অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণ কী চায়
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
বাংলাদেশের জনগণের একজন হিসেবে এবং সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটার কারণে বিসিএসে বঞ্চিত হয়ে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে হাইকোর্টে রিট পিটিশনার হিসেবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা। যদি একাডেমিক ডিসকাশন করি, তাহলে বলতে হবে, আমাদের লাগবে জনকল্যাণমূলক আইন, ন্যায়বিচার ও সুশাসন।
সেজন্য রাষ্ট্রের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হলো, ক্ষমতার ভারসাম্য, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুনিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতিরোধ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বলিষ্ঠ প্রতিরক্ষা, স্বাধীনভাবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারসহ সব গণতান্ত্রিক অধিকার। আজকেই হতে হবে, তা নয়। তবে আমাদের প্রত্যাশাগুলো পূরণের মধ্য দিয়ে একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। এটাই কামনা করছে মানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে।
রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ যথা: আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ। জনকল্যাণমূলক আইনের ফার্স্ট অপশন হলো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত আইন। কেননা, সৃষ্টির জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আইনই কল্যাণকর। একটি ঘড়ি যেমন আর একটি নষ্ট ঘড়িকে ঠিক করতে পারে না, তেমনি সৃষ্টি মানুষ অন্য মানুষের জন্য সঠিক আইন দিতে পারে না। আইন প্রণয়নে মানুষ যেমন মানসিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না, তেমনি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও থাকে অনেক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা। কেউ কি চাইবে, তার নিজের তৈরি আইনের অস্ত্র তার বুকেই আঘাত করুক? ফলে ক্ষমতাসীনরা নিজের দিকে টেনেই আইন প্রণয়ন করে আর প্রতিপক্ষ এগুলোকে কালাকানুন বলে প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং ফার্স্ট অপশন অসাধারণ এবং এদেশের অধিকাংশ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বিশ্বাস না হলে গণভোট দিয়ে যাচাই করা যেতে পারে।
কোনো কারণে ফার্স্ট অপশন ফুলফিল করা না গেলে জনকল্যাণমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ আইন তৈরি করতে হবে। বিদ্যমান আইন সংস্কার করতে হবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে ইসলামী জ্ঞানে পন্ডিত ব্যক্তিদের ওই কমিশনে রাখতে হবে, যেন আল্লাহপ্রদত্ত আইনের সাথে কোনো আইন সাংঘর্ষিক না হয়। পাশাপাশি, আইনগুলো যেন আন্তর্জাতিক মানের হয়, সেজন্য দেশ-বিদেশের আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা ছোট বেলা থেকে শুনে আসলেও বিগত সরকারের সময়ে দেখেছি, কেমন স্বাধীনতা বিচার বিভাগ উপভোগ করেছে। পরের মাসের ৭ তারিখের শুনানি আগের মাসের ২১ তারিখ কার ইশারায় হয়েছে? তার ইশারায় যে আরও কত কিছু হয়েছে, তা বলার সাধ্য আমার নেই। নিয়ম ভেঙ্গে নিয়োগকর্তাদেরও খুশি করার টেনডেনসি বিচারপতিদের যেমন অসততার পথে ঠেলে দিয়েছে, তেমনি নিয়োগকর্তারাও বেপরোয়া গতিতে তাদের দিয়ে যা ইচ্ছা তা নির্ধিদ্বায় করিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে খারিজ করার কুদৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়েছে।
তখন সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষও প্রশ্ন তুলেছে, বিচারপতিদের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেকবোধ নিয়ে। বিচারপতিদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা যেন তারা ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থার পরিত্রাণে যে কোনো মূল্যে ন্যায়বিচার (জাস্টিজ) প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যা ছিল জীবন দিয়ে জুলাই বিপ্লব সফল করা ছাত্র-জনতার অন্যতম প্রধান দাবি। এক্ষেত্রে সেপারেশন অব জুডিশিয়ারিসহ ব্যারিয়ার (প্রতিবন্ধকতা) যা আছে, তা দূর করে জনগণের মনে আশার আলো জ্বালাতে হবে। পাশাপাশি বিচারপতিরা যেন স্বাধীনতা পেয়ে নিজেরাই আবার বেপরোয়া হয়ে না ওঠেন, সেজন্য নজরদারি থাকতে হবে। আমরাও মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদের ভাষায় বলতে বলতে, ‘আইনের শাসন নয়, ন্যায়বিচার চাই।’
শাসন বিভাগ একক ক্ষমতায় চলবে না। এটি হবে ক্ষমতার ভারসাম্যতায় পরিপূর্ণ একটি অনন্য উদাহরণ। শেখ হাসিনা যা করেছেন, অন্যেও তা-ই করলে হবে মানুষ প্রশ্ন তুলবেই। আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ভারসাম্যপূর্ণ প্রশাসন গড়ে তুলবার পথেই আছেন।প্রত্যেক উপদেষ্টা তার মন্ত্রণালয়/বিভাগের সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিতে পারছেন বলে জানতে পেরেছি। বড় কথা হলো, প্রশাসকদের জনগণের খাদেম হিসেবে সেবা দিতে হবে। তাদের প্রথমতঃ জনগণের কাছে এবং চূড়ান্তভাবে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার মানসিকতায় গড়ে ওঠতে হবে।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলো সংবাদপত্র। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্রকে সর্বপ্রথম নির্দেশ করেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান এডমন্ড বার্ক। রাষ্ট্রের মূল তিনটি স্তম্ভ যখন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত হবে, তখন তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ জনসমক্ষে তুলে ধরার মহান উদ্দেশে সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু। অথচ সরকারের তেলবাজিতে পত্রিকার প্রথম পাতা, শেষ পাতা তো বটেই, পত্রিকার কমবেশ অর্ধেক পূরণ হয়ে যেতো। ৫ আগস্টের পর এই ধারা অনেকটা কমেছে। আরও কমাতে হবে।
বিগত সরকারের পোষ্য হওয়ার ফলে কিছু সাংবাদিক আজ কমিউনিটিতে ‘দালাল’ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ পলায়ন করেছেন, আবার গ্রেফতারও হয়েছেন। আজকে স্বার্থের জন্য সাংবাদিক ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত। পলায়নকারী প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে করা কথিত নামজাদা সাংবাদিকদের প্রশ্নের নামে তৈল স্তুতির কথা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। মনে হয়, আর কত নিচে নামতে হবে আমাদের? বিজ্ঞজনদের কথা হলো, সাংবাদিকদের কোন দল থাকবে না। নীতি-আদর্শ থাকবে, ভোটের সময় ভোট দেবেন। একই ব্যক্তি দলের মিছিলেও সামনে, সাংবাদিকদের মিছিলেও সামনে, এমনটা শুধু ঘৃণা সৃষ্টি করে।
সাংবাদিকদের মেরুদন্ড শক্ত করতে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশসহ, সহযোগী সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে সংস্কার করে স্বাধীন সাংবাদিকতার উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। কোয়ালিটি জার্নালিজম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চেহারা না দেখে লেখাপড়া ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। তাহলেই রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দুর্নীতিরোধ করতেই হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সংস্কার করে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন ও পলিসিতে সংস্কার প্রয়োজন হলে দ্রুত তা সম্পন্ন করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে টেক্কা দেয়ার জন্য গঠিত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য ক্যাডারদের সরিয়ে রাহুমুক্ত করতে হবে। দরকার হলে তাদের সনদ ও সিএস, আরএস নাড়া দিতে হবে।
মানুষ দু’মুঠো ভাত খেয়ে শান্তিতে ঘুমোতে চায়। আগে আমরা পড়তাম, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও বিনোদনসহ মৌলিক চাহিদাগুলোর কথা। আর মনেই ছিল না, আসলে বেশি প্রয়োজন কোনটা? এখন মনে হচ্ছে সেটি হলো নিরাপত্তা। আপনি বাঁচলেনই না, তাহলে কার জন্য খাদ্য আর বস্ত্র? এখন গ্লোবালি সবকিছুকে ওয়ান আমব্রেলার (এক ছাতার) নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। বলা হয় যে, ফুড সিকিউরিটি, হেলথ সিকিউরিটি ইত্যাদি। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সংস্কারসহ আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সকল ইনস্টিটিউশনকে সংস্কার করে অপরাধ কমিয়ে আনা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।
সাধারণ মানুষের কাছে দ্রব্যমূল্য সহজলভ্য করতে হবে। চাল, ডাল, আটা, পেঁয়াজ, রসুন, তেল, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি নিত্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুর্নীতিরোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়েছে। শিক্ষা সংস্কারে ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হবে। ন্যায়বিচার পুরোমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমে আসবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এই মুহূর্তে বলিষ্ঠ প্রতিরক্ষা খুব জরুরি। দরকার হলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সামরিক বাহিনীর মতামত নিয়ে বাছাই করা তরুণদেরকে সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া যায়। প্রতিরক্ষার বড় সহায়ক ডিপ্লোমেটিক ও স্ট্রাটিজিক সিদ্ধান্তগুলো হতে হবে নির্ভুল ও বলিষ্ঠ।
এই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, দেশের মানুষকে স্বাধীনভাবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। মানুষের মনে ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা থেকে তাদের নিষ্কৃতি দিতে হবে। জনগণ যখন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে, তখন জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে আবার আসতে বাধ্য হবে। এমন জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
দুবাই মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীর অ্যাওয়ার্ড লাভ
'বরবাদ' সিনেমা শতকোটির গন্ডি পেরিয়ে যাবে! কি বললেন শাকিব?
রাজশাহীর পুঠিয়ায় বাস চাপায় মা ছেলেসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত
দোয়ারাবাজারে ভারতেীয় সীমান্তে ৩০০ বস্তা রশুন আটক করেছে টাস্কফোর্স
রাজশাহীতে নেসকোর ভৌতিক বিল বন্ধসহ নানারকম হয়রানীর প্রতিবাদে বিক্ষোভ
শ্যামনগর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার
যুবদলের উদ্যোগে ৩১ দফা অবহিতকরণে আলোচনা সভা
এমাজউদ্দীন আহমদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বজনীন
বাংলাদেশে সা'দ পন্থিদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে: হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে বক্তারা
ভারত বাধা পেরিয়ে শিরোপা জিততে মরিয়া বাংলাদেশ
দোয়ারাবাজারে ভ্যানের ধাক্কায় শিশু নিহত
গারো পাহাড়ের পানি হাতায় ঘুরতে এসে ভোগা নদীতে ডুবে ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
সিলেট-তামাবিল চার লেন উন্নতিকরণে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ
১০ বছর আগে উধাও মালয়েশিয়া বিমানের নতুন করে খোঁজ শুরু
৯/১১-র ধাঁচে রাশিয়ায় ড্রোন হামলা ইউক্রেনের, বন্ধ বিমানবন্দর
আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
দ. আফ্রিকাকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের অভিযানে পাকিস্তান
পাকিস্তানে তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র হামলা, নিহত ১৬ সেনা
বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ঝিকরগাছায় মোটরসাইকেল আরোহীকে বাঁচাতে গিয়ে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় নিহত ১, আহত ১৫