত করে আইনের সুষ্ঠু, অবাধ প্রয়োগ ও আদালতকে কার্যকর করার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে।

আমাদের যাবতীয় উন্নতি-অগ্রগতি এক কথায় আমলাদের হাতে বন্দী। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হচ্ছে জাতির ভাগ্য। কোন কাজই যেন শেষ হয়েও হয় না। এখানে তেলের দাম আর ঘি-এর দাম একই। বলা বাহুল্য, যে দেশের তেলের দাম আর ঘি এর দাম সমান, বুঝে নিতে হবে সে দেশের শাসন, প্রশাসন, বিচার, আইন, সরকার ও ব্যবস্থাপনায় যোগ্য ব্যক্তির পদচারনা নেই। স্বাস্থ্যবান লোক দেশ ও জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। খাদ্যে ও বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে এ দেশের বিশাল মানবসম্পদকে শারীরিক মানসিক ও দৈহিকভাবে নষ্ট করার যে হীন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, তা প্রতিহত করা সময়ের দাবী। দেশে মানসম্পন্ন পণ্য নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।