ছাত্র রাজনীতির নামে অরাজকতা ও বুয়েটের ছাত্র আন্দোলন

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য শ্রেফ উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট বিতরণ নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত গঠন এবং সমস্যা সমাধানের পথ দেখানো অঘোষিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি, গবেষনার বিষয়বস্তু, শিক্ষাকারিক্যুলাম এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রমের মধ্যে অনেক কিছুর সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদতে সেভাবে গড়ে না উঠলেও জাতির ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের ধারাক্রমে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে গণতন্ত্রের দাবিতে আশির দশক ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক সব ভেদাভেদ ভুলে গণতন্ত্রের পথে জাতিকে নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নিয়েছিল। দৃশ্যত সেই থেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো অদৃশ্য শক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পড়ে। নব্বইয়ের পর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চার পথ ক্রমেই রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনকি সামরিক স্বৈরাচারী শাসনামলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরবর্তি তিন দশকেও ঢাবিসহ দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া যেন জাতিকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু ও দেউলিয়া করে দেয়ারই এক সুগভীর ষড়যন্ত্র। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে সামরিক স্বৈরাচারের ক্ষমতাচ্যুতির পর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-আওয়ামীলীগ সেই ষড়যন্ত্রের অর্গল ভাঙতে পারেনি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের তত্ত্বটি গত দেড়যুগে নানাভাবে জাতির সামনে স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষা কারিক্যুলাম থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় শিক্ষা, মূল্যবোধ, জাতিসত্তার চেতনাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়ে সেক্যুলারিজমের নামে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাবধারাকে আমাদের নতুন প্রজন্মের পাঠ্যসূচিতে ঢুকিয়ে দেয়ার নেপথ্য কুশীলবরা সব সময়ই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এমনকি বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও এ দেশের মুসলমানদের স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থার ধারাকে এতটা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়নি। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর জায়নবাদীদের প্ররোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর পশ্চিমা বিশ্ব ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্বকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনের তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে নতুন সমরকৌশল গ্রহণ করে। পুরনো শিয়া-সুন্নী মতভেদের পাশাপাশি মুসলমানদের মধ্যে কিছু কট্টর, গোঁড়া উপদলীয় ফ্যাকশন বাড়িয়ে তোলার পেছনে বাইরের শক্তির নেপথ্য ভূমিকা রয়েছে। যদিও ইসলামে নাশকতা, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। তবে পশ্চিমা সম্মিলিত ষড়যন্ত্রে উসমানীয় খেলাফত ভেঙ্গে খ-বিখ- করে ভাগাভাগি করে নেয়া, মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনি আরবদের জমি দখল করে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং কয়েকটি রাজপরিবারের জন্ম দিয়ে তাদের মাধ্যমে পশ্চিমা বশংবদ রাজতন্ত্র কায়েমের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ঐক্য ও উম্মাহ চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করার বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে একটি চাপা ক্ষোভ সব সময়ই জাগরুক রয়েছে। সেই সংক্ষোভকে পুঁজি করে ইসলামের গায়ে উগ্র জঙ্গিবাদের লেবেল এঁটে দিতে কাউন্টার টেররিজমের নামে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অণুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। আলকায়েদা, তালেবান থেকে আইএস পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নেপথ্য ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়। নাইন-ইলেভেন বা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় কথিত আল কায়েদার সন্ত্রাসী বিমান হামলার সাথে জায়নবাদী ইহুদিদের কানেকশন ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। সেই ঘটনাকে পুঁজি করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের তকমা লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দুই দশক ধরে সামরিক আগ্রাসন, দখলবাজি এবং ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেটের সুফল পেয়েছে মূলত ইহুদি ব্যাংকার ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিনিয়োগকারীরা। এই বিশাল যুদ্ধবাদী কর্মযজ্ঞের উপজাত ঘটনাক্রম আমাদের মত দেশকেও তাদের কৌশলগত সহায়ক শক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করেছে।

এক সময়ের সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত মার্কিন বৈরী ভারতকে ইসলাম বিদ্বেষী সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে পাওয়া এই শতকে পশ্চিমা ভ’-রাজনীতির একটি বড় কৌশলগত অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও গত দুই দশকের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ এবং চীন-রাশিয়ার নতুন সামরিক-রাজনৈতিক পোলারাইজেশন মোকাবেলায় ভারতের অংশীদারিত্বের সক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিনীদের পাততাড়ি গোটানোর সাথে সাথে ভারতেরও স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে। গত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি সংঘাতে মার্কিন ও পশ্চিমা প্রক্সি মার খেয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। ভারতের প্রভাব কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে চীনের প্রভাব একটুকু খর্ব করতে পারেনি। উপরন্তু চীনের সাথে সীমান্ত যুদ্ধে ভারত আবারো ভূমি হারিয়ে নাস্তানাবুঁদ হয়ে নির্বাক হয়ে গেছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, চীনের সাথে সংঘাতের সময়ে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সমর্থনের পাল্লা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখা গেছে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপের মত দেশের সমর্থন হারানো ও অনাস্থা ভারতের বিজেপি সরকারের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতির চরম ব্যর্থতার দলিল। বিজেপি ক্ষমতা গ্রহণের পর নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশিদের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ মটো গ্রহণ করে সকলকে নিয়ে আঞ্চলিক ঐক্যের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়ন ছিল সম্পুর্ণ বিপরীত। ভারত সরকারের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক নীতি প্রথমেই মুসলমানদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করার পন্থা গ্রহণ করে। কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, অযোধ্যায় ৫০০ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির নির্মাণ, এনআরসি, সিএএ আইন পাস কিংবা গো রক্ষার নামে মুসলমানদের উপর নিপীড়নের ধারাবাহিক প্রবণতা ভারতকে একটি পরিকল্পিত মুসলিম গণহত্যার পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেনোসাইড ওয়াচ কর্তৃপক্ষ বিশেষ বার্তা দিলেও ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা তা কর্ণপাত না করায় ক্রমে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। জেনোসইড ওয়াচের পরিচালক গ্রেগরি স্ট্যানটন সময়ে সময়ে ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। একটি ভয়াবহ দাঙ্গা পরিস্থিতি সামনে রেখে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলেও সাংবিধানিকভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান এককভাবে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলমান জনগোষ্ঠির দেশ ভারতের মুসলমানদের আত্মপরিচয় ও সাংষ্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিলোপের মিশন পুরো উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী হেজিমনির এক্সপেরিমেন্টাল টার্গেট হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে তার গণতান্ত্রিক কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করে একটি গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে ভারতের সমর্থনপুষ্ট বশংবদ শক্তিতে পরিনত করার মাধ্যমে ভারত তার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ হাসিল করার মওকা গ্রহন করেছে। গত দেড় দশকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈষম্য চারগুণ বেড়েছে। ভারতের রেমিটেন্স আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এ সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৭গুণ বেড়েছে।

ভারতের হেজিমনিক এজেন্ডার বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশ অনাস্থা ও প্রতিরোধমূলক অবস্থান গ্রহণ করলেও ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রবাসি কর্মীদের পাঠানো হাজার কোটি ডলারের রেমিটেন্স, গার্মেন্ট রফতানি থেকে প্রাপ্ত আয় ও কর্মসংস্থানের বড় অংশ এখন ভারতীয়দের দখলে চলে গেছে। দেশের রাজনৈতিক বিভক্তি, বিশৃঙ্খলা, শিক্ষাব্যবস্থায় মানহীনতা, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে ভারতীয় প্রভাব তাদের এই বিশাল স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়ক ভ’মিকা রাখছে। দেশের লাখ লাখ যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে অনেকে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বিশৃঙ্খল-অসামাজিক জীবনাচারে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। অনেকে বিপদসঙ্কুল পথে বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে সলিল সমাধি কিংবা বিদেশের কারাগারে বন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। গত দেড় দশকে ১০ লাখ কোটি টাকার বেশি দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। দেশের পুঁজিবাজার, ব্যাংকিং সেক্টর, বীমা সেক্টর, বিদেশি বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এ নিয়ে যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। আন্তর্র্জাতিক নদী আইনের বাধ্যবাধকতা অগ্রাহ্য করে অভিন্ন নদীর উজানে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহার করে আমাদের প্রধান নদনদীগুলোকে কার্যত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে ভারত। নদীতে পানি না থাকায় দেশের প্রধান সেচ প্রকল্পগুলোগুলো কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। ভারতীয় পানি আগ্রাসনে দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতি চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন। গঙ্গার পানিচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ তার হিস্যা পাচ্ছে না। উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা অববাহিকাকে মরুময় করে তোলা হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে মূলা ঝুলিয়ে না অজুহাত দাঁড় করিয়ে তিস্তার পানিচুক্তি ও পানির হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই বঞ্চনায় দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককে চরমভাবে সংক্ষুব্ধ ও প্রচ- ভারতবিরোধী করে তুললে তার দায় ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির ধারক রাজনৈতিক শক্তির। বছরের পর বছর ধরে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে ভারত টালবাহানা করলেও বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন নদী ফেনী নদী থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পানি তুলে নেয়ার সুযোগ দিতে ২০১৯ সালে একটি অন্যায্য পানি চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। অভিন্ন নদী তিস্তার পানি চুক্তির আগে ভারতের স্বার্থে ফেনী নদীর পানি তুলে নেয়ার এই চুক্তি আত্মঘাতী। চুক্তি অনুসারে ভারত ১.৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের কথা থাকলেও কার্যত তারা ৩৬টি বড় পাম্প বসিয়ে ৭২ কিউসেক পানি তুলে নিচ্ছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। মূলত চুক্তির আগে থেকেই তারা অবৈধভাবে পাম্প বসিয়ে ফেনী নদীর পানি তুলে নিচ্ছিল বলে জানা যায়। বুয়েটের মেধাবি শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ফেনী নদীর পানি চুক্তির বিরুদ্ধে ফেইসবুকে একটি মন্তব্য পোষ্ট করেছিল। এ অপরাধে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় বুয়েটের ছাত্রলীগ। নিজ কক্ষ থেকে ডেকে এনে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে এবং নানাভাব সারারাত নির্যাতন করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সহপাঠীর এহেন নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। শুধু ছাত্রলীগ নয়, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরও দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শিক্ষার্থী নির্যাতন, হত্যাকা-, ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা দেশের অন্যতম মেধাবি প্রজন্ম হিসেবে পরিগণিত। তাদের চেতনায় শহীদ আবরার ফাহাদের চিন্তা ও ত্যাগ এক সমুজ্জ্বল বার্তা বহন করে চলেছে। দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয় সংহতি চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাব তাদেরকে একটি সুসংহত প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ করেছে।

মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের কালেক্টিভ ষড়যন্ত্রের মধ্যেও পশ্চিমা বিশ্বের নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বেড়ে চলছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে অনেক মানুষ যেমন ভুল ধারণা নিয়ে বিদ্বেষ পোষণ করছে, একইভাবে কিছু মানুষ কোরানের প্রতি আগ্রহী-অনুসন্ধিৎসু হয়ে শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম পরিচয় ধারণ করতেও দেখা যাচ্ছে। মার্কিন হোয়াইট হাউজেও মুসলমানদের সম্মানে প্রতি বছর ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়। এবার বৃটেনের বার্কশায়ারের ইংলিশ কাউন্টির উইন্ডসর ক্যাসেলের হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। গত ২৪ মার্চ উইন্ডসর ক্যাসেলের মাঠে গণইফতারে সব ধর্মের লোকজনের সমাগম ঘটে। পশ্চিমা বিশ্বে যখন মুসলমানদের রোজা, ইফতার-সেহেরির মত ধর্মীয় সাংস্কৃতিক রীতিগুলোর প্রতি সম্মান দেখিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, তখন ১৮ কোটি মানুষের শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ইফতার আয়োজনকে নিরুৎসাহিত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতারি আয়োজনকে নিষিদ্ধ করার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণইফতারে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে। এসব গণইফতারকে কি সরকারী দলের লোকজন জঙ্গিবাদের উত্থান হিসেবে দেখছেন? বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গণইফতারের সময় ছাত্রলীগের হামলায় শিকার হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের হাতে আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর দেশের সাধারণ মানুষ এবং ছাত্র-শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগ সেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েট ক্যাম্পাস আগের এক দশকের চেয়ে ভালোই চলছিল। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ছাত্রী নিগ্রহ অনেকটা কমে আসায় কিছুটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দিয়ে ভিনদেশি স্বার্থ হাসিলের নেপথ্যের কুশীলবদের কাছে এটা সহ্য হয়নি। ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রোজা রাখছে, গণইফতার করছে, নামাজ আদায় করছে! জঙ্গিবাদের ট্যাগ লাগিয়ে এসব বন্ধ করতে চায় । তারা এসব জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর নামে ছাত্রলীগের অপতৎরতা নতুনভাবে শুরু করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছে। ছাত্ররাজনীতি মানে সব দলমতের সহাবস্থানের রাজনীতি হলে আপত্তির তেমন কিছু ছিলনা। এখনকার ছাত্ররাজনীতি মানে ছাত্রলীগের রাজনীতি, গণরুম, টর্চার সেল, হত্যাকা-, ধর্ষণ ও মাদকের হাটের অলিখিত অনুমোদন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ছাত্রলীগ আদালতে রিট করেছিল, রিটের শুনানি শেষে বুয়েটে ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন আদালত, রায়ের আগেই বুয়েটের ভিসি ড. সত্যপ্রসাদ মজুমদার ছাত্রলীগের রাজনীতি করার অধিকারের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছে। তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। অন্যদিকে, ছাত্রলীগের সাথে সুর মিলিয়ে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বুয়েট শিক্ষার্থীদের জঙ্গি কানেকশন খুঁেজ দেখার কথা বলছেন। এসব মতলববাজি এখন একজন অতি সাধারণ মানুষও বোঝেন। জাতীয় রাজনীতির অগণতান্ত্রিক বাস্তবতা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকার মওকা জারি রাখতে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বুয়েটসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালুর পক্ষেই আমার সমর্থন। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলনিরপেক্ষ ভিসি, প্রশাসন এবং সব ছাত্র সংগঠনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকা-, ধর্ষণ, নির্যাতন-নিগ্রহের সুষ্ঠু বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্যিকার অর্থে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগে শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আক্রমণের ঝড় তুলেও হারল পিএসজি,১১ বছর পর ফাইনালে ডর্টমুন্ড

আক্রমণের ঝড় তুলেও হারল পিএসজি,১১ বছর পর ফাইনালে ডর্টমুন্ড

মাইশার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

মাইশার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ পুতিনের, ছয় বছর ভোগ করবেন একচ্ছত্র ক্ষমতা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ পুতিনের, ছয় বছর ভোগ করবেন একচ্ছত্র ক্ষমতা

রাত পোহালেই ফরিদপুর ৩ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন

রাত পোহালেই ফরিদপুর ৩ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন

বিএনপির সমাবেশ: সবকিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত দেবে ডিএমপি

বিএনপির সমাবেশ: সবকিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত দেবে ডিএমপি

সোনার দাম এবার ভরিতে বাড়লো ৪৫০২ টাকা

সোনার দাম এবার ভরিতে বাড়লো ৪৫০২ টাকা

সিরি-এ বর্ষসেরা মিডফিল্ডার ফার্গুসন

সিরি-এ বর্ষসেরা মিডফিল্ডার ফার্গুসন

আগামীকাল হরিরামপুর উপজেলা ভোটগ্রহণ : ত্রিমুখী লড়াইেয়র সম্ভাবনা

আগামীকাল হরিরামপুর উপজেলা ভোটগ্রহণ : ত্রিমুখী লড়াইেয়র সম্ভাবনা

স্কটল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে হুইল ও জোন্স

স্কটল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে হুইল ও জোন্স

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর অভিযানে একজন কেএনএফ সদস্য নিহত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর অভিযানে একজন কেএনএফ সদস্য নিহত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার

মেসিদের লিগকে যে পরামর্শ দিলেন ফিফা সভাপতি

মেসিদের লিগকে যে পরামর্শ দিলেন ফিফা সভাপতি

বজ্রপাতে নগরকান্দায় ২১ মাদ্রাসা ছাত্র আহতের ১১ জন এখনও হাসপাতালে

বজ্রপাতে নগরকান্দায় ২১ মাদ্রাসা ছাত্র আহতের ১১ জন এখনও হাসপাতালে

গোদাগাড়ীতে ৩ কেজি ৪শ’ গ্রাম হেরোইনসহ ২ জন গ্রেফতার

গোদাগাড়ীতে ৩ কেজি ৪শ’ গ্রাম হেরোইনসহ ২ জন গ্রেফতার

উপজেলা নির্বাচনে ইভিএমে প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছে মতলব উত্তরবাসী

উপজেলা নির্বাচনে ইভিএমে প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছে মতলব উত্তরবাসী

১ বছরে আদানি গ্রিনের ২৫ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধি

১ বছরে আদানি গ্রিনের ২৫ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধি

শপআপ-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করলেন মামুন রশীদ

শপআপ-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করলেন মামুন রশীদ

টেকসই রাজস্ব নিশ্চিতে করতে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণে ধারাবাহিকতা

টেকসই রাজস্ব নিশ্চিতে করতে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণে ধারাবাহিকতা

সোনালী ব্যাংকের মুনাফা ৮৩ শতাংশ বেড়েছে

সোনালী ব্যাংকের মুনাফা ৮৩ শতাংশ বেড়েছে

ব্যাটারি রিপ্লেসমেন্ট সুবিধা আনলো ভিভো ভি৩০ লাইট

ব্যাটারি রিপ্লেসমেন্ট সুবিধা আনলো ভিভো ভি৩০ লাইট

বাগেরহাটে যুবলীগ নেতাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন আওয়ামী লীগ নেতা

বাগেরহাটে যুবলীগ নেতাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন আওয়ামী লীগ নেতা