জলদস্যুতার নেপথ্যে কী?
২৩ মার্চ ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১২:১৫ এএম
জলযান সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই নাবিকরা জলদানবের চেয়ে জলদস্যুদের বেশি ভয় করেছে। জলদানবরা মহাসাগরে প্রলয়ঙ্কর তরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে তা-বলীলা করলেও তাদের মাঝে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, নৃশংসতা অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে জলদস্যুদের বাহারী অস্ত্রের দাপটে একের পর এক জাহাজ ছিনতাই, জাহাজের মালামাল ডাকাতি, নাবিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনার কাছে সমুদ্রের জলদানবদের তরঙ্গসৃষ্টি নিতান্তই জলকেলি। জলসীমায় জলদস্যুদের কুকর্মকে জলদস্যুতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জলদস্যুতা বলতে সাধারণত সমুদ্রে সংঘটিত ডাকাতি বা অপরাধমূলক কর্মকা-কে বোঝায়। মূলত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে নির্দিষ্ট একটি অপরাধের নাম হচ্ছে জলদস্যুতা। জলদস্যুতার ইতিহাস প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরেরও পুরনো। প্রাচীন মিশরের ১৮তম রাজবংশের নবম ফেরাউন তৃতীয় আমেনহোতেপ (১৩৯১-১৩৫৩ খ্রিস্টপূর্ব) এর শাসনামলের এক দুষ্প্রাপ্য নথিতে জলদস্যুদের কথা উল্লেখ ছিল। পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে যাত্রীবাহী জাহাজে জলদস্যুদের হামলার ঘটনা সেই নথি থেকে জানা যায়। নথিটির সম্ভাব্য সময়কাল ১৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৬৫০ সাল থেকে ১৭২০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সাত দশক ছিল জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ। ২০১০ সালে স্টিফেন টাল্টি ও ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফিলিপসের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘অ ঈধঢ়ঃধরহ›ং উঁঃু: ঝড়সধষর চরৎধঃবং, ঘধাু ঝবধষং, ধহফ উধহমবৎড়ঁং উধুং ধঃ ঝবধ’. বইটি ২০০৯ সালের ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যু আব্দুওয়ালি মুসার নেতৃত্বে মাস্ক আলাবামা জাহাজটি ছিনতাইয়ের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা হয়েছিল। অবশ্য ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে ক্যাপ্টেন ফিলিপস নামে একটি আমেরিকান থ্রিলার মুভি নির্মিত হয়। মূল ঘটনা হলো জলদস্যুরা ছোট দুটি স্পিডবোট নিয়ে এমভি মাস্ক আলাবামা জাহাজটিকে আক্রমণ করে। জাহাজটি আটক করে নিজেদের আয়ত্তে নিলেও জলদস্যুরা পুরোপুরি এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। এক পর্যায়ে তারা ক্যাপ্টেন ফিলিপসকে বন্দি করে মুক্তিপণ দাবি করে। অনেকটা একইরকমভাবে গত ১২ মার্চ ২০২৪ এ সোমালীয় জলদস্যুরা বেশ কিছু ছোট ছোট স্পিডবোট নিয়ে আচমকা বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহতে উঠে পড়ে। ভারত মহাসাগরের সোমালিয়ান উপকূল থেকে ৫৫০ নটিক্যাল মাইল দূর থেকে এসে জিম্মি করে নেয় জাহাজটি। দ্রুততার সাথে ক্যাপ্টেনসহ ২৩ জন ক্রুকে গান পয়েন্টে নিয়ে জিম্মি করে ফেলে এবং জাহাজটি নিজেদের সুরক্ষিত জলসীমায় নিয়ে যায়। সোমালীয় জলদস্যুদের দ্বারা বাংলাদেশের জাহাজ জিম্মির এই ঘটনা এবারই নতুন নয়। এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরের লাক্ষাদ্বীপ থেকে মাত্র ৩০০ নটিক্যাল মাইল দূরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে জিম্মি হয়েছিল বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহানমনি।
দারিদ্র, অরাজকতা, আইনের শাসনের অভাবের পাশাপাশি গৃহযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা, সহিংসতার বিরূপ প্রভাবই সাধারণ সোমালিয়ানদের জলদস্যুতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য করেছে। ১৯৯৫ সাল থেকে সোমালীয় জলদস্যুদের প্রত্যক্ষ বিচরণ শুরু হয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এদের অপতৎপরতা বাড়তেই থাকে। লোহিত সাগর, আরব সাগর, ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশির সমুদ্রে সোমালীয় জলদস্যুদের অবাধ কর্তৃত্ব। এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলদস্যুরা জিম্মি করা জাহাজের মাধ্যমে ছয় ধরনের সুবিধা নিয়ে থাকে। এ সুবিধাগুলো হলো ক. মূল্যবান মালামাল লুটপাট, খ. মুক্তিপণ আদায়, গ. অস্ত্র ও মাদক পরিবহন, ঘ. সামরিক ও রাজনৈতিক দাবি আদায়ের চেষ্টা, ঙ. রাজবন্দিদের মুক্তি, চ. জাহাজটি ব্যবহার করে সমুদ্রের অন্যান্য জাহাজে হামলা। সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুতার সূত্রপাত হয়েছিল মূলত অবৈধভাবে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে। ডিআইডব্লিউ এবং মার্কিন হাউজ আর্মড সার্ভিসেস কমিটির গবেষণা থেকে জানা যায়, বিদেশি অনেক জাহাজ অযথাই সোমালীয় জলের মধ্যে বিষাক্ত বর্জ্য ডাম্পিং করত। ফলে সেখানকার পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছিল। মাছ মরে ভেসে উঠতো। স্থানীয়দের পরিবেশ বসবাসের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। এর প্রতিবাদে স্থানীয় জেলেরা সশস্ত্র দলে বিভক্ত হয়ে বিদেশি জাহাজ এ অঞ্চলে প্রবেশ বন্ধ করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে বিকল্প আয় হিসেবে তারা মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ ছিনতাই করা শুরু করে। বিশ্বজুড়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা সঞ্চিত থাকলেও নিজ দেশের জনসাধারণের কাছে তারা জাতীয় বীর। কারণ, সোমালিয়ার জলদস্যুরা সমগ্র বিশে^র আতঙ্ক হলেও জিম্মি করা জাহাজের বিনিময়ে প্রাপ্ত মুক্তিপণের টাকা সোমালিয়াতেই খরচ হয়। ১৯৬০ সালে ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে জন্ম নেওয়া সোমালিয়ার বার্ষিক জিডিপি ও গড় মাথাপিছু আয় নির্ধারণে জলদস্যুদের অপকর্মের টাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোমালীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি জলদস্যুতা। সুতরাং জলদস্যুদের যাবতীয় কর্মকা-ে সোমালীয় সরকারের পরোক্ষ সমর্থন আছে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। জলদস্যুদলে নিযুক্ত হতে সোমালিয়ার তরুণ, যুবকরা অতি আগ্রহী, এরকম তথ্যও পাওয়া যায়।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ২০০৫ সালে সোমালিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্র অঞ্চলে ১৬৭টি জাহাজ জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। ২০০৬ সালে ১৫৬টি, ২০০৭ সালে ১৪৯টি, ২০০৮ সালে ১৪১টি, ২০০৯ সালের প্রথম ছয় মাসেই ১৩৫টি, ২০১০ সালে ১৮৯টি, ২০১১ সালে ২১২টি জাহাজ সোমালীয় জলদস্যুদের কাছে অসাহায়ত্ব বরণ করেছে। ২০১৩ সালে বিশ^ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলদস্যুতার কারণে বিশ^ অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। মেরিটাইম সিকিউরিটি ফার্ম ড্রায়ার্ড গ্লোবালের তথ্যানুযায়ী, হর্ন অফ আফ্রিকা উপকূল থেকে ভারত উপকূল পর্যন্ত শিপিং অঞ্চলটিতে ২৫টি দেশের নৌবাহিনী সক্রিয় করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে জলদস্যুতা দমনে জাতিসংঘ ১০১ ও ১০২ নং আর্টিকেল অনুমোদন করে। সমুদ্রে জলদস্যুতা এবং সশস্ত্র ডাকাতি দমনে প্রয়োজনীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে ইউএস নেতৃত্বাধীন টাস্ক ফোর্স ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের যৌথ নৌ-অপারেশন আটলান্টার পর জলদস্যুতা ১৩% এর নিচে চলে আসে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জলদস্যুর হামলা কম হলেও ইদানিং আবার জলদস্যুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। জলদস্যুতা চিরতরে বন্ধ করতে হলে সর্বাগ্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যসহ বিশে^র সবচেয়ে সক্ষম নৌবাহিনীর দ্বারা সমন্বয় করে জলদস্যু-বিরোধী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ব্যয়বহুল আত্ম-সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। জলদস্যুদের বিচার ও কারাদ- প্রদানে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। জলদস্যুদের নাম পরিচয় সংগ্রহ করে শাস্তির আওতায় আনতে সোমালিয়া সরকারকে চাপ প্রদান করতে হবে। আঞ্চলিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে জলদস্যুদের বন্দি করতে হবে। এছাড়াও সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সকল জাহাজেই কাঁটাতারযুক্ত প্রতিবন্ধক স্থাপন করতে হবে। জাহাজে গরম পানির কামান প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রতিটি জাহাজে সক্রিয় সাউন্ড গ্রেনেডের সর্বরাহ বাড়াতে হবে। জলদস্যুদের স্পিডবোট থেকে জাহাজে উঠা যায় এরকম সকল অংশে পিচ্ছিল করার ফোম থাকতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য জাহাজের ক্রুদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। সর্বোপরি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এতে করে জলদস্যুতা পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও জলদস্যুদের অতর্কিত হামলা অবশ্যই বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
লেখক: শিক্ষক, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল, শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
“তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে” - মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি সিলেট জেলা যুবদলের
ঘুরে দাঁড়িয়েও জিম্বাবুয়ে অলআউট ১২৪ রানে
অবৈধ পথে ইউরোপের মরণ যাত্রায় তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি: অবশেষে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা
গাজীপুরের ট্রেন দুর্ঘটনায় তিন কর্মচারী বরখাস্ত
কালিয়াকৈর পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় দুই হেলপার নিহত
হিলি ও নবাবগঞ্জে পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় দুই জন নিহত
প্রশ্ন : পুরুষের রূপার আংটি পরিধান প্রসঙ্গে।
ফেলোশিপে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন সামেকের ডা. পলাশ
সহিংসতায় জড়িত ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ব্রিটেনের
ফরিদপুরে দুই সহোদর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বাগেরহাটে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ
রাফায় ইসরাইলের আসন্ন ‘গণহত্যা’ নিয়ে হুঁশিয়ারি জাতিসংঘের
৫০ পেরেনোর আগেই সাত উইকেট নেই জিম্বাবুয়ের!
চিনি রেখে গাড়ি ছেড়ে দিলো বিজিবি
মাওলানা মামুনুল হকের মুক্তিতে ভক্তদের মাঝে উচ্ছ্বাস
কোন দুর্নীতিবাজ রাজাকারকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান_আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন
প্রতিদিন ২০ মে: টন ফিটকিরি উৎপাদন করা সম্ভব হবে: সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান
শিবচর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সীমাহীন অভিযোগ
কুষ্টিয়ায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় পুলিশ কর্মকর্তা নিহত
রাজবাড়ীতে দুই দিনব্যাপী ক্যারিয়ার ফেস্ট