পণ্যমূল্য বৃদ্ধি কেন রোধ করা যাচ্ছে না
২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৩ এএম
জন্মের পর থেকে দেখছি রমজান মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ে। এ দেশের ব্যবসায়ী-মজুদদাররা ধরেই নেয়, মুনাফায় পকেট ভারী করার একটা বড় সুযোগ হচ্ছে রমজান। রমজানে দুটো পয়সা কামিয়ে নিতে এরা কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নেয় আগেই। মজুদ গড়ে তোলে, দফায় দফায় মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তোলে। পণ্যমূল্য নিয়ে আর কোনোদিন লিখব না, এমনটিই ভাবছিলাম। লেখে কি-ই বা লাভ? লেখায় কি দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ এতটুকুও কমবে? ৩০ বছর ধরে লেখালেখি করেছি, কী সুফল পেয়েছে দেশের মানুষ? তবু আমি আশাহত নই। মানুষের বিবেক একদিন জাগবেই, বোধোদয় হবেই বলে বিশ্বাস করি। মানুষের মধ্যে ধর্মানুভূতি আসবেই। এমন আশা বুকে নিয়েই লেখি, লিখে যাব। এমন দিনের আমরা প্রত্যাশা করি, যেদিন রমজানে ব্যবসায়ীরা মুনাফা করতে চাইবে না। অন্তত এই একটি মাসে লাভের কথা চিন্তা না করে ভোক্তাদের কল্যাণে কাজ করবে।
মুনাফাখোর, মজুদদারদের উদ্দেশে বলছি, নানা ছলচাতুরিতে টাকার পাহাড় তো গড়েছেন। আর কত টাকা চাই আপনাদের? একজন মানুষের জীবনে কত টাকার প্রয়োজন হয়? দামি গাড়ি হাঁকান। নানা জায়গায় গড়ে তুলেছেন আলিসান বাড়ি। কারো কারো আছে ভোগবিলাসের বাগানবাড়িও। আর খাবার? যখন যা চাইছেন তাই তো মিলছে। বাঘের চোখও তো চাইলে আপনারা পান। অন্তত সিয়াম সাধনার মাসে দেশের অসহায় মানুষগুলোর কথা ভাবুন। নি¤œআয়ের মানুষগুলো আপনাদের চাপিয়ে দেওয়া যথেচ্ছ দাম দিয়ে খাবার কিনতে পারছে না। ওরা দুবেলা পেট পুরে খেতে পারছে না। রোগে-শোকে মরছে। আপনারা কি নিজের সন্তান না খেয়ে কাতরানোর দৃশ্য দেখেছেন কখনো? অভাবী মানুষগুলো প্রতিনিয়তই তা দেখছে। ওদের অভ্যাসগত দেখা এটি। সামান্য টাকার অভাবে তারা সন্তানের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুটাও চেয়ে চেয়ে দেখে।
মানুষকে জিম্মি করে ভোগ্যপণ্যের অধিক মুনাফা লাভের এই খেলা কেন সরকার বন্ধ করতে পারে না? এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হলে সরকারকে অবশ্যই হার্ডলাইনে যেতে হবে। প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে সেসব অসাধু ব্যবসায়ীকে, যারা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিজেদের ফায়দা লোটে। অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যত কম হবে, পণ্যের দাম তত বেশি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ততবারই বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। বড় বড় ব্যবসায়ী সরকারকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছে, রোজার মধ্যে পণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন বাজারে নেই।
এটা সত্য যে, বিশ^জুড়েই মূল্যস্ফতি বাড়ছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ, যা বছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির চাপে আছে সাধারণ মানুষ। যতটা পণ্যমূল্য হওয়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি পণ্যমূল্য বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বাড়ে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। নানা কারণ থাকলেও পণ্যের দাম লাফিয়ে বেড়ে ওঠার প্রধান কারণ সিন্ডিকেট। সরকারের পক্ষ থেকেও সেটা স্বীকার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সিন্ডিকেটওয়ালারা কি দেশ চালায়? তারা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাধর? এটা কি মগেরমুলুক যে, ৫০ টাকার পণ্য মুহূর্তে ১০০ টাকা হয়ে যাবে? ৪০ টাকার পেঁয়াজ সপ্তাহ ব্যবধানে হয়ে যায় দেড়’শ-দুই’শ টাকা হবে?
