কৃষিকেই প্রধান অবলম্বন করতে হবে
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
বিশ্বের অধিকাংশ দেশই শিল্পে উন্নতি করতে চায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তারা মডেল হিসেবে ধরে নিয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কাছে উন্নয়ন মানেই শিল্পায়নÑ শিল্প স্থাপন এবং শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ। শিল্পায়ন বস্তু সভ্যতার বিবর্তনের এক অনিবার্য ফসল। কাজেই শিল্প, শিল্প উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে কারো পক্ষে বস্তু সভ্যতা সংলগ্ন হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু, সারাদেশকে শিল্পে শিল্পে ভরিয়ে তুলতে হবেÑ এ কথাও কেউ বলবেন না। উৎপাদনের ঐতিহ্যবাহী ম্যানুয়েল ব্যবস্থাকে যান্ত্রিকীকরণ করার কথা বলা যায়, এতে অন্তত যুক্তি দেখানো যাবে। কিন্তু, উৎপাদনের যে বড় সেক্টর কৃষিÑ তার প্রতি উদাসীন থেকে অবহেলায় তাকে রুগ্ন করে তুলে শুধু শিল্পায়নের পিছনে ধাবিত হওয়াটা সুস্থ চিন্তার ফসল নয়। বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়েও বলা যায়, শুধুমাত্র শিল্প-কারখানার সংখ্যা বা শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধিই কোনো জাতির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। সর্বোপরি, শুধুমাত্র শিল্প উৎপাদন এখনো মানুষের জীবন ধারণের একমাত্র নিয়ামক হয়ে উঠতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে এমন ভরসা কম। বরং বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিকে, প্রাকৃতিক বিধি-ব্যবস্থাকে সংরক্ষণের জোর তাগিদ দিচ্ছেন। এমন কথাও বলছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে না পারলে মানব জাতির ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। তাদের মতে, গত দু’শতাব্দীর শিল্প-সভ্যতা গোটা পৃথিবীকে পয়মাল করে ফেলেছে। পৃথিবীর বৃহত্তর অংশ এখন মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন, একুশ শতক হবে প্রকৃতি উদ্ধারের শতক। এসবের বিরোধিতা কেউ করছেন না, বরং, প্রকৃতি রক্ষা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা জোরদার হয়ে উঠেছে খোদ শিল্পোন্নত দেশগুলোতেই।
দরিদ্র, অনুন্নত ও উন্নয়নকামী দেশগুলো কিন্তু প্রকৃতি সংলগ্ন হওয়ার নয়া কর্মোদ্যোগের প্রতি মোটেই দৃষ্টি দিচ্ছে না। তাদের চোখে এখনও শিল্পই জীবন-যাপনের কৃত্রিম যান্ত্রিক উপকরণ সমৃদ্ধ স্বপ্নের জগত। শিল্পোন্নত দেশের লোকজন যখন এই জগত থেকে বেরিয়ে এই বস্তু সভ্যতার কৃত্রিম জগতের সাথে প্রকৃতির সমন্বয় ঘটাতে উঠেপড়ে লেগেছে তখন উন্নয়নকামী দেশগুলো প্রাকৃতিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতির প্রাণবন্ত পরিবেশ বিঘিœত করে বস্তু সভ্যতার কৃত্রিমতায় পৌঁছার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। শিল্পায়নের জন্য কে কত বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ আনতে পারে, এটা এখন এসব দেশের সরকারের যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে উঠেছে বলা যায়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর বদ্ধমূল ধারণা, ঋণ যত বেশি আনা যাবে, দেশ তত বেশি উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে। এ ধারণা জেঁকে বসার আসল কারণটি দুর্নীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত বিদেশি ঋণ যত আসবে, তত বেশি প্রজেক্ট হবে তত বেশি অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিদেশি দান অনুদান তো বটেই এমনকি, ঋণের টাকাকেও উন্নয়নকামী দেশের সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকল মহল মনে করেন মুফতে পাওয়া টাকা। ফলে, শিল্প উন্নয়ন বা উন্নয়ন সত্যিকার অর্থে হয় না, বরং গরিব দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ধনী লোকের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ঋণ আনাটা যে কোনো ক্রেডিটের বিষয় নয়Ñ এই বাস্তবতার প্রতি তাকাবার অবকাশ কারো নেই। প্রায় একই কথা বলা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ আনার ব্যাপারে। কেননা, শিল্পায়নটাই বড় কথা নয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বিনিয়োগ শিল্প বাড়ায় একথা ঠিক, কিন্তু সে শিল্প যদি দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করতে না পারে তাহলে উন্নয়নটা হয় বড়জোর অর্ধেক। আর অর্ধেক উন্নয়ন কোনো উন্নয়ন হিসেবে গণ্য হতে পারে না। আমরা যদি বাংলাদেশের কথাই ধরি, তাহলে দেখা যাবে, কৃষি প্রধান এই দেশটির বেশ কিছু কৃষিপণ্য রয়েছে, যা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হলে যে শিল্পপণ্য উৎপাদিত হবে তা বহির্বিশ্বে পেতে পারে একচেটিয়ে বাজার। কিন্তু, দেশীয় কৃষিপণ্যভিত্তিক শিল্পয়ানের প্রচেষ্টা আশানুরূপ নয়। অথচ, এটা করা গেলে একদিকে, দেশের কৃষিখাতে নয়া প্রাণ সঞ্চার ঘটতো, অন্যদিকে, শিল্পায়নও হতো। এছাড়া, দেশের রফতানি বাণিজ্যও প্রসারিত হতে পারতো। এমন একটা ধারণা এখন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা পাচ্ছে যে, এনজিও কার্যক্রম ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশে তো এনজিও কর্মকা- ভালই চলছে এবং অনেক দিন ধরেই চলছে, কিন্তু উন্নয়ন কতটুকু ঘটেছে, এ প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা নেই। কেননা, এনজিওদের সাফল্যের খবরাদি যতটা প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তাদের ভূমিকার বস্তুগত মূল্যায়ন ততটা হয়নি। আসলে ততটা কেন, কিছুটাও হয়নি। সরকারের দায়িত্ব ছিল নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই মূল্যায়ন করা। কিন্তু তা হয়নি। কেননা, প্রায় সব সরকারকেই বিদেশি দাতাগোষ্ঠীকে তুষ্ট রাখার জন্য কোনো না কোনোভাবে এনজিও তোষণে নামতে দেখা যায়। গ্রামে গ্রামে লক্ষ করলে দেখা যাবে, মানুষজন কৃষির ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে, কৃষি এখন খুবই ব্যয়বহুল উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, কৃষিপণ্যের বাজার তুলনামূলকভাবে বাড়ছে না। অলাভজনক হয়ে ওঠা এই কৃষিখাতে বিনিয়োগ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু, কৃষি এমন একটি খাত যা থেকে হাত গুটিয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। কেননা, মানুষকে খাদ্যশস্যের জন্য কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত থাকতে হবেই। এর বিকল্প এখনো হয়নি, অদূর ভবিষ্যতেও হবে এমন আশা করার কোনো কারণ দেখা দেয়নি। অথচ, ইতোমধ্যে কৃত্রিম সার, বিষাক্ত কীটনাশক ইত্যাদির নির্বিচার ব্যবহার বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোর জমি বিনষ্ট করে ফেলছে, জমির উর্বরতা হ্রাস করে ফেলছে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। আরেকটি ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। আর তা হলো, হাজার বছর ধরে পরীক্ষিত শস্যবীজ হারিয়ে গেছে। সারনির্ভর যে শস্যবীজ উদ্ভাবিত হয়েছে এবং এখন দেদার ব্যবহৃত হচ্ছে তা কতদিন স্থায়ী হবে এবং আদৌ প্রকৃতিনির্ভর হতে পারবে কিনা তা এখনো কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যুগযুগ ধরে যা ছিল নির্ভরযোগ্য তা হারিয়ে গেছে এবং যা এসেছে তা ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয়তা মিটাতে পারে এমন নিশ্চয়তা নেই। সারাবিশ্ব এখন প্রকৃতির কাছে ফিরতে চাচ্ছে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারের তাগিদ উচ্চারিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে জৈব সার ব্যবহারের ফলে আজকের রাসায়নিক সারের উপযোগী শস্যবীজ কতটা কার্যকর হবে, এ প্রশ্নের মীমাংসা এখনো হয়নি। তবু মানব জাতিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকৃতির কাছেই ফিরতে হবে। প্রকৃতি উদ্ধার করতে হবে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে এবং সর্বোপরি নির্ভর করতে হবে প্রকৃতি সংলগ্ন উৎপাদন ব্যবস্থার উপর। আর এজন্যই বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোকে কৃষি খাতের প্রতি হেলাফেলার মনোভাব অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে। কৃষি উৎপাদনকে তার নিজস্ব শক্তির ওপর দাঁড় করাবার উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
দ. আফ্রিকাকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের অভিযানে পাকিস্তান
বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ঝিকরগাছায় মোটরসাইকেল আরোহীকে বাঁচাতে গিয়ে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় নিহত ১, আহত ১৫
হিলিতে বিএনপির উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ
গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের খসড়া তালিকা প্রকাশ
বদলগাছীতে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত
পুঁজিবাজারে অস্থিরতার পেছনে প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের দায় আছে: অর্থ উপদেষ্টা
সা'দ অনুসারী কতৃক হত্যা-তান্ডবের বিচার দাবীতে কটিয়াদীতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল
এক সময় কোরআন ও হাদিসের আলোকে কথা বলা দুরহ ছিল: অতিরিক্ত আইজিপি খোন্দকার রফিকুল
নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত, বৃষ্টি ও শীতে জনজীবনে চরম ভোগান্তি
মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের দখলে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি
মাহফিল থেকে ফেরার পথে ফুলগাজীতে বাস উল্টে আহত ২১
একমাস ধরে চলছে সড়কের গাছ কর্তন, জানেনা প্রশাসন
যানবাহন চালনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে : খুবি উপাচার্য
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাঈদী গ্রেপ্তার
কিশোরগঞ্জ হাওরের অলওয়েদার সড়কের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে: ফাওজুল কবির খান
মোংলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
এবিসির প্রতিবেদন: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়
ফরিদপুরে শিক্ষার্থীকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার চেষ্টা মামলায় দুই আসামি গ্রেপ্তার