বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্রই কাম্য

Daily Inqilab ড. মো. নুরুল ইসলাম

২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লব একটি শোষণহীন, বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে প্রায় অর্ধেকই তরুণ ও যুব। তাদের প্রত্যাশা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এই প্রত্যাশা আগেও ছিল। তবে তা ছিল শুধু স্লোগান। প্রায় ৮০০ শহীদ এবং ২০ হাজার মারাত্মক আহত তরুণ ও যুবদের রক্তে রঞ্জিত এই বাংলাদেশকে প্রকৃত স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির দেশ, ভোটাধিকার ও বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। বৈষম্যহীনতা যুগে যুগে সাধারণ মানুষের জীবনে এসেছে। এক সময় অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্র জয় করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করা হতো। ভূস্বামীরা জমি দখল করে সাধারণ মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে জমিতে চাষ করাতো। ইউরোপে কারখানায় মালিকরা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাতো, আর তাদের কাজের বিনিময়ে খুব কম মজুরি দেয়া হতো। পুঁজিবাদীশ্রেণী বা মালিকপক্ষ সব সময় শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে শোষণ করতো। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করা, বিরোধী মতকে দমন করা, জনগণকে ভোট থেকে বঞ্চিত করা, সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা এবং শক্তভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখে সমাজ ও অর্থনীতির উপর কর্তৃত্ব করাকে কর্তৃত্ববাদ বা ফ্যাসিবাদ নামে অভিহিত করা হয়। অপরদিকে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাষ্ট্রকে বুঝায় যা জনগণের সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা দান করে। কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য হল- জনকল্যাণ সাধন, নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা দান, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও বৈষম্য দূর, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ও চাহিদা পূরণ করা ইত্যাদি। জাতিসংঘের ঘোষণা মতে, ‘কোন রাষ্ট্রকে তখনই কল্যণমূলক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে যখন রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, বৈধব্য অথবা অন্য কোনো কারণে জীবিকার্জনের অক্ষমতায় সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে।’ অষ্টাদশ শতাব্দীতে, টমাস পেইনের মতো সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিকরা ন্যায়সঙ্গত সমাজের পক্ষে ছিলেন। তারা এমন একটি রাষ্ট্র বিনির্মানের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে রাষ্ট্র নিজেই সক্রিয়ভাবে তার নাগরিকদের কল্যাণ সুনিশ্চিত করবে। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ সংস্কারক উইলিয়াম বেভেরিজ আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বেভেরিজ রিপোর্ট নামে পরিচিত তার প্রভাবশালী প্রতিবেদন, ‘সোশ্যাল ইন্স্যুরেন্স অ্যান্ড অ্যালাইড সার্ভিসেস’ এ তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থাৎ ১৯৪২ সালে যুক্তরাজ্যে কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তির রূপরেখা তুলে ধরেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সামাজিক বীমা, পূর্ণ কর্মসংস্থান, পারিবারিক ভাতা, সরকারি সাহায্য, জনস্বাস্থ্য সেবা, প্রবীণ ভাতা এবং বিস্তৃত সমাজ কল্যাণ কর্মসূচি প্রণয়ন করা। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহ যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এবং এশিয়া মহাদেশের জাপান এবং সিঙ্গাপুরও তাদের স্বতন্ত্র সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিভিন্ন মডেল গ্রহণ করেছে। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালিদ তাঁর ‘ডবষভধৎব ঝঃধঃব (১৯৬৮)’ গ্রন্থে অতিসংক্ষেপে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছেন, ‘ইহা একটি ভালো সরকার ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি নাগরিকের সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়’। প্রতিটি জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র নাগরিকদের ন্যায়বিচার, সাম্য, সমমর্যাদা, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি সুনিশ্চিত করে।

পতিত শেখ হাসিনা সরকার গণতন্ত্রের মোড়কে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনবার ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করেছে এবং বিরোধী দলকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা দমন করেছে। মোটকথা, নির্বাচনহীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। অর্থাৎ একদিকে শাসকগোষ্ঠী নিজেরা (আওয়ামী লীগ) সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে এবং অপরদিকে বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষকে শোষণ ও নির্যাতন করেছে, যাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এমিল ডুর্খেইম সামাজিক অসমতা বা বৈষম্য বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ গত ১৫টি বছর শেখ হাসিনার গণতন্ত্রের মোড়কে এক স্বৈরশাসককে দেখেছে। স্বৈর সরকার শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করেনি বরং জনগণের ও রাষ্ট্রের অর্থ লুণ্ঠন করেছে, শিক্ষামানের অবনতি ঘটিয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে, চর দখলের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা দখল করেছে। সর্বোপরি গণতন্ত্রের নামে একনায়কতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করেছে। আজকের প্রবন্ধের বিষয়বস্তু হলো ফ্যাসিস্ট সরকারের রেখে যাওয়া রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির ধ্বংস স্তুপ সরিয়ে কিভাবে নতুন এক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, কিভাবে সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা অতিক্রম করে এক দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট ২০২৪ গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, কিভাবে কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে তা আলোকপাত করা।