সিন্ডিকেট প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে নাজেহাল করা হচ্ছে। চাল নিয়ে করা হচ্ছে চালবাজি। ব্রয়লার মুরগি থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজি, আদা-রসুন, মাছ-মাংস, চিনি ইত্যাদির দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে জিম্মি করা হচ্ছে। বছরের পর বছর এমন অবস্থা চললেও সরকারের একাধিক সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শুধু হাঁকডাকের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে।
আমরা জানি, এসব পরিস্থিতি থেকে ভোক্তাকে রক্ষা করতে সরকারের একাধিক বাজার তদারকি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি সেল, মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বিএসটিআই, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, র্যাবসহ সরকারের অন্যসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। এসব সংস্থা নিজস্ব আইনে বাজার তদারকি করছে। তারপরও বাজারে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়নি। তাহলে কি গোড়ায় গলদ? দেশের সিন্ডিকেটওয়ালারা বড়ই প্রভাবশালী। সরকারের লোকজনের সাথে তাঁদের সখ্য অনেক। তাই হয়তো তাঁদের রোধ করা যায় না কিংবা রোধ করা হয় না। অসাধু ব্যবসায়ীরা চাইলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে পারে বা পণ্যের সরবরাহ কমাতে পারে। কৌশল করে তারা দাম কমাতে পারে, আবার বাড়াতেও পারে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
গত ৫ বছরে জাতীয় পর্যায়ে পারিবারিক আয় বেড়েছে ৫৯ শতাংশ, আর খরচ বেড়েছে ৮৪.৫ শতাংশ। পারিবারিক ভোগ-ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি প্রায় ৫৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে খাদ্য। সবচেয়ে কম আয়ের পরিবারে খাদ্যের পেছনে খরচ হয় ৭২ শতাংশ, সবচেয়ে বেশি আয়ের পরিবারে খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ ৫৯ শতাংশ। যেসব পরিবারের আয় মাঝামাঝি পর্যায়ে, খাদ্যের পেছনে মোট সংসার খরচের ৬১ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় তাদের। সবচেয়ে বেশি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সমাজের উঁচু স্তররের মানুষের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। তবে পাঁচ বছরে দরিদ্র পরিবারের আয় খানিকটা বাড়লেও ধনীদের আয় কমেছে বলে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নানা ফন্দি ফিকিরসহ ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে তাঁর মুনাফা ঠিক রাখতে পারেন। রিকশাওয়ালারা চালের দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নিতে পারেন। কিন্তু চাকরিজীবীরা তাঁদের বেতন চাইলেই বাড়াতে পারেন না। একটি পদের পেছনে যেখানে হাজার হাজার আবেদনপত্র পড়ে, সেখানে এক চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে ঢোকার সুযোগও নেই। ফলে একটু ভালো করে বাঁচার আশাটি আর তাঁদের পূরণ হচ্ছে না। ঢাকা মহানগরীতে সীমিত আয়ের মানুষের বসবাসের অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা।’
বলতেই হয়, নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নেই। আয় কমলেও উচ্চ আয়ের মানুষদের সমস্যা হচ্ছে কম। বেশি বিপদে রয়েছেন শুধু সনাতনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ, যাদের জীবনবোধ ভিন্ন। তাদের মাসিক আয়ের ৬০ ভাগ চলে যায় বাড়িভাড়া, আর ২০ ভাগ খাবারে। দুই বাচ্চার পড়াশোনা আর স্কুলে যাতায়াতে খরচ হয় আয়ের ১০-১৫ ভাগ। তারপর রয়েছে চিকিৎসা। মানুষের একদিকে বাসস্থান সমস্যা প্রকট, অন্য দিকে পারিবারিক ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় মহা সংকটে পড়েছে। জনগণের কথা মাথায় রেখে যে কোনো মূল্যে পণ্যমূল্যসহ অন্যান্য ব্যয় যাতে কমে সেদিকে সরকারের নজরদারীর বিকল্প নেই। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপই পারে এ ক্ষেত্রে সফলতা এনে দিতে।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কোন দুর্নীতিবাজ রাজাকারকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান_আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন
প্রতিদিন ২০ মে: টন ফিটকিরি উৎপাদন করা সম্ভব হবে: সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান
শিবচর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সীমাহীন অভিযোগ
কুষ্টিয়ায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় পুলিশ কর্মকর্তা নিহত
রাজবাড়ীতে দুই দিনব্যাপী ক্যারিয়ার ফেস্ট
ইউরোপ ত্রিমুখি অস্তিত্বের ঝুঁকির সম্মুখীন: ম্যাখোঁর হুঁশিয়ারি
যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছে ৪১ শতাংশ মার্কিন ভোটার
যশোরের শার্শা উপজেলার নাভারন সিটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় ব্রেস্ট টিউমার রোগীর মৃত্যু
গাজীপুরের দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে
৭ মাসে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০ জন ছাড়িয়েছে
হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের চারজনের পটুয়াখালীতে দাফন সম্পন্ন
আচমকাই খাদে পড়ল যাত্রীবাহী বাস, পাকিস্তানে নিহত ২০
বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি ছাত্রী
ভারতকে ‘অপমান’ বাইডেনের, যা বলল হোয়াইট হাউজ
নিয়মভঙ্গের অভিযোগে আদানির ৬ সংস্থাকে শোকজ নোটিস
কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের
পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির
গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ
দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া