অগ্নিকাণ্ড রোধে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে

Daily Inqilab মো. আরিফ উল্লাহ

০২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫ এএম

চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে একের পর এক মেগা প্রকল্প। কিন্তু দুর্ঘটনা মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সকে কতোখানি আধুনিকায়ন করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিস্তৃত এলাকা নিয়ে মার্কেট, শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। কিন্তু দুর্ঘটনা মোকাবেলায় নেয়া হচ্ছে না পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তাই কিছু দিন পর পর দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রতিবারই আমাদের ভূমিকা নিতান্তই অসহায় মেছো বাঘের মতো, না পারি হুংকার দিতে, না পারি আত্মরক্ষা করতে। অগ্নিকাণ্ড হোক বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা, মোকাবেলায় আমাদের ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সকে হিমশিম খেতে হয়। এই বাহিনীর আত্মত্যাগ ও কর্মদক্ষতা প্রশংসার দাবিদার, কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে, বড় আকারের দুর্ঘটনা মোকাবেলায় যে সকল আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োজন তাতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। এই প্রযুক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এই বাহিনীর এবং সরকারের ভালো কাজগুলো আড়ালে পড়ে যাচ্ছে।

প্রতি বছর হাজার হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে। সেই সাথে রাতারাতি পথে বসে যাচ্ছে হাজারো পরিবার, ভেঙ্গে যাচ্ছে কয়েক যুগের লালিত স্বপ্ন, কেউ হারায় তার মা-বাবাকে, কেউ হারায় তার স্বামী, মা-বাবা হারায় তার সন্তান আর দেশ হারায় অমূল্য কিছু প্রাণ। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যায় ২০২৩ সালে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৭৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ১০২ জন নিহত হয়েছে। অপরদিকে ২০২২ সালে প্রায় ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এসব ঘটনায় মোট ৯৮ জন মৃত্যু বরণ করেছে। এর মধ্যে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্তরের সদস্যও রয়েছে।

আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণগুলো হলো, পূর্বে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার, ভবন তৈরিতে আইন না মানা, বিভিন্ন শিল্প কারখানায় গ্যাস ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের নিয়ম নীতির তাওয়াক্কা না করা, অনিরাপদ রান্নাঘর, সিগারেট ও মশার কয়েল ব্যবহারে অসতর্কতা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা ও থাকলেও প্রশিক্ষণের অভাবে ব্যবহার করতে না পারা। দুর্ঘটনাস্থল থেকে বের হওয়ার বিকল্প রাস্তা না থাকা ইত্যাদি। অন্যদিকে সরু রাস্তা, বাড়ির মালিক বা তত্ত্বাবধায়কের ভুল সিদ্ধান্ত বা গাফিলতি, আশেপাশে জলাশয় বা পানির ব্যবস্থা না থাকা, অতি উৎসাহী মানুষের ভিড় ও কাজে সমন্বয়ের অভাবে আগুন নিভাতে সময়ক্ষেপণ হয়, যার দরুন আগুন আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যায়। বিগত কয়েক বছর ধরে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ থেকে ৩৩০ কোটি টাকা। লক্ষ করা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেইসাথে বেকার হয়েছে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি কর্মজীবী মানুষ।

আমরা যদি ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের বড় আকারের দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর দিকে লক্ষ করি তাহলে এর চিত্র কিছুটা এমন, ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৪টি বড় আকারের দুর্ঘটনায় মোট নিহত প্রায় ১৬৪ জন, যার মধ্যে আশুলিয়ায় স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধ্বসের কারণে ৬৪ জনের প্রাণহানি হয়। ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৪টি দুর্ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ, যেখানে প্রায় ১৩৬টি প্রাণ অকালে ঝরে যায়। এখানে ২০০৬ সালে কেটিএস টেক্সটাইল মিলে (চট্টগ্রাম) আগুন লাগার ঘটনার কথা না বললেই নয়। এ ঘটনায় প্রায় ৬৫ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩টি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যেখানে প্রায় ১২৫০টি প্রাণহানি হয়, ২০১৩ সালের সেই রানা প্লাজা নামক মৃত্যুপুরীর কথা মনে পড়লে আজো আমাদের সকলের চোখে পানি চলে আসে। এতে প্রায় ১১৩৮ জন মারা যায়। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার সম্মুখীন এদেশের মানুষ ইতিপূর্বে আর কখনো হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৬টি দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে ১২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। এসময়ে পুরান ঢাকার একটি এলাকায় প্রাণঘাতী অগ্নিকান্ডে প্রায় ৭০ জনের প্রাণহানি হয়। ২০২১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ১৫৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত কমপক্ষে ২১টি অতিমারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে প্রায় ১৮২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে।

আমরা প্রতি বছর এমন দুর্ঘটনার চিত্র ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পেয়ে থাকি। গণমাধ্যমগুলো প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমাদেরকে সামনে উপস্থাপন করে, আমরা নিজেরা অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হই, আবার কিছু ঘটনা খোদ আমাদের সাথেই ঘটে কিন্তু কোনো কিছুই যেন আমাদেরকে সচেতন করতে পারছে না।

এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়সমূহ সামনে আসে তার মধ্যে অন্যতম হলো এই খাতে বার্ষিক বরাদ্দ ঘাটতি, সরকারের উচিত এই খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা। ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা জনসংখ্যানুপাতে অপ্রতুল, জনবলও যথেষ্ট নয়। আমাদের কমার্শিয়াল চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের নিয়ম মাফিক ইমারত নির্মাণ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর পর এলাকা ভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে। এছাড়াও শিল্প কারখানা, শপিং কমপ্লেক্স বা বড় বড় মার্কেটের কর্মীদের অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, দাহ্য পদার্থ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়, সে বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে, অগ্নি প্রতিরোধ পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরিয়ে নেয়ার কৌশল বিষয়ে ধারণা প্রদান করতে হবে। উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সে ফাইয়ার ফাইটিং রোবট, ফাইয়ার ফাইটিং ড্রোন, ফাইয়ার এক্সটিংগুইশার বল, স্কাই সেভার, এল ইউ এফ ৬০ ফিয়ার ফাইটিং মেশিন ও স্মোক ডিটেক্টরসহ আরো অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যা আমাদের ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা খুবই কম সময়ে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। আমরা যদি পদ্মাসেতুর মতো এতো বিশাল প্রকল্প সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে পারি, তাহলে এই আধুনিক সরঞ্জাম আমাদের ফায়ার সার্ভিসে যুক্ত করতে পারবো না কেন? কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা দেখি আমাদের পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও উন্নয়ন কর্পোরেশনগুলো তাদের দায় এড়াতে বলে বেড়ায় তারা উক্ত ভবন/মার্কেটটি অনেক আগেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে। এই বলে তারা নিজের সকল দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়। এ সকল প্রতিষ্ঠানকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালনে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আক্রমণের ঝড় তুলেও হারল পিএসজি,১১ বছর পর ফাইনালে ডর্টমুন্ড

আক্রমণের ঝড় তুলেও হারল পিএসজি,১১ বছর পর ফাইনালে ডর্টমুন্ড

মাইশার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

মাইশার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ পুতিনের, ছয় বছর ভোগ করবেন একচ্ছত্র ক্ষমতা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ পুতিনের, ছয় বছর ভোগ করবেন একচ্ছত্র ক্ষমতা

রাত পোহালেই ফরিদপুর ৩ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন

রাত পোহালেই ফরিদপুর ৩ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন

বিএনপির সমাবেশ: সবকিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত দেবে ডিএমপি

বিএনপির সমাবেশ: সবকিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত দেবে ডিএমপি

সোনার দাম এবার ভরিতে বাড়লো ৪৫০২ টাকা

সোনার দাম এবার ভরিতে বাড়লো ৪৫০২ টাকা

সিরি-এ বর্ষসেরা মিডফিল্ডার ফার্গুসন

সিরি-এ বর্ষসেরা মিডফিল্ডার ফার্গুসন

আগামীকাল হরিরামপুর উপজেলা ভোটগ্রহণ : ত্রিমুখী লড়াইেয়র সম্ভাবনা

আগামীকাল হরিরামপুর উপজেলা ভোটগ্রহণ : ত্রিমুখী লড়াইেয়র সম্ভাবনা

স্কটল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে হুইল ও জোন্স

স্কটল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে হুইল ও জোন্স

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর অভিযানে একজন কেএনএফ সদস্য নিহত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর অভিযানে একজন কেএনএফ সদস্য নিহত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার

মেসিদের লিগকে যে পরামর্শ দিলেন ফিফা সভাপতি

মেসিদের লিগকে যে পরামর্শ দিলেন ফিফা সভাপতি

বজ্রপাতে নগরকান্দায় ২১ মাদ্রাসা ছাত্র আহতের ১১ জন এখনও হাসপাতালে

বজ্রপাতে নগরকান্দায় ২১ মাদ্রাসা ছাত্র আহতের ১১ জন এখনও হাসপাতালে

গোদাগাড়ীতে ৩ কেজি ৪শ’ গ্রাম হেরোইনসহ ২ জন গ্রেফতার

গোদাগাড়ীতে ৩ কেজি ৪শ’ গ্রাম হেরোইনসহ ২ জন গ্রেফতার

উপজেলা নির্বাচনে ইভিএমে প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছে মতলব উত্তরবাসী

উপজেলা নির্বাচনে ইভিএমে প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছে মতলব উত্তরবাসী

১ বছরে আদানি গ্রিনের ২৫ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধি

১ বছরে আদানি গ্রিনের ২৫ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধি

শপআপ-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করলেন মামুন রশীদ

শপআপ-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করলেন মামুন রশীদ

টেকসই রাজস্ব নিশ্চিতে করতে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণে ধারাবাহিকতা

টেকসই রাজস্ব নিশ্চিতে করতে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণে ধারাবাহিকতা

সোনালী ব্যাংকের মুনাফা ৮৩ শতাংশ বেড়েছে

সোনালী ব্যাংকের মুনাফা ৮৩ শতাংশ বেড়েছে

ব্যাটারি রিপ্লেসমেন্ট সুবিধা আনলো ভিভো ভি৩০ লাইট

ব্যাটারি রিপ্লেসমেন্ট সুবিধা আনলো ভিভো ভি৩০ লাইট

বাগেরহাটে যুবলীগ নেতাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন আওয়ামী লীগ নেতা

বাগেরহাটে যুবলীগ নেতাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন আওয়ামী লীগ নেতা