বাংলাদেশে জুলাই এবং আগস্ট মাসে যে আন্দোলন হয়, তা ছিল মূলত কোটা বিরোধী আন্দোলন অর্থাৎ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ৫৬ শতাংশ চাকরির কোটাবিরোধী আন্দোলন ছিল। যেসব ছাত্র-ছাত্রী স্নাতকসম্পন্ন করে চাকরি খুঁজছিল, তারা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও কোন চাকরি পাচ্ছিল না এবং বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিল। তাদের কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়। অতঃপর আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এক দফার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বেকার থেকে যায়। বিবিএস রিপোর্ট অনুযায়ী (মে, ২০২৪), বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ, যা বাস্তবে এর দ্বিগুণ। বাংলাদেশে যে ছাত্র বা যুব অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তার মূলে রয়েছে এই বেকারত্বের অভিশাপ। সরকারি কর্মকমিশনে নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে জানা যায়, গত ১৫ বছর বিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা প্রায় অর্ধেকেরও বেশি চাকরি পেয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো সরকারি কর্মকমিশনের সিলেবাস। এই ১৫ বছর বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিশেষ করে গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয়াবলি আবশ্যকীয় থাকার কারণে কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদের ডিগ্রিধারীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে, যা চরম বৈষম্যপূর্ণ এবং সরকারি কর্মকমিশনের ব্যর্থতা বলা যায়। সরকারি চাকুরি প্রার্থীদের এক বিশাল অংশ এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার কারণে তাদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এবং আন্দোলনমুখীতার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বর থাকায়, অনেক মেধাবীর চাকরি পেতে বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়েছে। চূড়ান্তভাবে যারা মনোনীত হয়েছে তারাও আবার পুলিশ যাচাইকরণ প্রক্রিয়ায় ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ায় অনেকে বাদ পড়েছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের এই বৈষম্যপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করে একটি সার্বজনীন কারিকুলাম ও নিরপেক্ষ পরীক্ষা পদ্ধতি অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন, যাতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যরা চাকরি পায়।

আমাদের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষায় বিশেষায়িত শিক্ষা চালু রয়েছে। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি ১৪ বছর ধরে চালু রয়েছে। কিন্তু শিক্ষানীতির মূল যে উদ্দেশ্য তা অর্জিত হয়নি। যেসব ক্ষেত্রে এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, তার অন্যতম কারণ ছিল সর্বপর্যায়ের শিশুর জন্য অভিন্ন শিক্ষার কার্যক্রম চালু করা, শিক্ষকদের প্রণোদনা বৃদ্ধি না করা ও জবাবদিহিতামূলক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা না করা ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমাদের দেশে শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের দেড় থেকে দুই শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশে তিন থেকে চার শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা হয়। গত দুই দশকে আমাদের দেশে স্কুল পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, ভবন নির্মাণ এবং শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সাল থেকে অদ্যবধি একই সিলেবাসে পাঠদান করা হচ্ছে। ফলে বাজারের প্রচলিত নোট, গাইড ও সাজেশন বই পাঠ করে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মত দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয় না, শুধুমাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়। কেবলমাত্র সার্টিফিকেট সর্বস্ব ডিগ্রিধারী তৈরি হচ্ছে। ২০১৩ সালে প্রফেসর হারুনুর রশিদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পর সেশনজট নিরসনের নামে ক্রাস প্রোগ্রাম চালু করেন, যা প্রতি ছয় মাস অন্তর শুধুমাত্র পরীক্ষা নিয়ে সেশনজট নিরসনের নামে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ধ্বংসের মুখে ফেলেছে। পরবর্তীতে প্রফেসর হারুনুর রশিদের যোগ্য উত্তরসূরী প্রফেসর মসিউর রহমান ২০২১ সালে উপাচার্য হওয়ার পর তেমন কোন গুণগত পরিবর্তন আনতে পারেননি। বরং বেকারত্ব সৃষ্টি ও অদক্ষ উচ্চশিক্ষার ডিগ্রিধারী তৈরি করে জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় গোয়েন্দা নজরদারি, বংশ পরিচয়, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং আনুগত্যশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৯০০ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ দলীয় মনোভাবাপন্ন। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে কেন্দ্রীয়ভাবে বিজ্ঞাপিত করে নিয়োগ দেওয়ার নজির রয়েছে। এভাবে দেশের প্রধান উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠে শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে জাতির নিরপেক্ষতার জায়গা কোথায় থাকবে, তা ভাববার বিষয়। তদুপরি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক সমস্যা, দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ কর্তৃক দখলদারিত্ব, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিমিত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অভাব, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অভাব, সঠিক ও যোগ্য ছাত্রনেতা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সুতরাং জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১০৩টি। গত ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদ, প্রশাসনিক নেতৃত্ব বিশেষ করে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বোপরি গত ১৫ বছরে এ দেশে শিক্ষামানের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যা সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন।

গত ১৫ বছরে বিচারালয় পুরোটাই আওয়ামী দলীয় বিচার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিচারপতি, এটর্নি জেনারেল এবং আইনজীবী সমিতি সবই দলীয়করণ করা হয়েছে। যোগ্যতা, মেধা, নিরপেক্ষতা ও আইনগত দক্ষতা বিবেচনা করে বিচারপতি ও সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। প্রতিটি অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা আবশ্যক। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও গত ১৫ বছরে আওয়ামী সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সরকার বিরোধীদের দমনই ছিল এর প্রধান কাজ। জেল-জুলুম, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমিতিতে বাধা, গুম, খুন এবং বিরোধীপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে আইন প্রয়োগকারীর কাজ করেছে। পুলিশ বাহিনী, র‌্যাব, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড, আনসার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। আয়না ঘর তৈরি করে সেখানে বিরোধীদলের নেতাদের বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়, যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশেষ করে র‌্যাব গত ১৫ বছরে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে র‌্যাবকে বিলুপ্তি ঘোষণার দাবি উঠেছে। যেসব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হত্যা ও গুমের সাথে জড়িত তাদের বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশেষ কমিশন গঠন করে ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিরোধীদলের উপর নিপীড়ন এবং ভোটের কারচুপিতে সহায়তাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। নিরপেক্ষও যোগ্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নির্বাচন কমিশনার ও সদস্য নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন দেয়া উচিত, যাতে প্রতিটি নাগরিক তার ভোটাধিকার ফিরে পায়। জাতীয় সংসদ গঠনমূলক এবং জনপ্রতিনিধিদের মতামতেই পরিচালনা করা প্রয়োজন। আমাদের মতে, বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীনতার জন্য শেখ হাসিনা কর্তৃক পরিচালিত সরকার ব্যবস্থা দায়ী। এদেশে ১৯৯০ সাল থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ সরকার ছিল, যা প্রকারান্তে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বপূর্ণ সরকার। কিন্তু এই সরকার ব্যবস্থা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। সুতরাং মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হল বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান সংস্কার করা। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা চালু করা। যেখানে উচ্চকক্ষ ‘সিনেট’ এবং নি¤œকক্ষ ‘জাতীয় সংসদ’ নামে পরিচালিত হতে পারে। উচ্চকক্ষ প্রেসিডেন্টের কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং নি¤œকক্ষ জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা আইন প্রণয়ন করবে। তাহলে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও সিনেটের কর্তৃত্বে থাকবেন এবং প্রধানমন্ত্রী (জাতীয় সংসদ দ্বারা নির্বাচিত) নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখবেন।

বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের ইতিহাস, দুর্নীতির ইতিহাস, ঋণগ্রস্ততার ইতিহাস, বিদেশে অর্থপাচার এবং ব্যাংক লুন্ঠনের ইতিহাস, রিজার্ভের ডলার সংকট, ঋণখেলাপি, বেকারত্ব, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা এবং সর্বোপরি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ। এস আলম ও সালমান এফ রহমান কর্তৃক ঋণের নামে যথাক্রমে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৬৩ হাজার কোটি টাকা এবং আই এফ আই সি ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা কুক্ষিগত করা হয়েছে। মেগা প্রকল্পের নামে মেঘা দুর্নীতি হয়েছে। প্রকল্প শুরুর সময় যে ব্যয় ছিল তা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ এবং তিনগুণ হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় সরকারি প্রকল্পের টেন্ডার বরাদ্দ দেয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীদের আর্থিক সুবিধা লাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক, তখন প্রশ্ন আসে তিনি কত কোটি টাকার মালিক? আজ যে পটভূমিতে এই প্রবন্ধটি উপস্থাপন করছি তখন দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেট, নেটওয়ার্ক এবং দুর্নীতির আস্তানা নির্মূল হয়নি। যাদের রক্তের উপর এই পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তাদের রক্তের ঋণ শোধরাতে হলে, তাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত হবে, জনগণ তাদের ইচ্ছেমতো প্রতিনিধি বা সরকার নির্বাচন করবে, শিক্ষার মান উন্নত হবে, সৎ এবং সততার মূল্য ও মর্যাদা অটুট থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় ছাত্র জনতার রক্ত কি বৃথা যাবে? ফ্যাসিজমের মূলোৎপাটন কি হবে? এই প্রশ্নের উত্তর হল নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ, যেখানে জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হবে, নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে, শিক্ষা ব্যবস্থার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। পক্ষান্তরে, জুলাই-আগস্ট এর সকল গণহত্যার বিচার করা এবং শহীদদের রক্তে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা সার্থক করার জন্য জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই কেবল বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ তথা আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। যে রাষ্ট্র দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেবে। অসহায় নারী, প্রবীণ, বেকার ও প্রতিবন্ধীরা ভাতা প্রাপ্ত হবে এবং প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া হবে। আজ এবং আগামীতে এভাবে জনগণের সন্তোষজনক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দিতে পারে নতুন বাংলাদেশের সরকার। কাজটি সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন। কেবলমাত্র দুর্নীতিমুক্ত সরকারি ব্যবস্থাপনা, দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব এবং জনগণের অংশগ্রহণে নতুন বাংলাদেশকে কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস

ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প

আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ

আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ

মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা

মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা

জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু

জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি

ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২

ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়

ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে

গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে