প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে
০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম
দেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রায় মাস খানেক আগেই প্রাণঘাতী এই রোগের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর মতো বাহক নির্ভর রোগ বেশি ছড়াচ্ছে। এতে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগ যাতে আশঙ্কজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক সচেতনতা সৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রনে যারা প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেই সিটি কর্পোরেশনেও সে কার্যকর অর্থে কেউ নেই। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগেই শঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, এবারে ডেঙ্গু বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের সেই শঙ্কাই প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্য সচিব গত ১১ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। সেদিন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ডেঙ্গুর বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড কর্নার করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের জনবলকে ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছে।
এদিকে, গত ২১ সেপ্টেম্বর মশক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের উদ্দেশে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত তদারকি টিম প্রতিটি অঞ্চলে পরিচালিত কার্যক্রম সঠিকভাবে তদারকি করছে। শিক্ষার্থীসহ অন্য নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে।’ মিরপুর, সেকশন-৬-এর অন্তর্গত বি ব্লক এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলমান ডিএনসিসির সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করার সময় তিনি এসব কথা বলেন।
উল্লেখ্য, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) থেকে একযোগে ডিএনসিসির সব ওয়ার্ডে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচি শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এই বিশেষ কর্মসূচি ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়েছে। এ কার্যক্রম একযোগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে পরিচালিত হয়েছে। বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রমে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং প্রকৌশল বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে এসব ঠিকানার চারপাশে ফগিং এবং লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া বছরব্যাপী স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানায় সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা টেলিফোনে সরাসরি যোগাযোগ করে সচেতনতামূলক পরামর্শ প্রদান এবং কীটনাশক প্রয়োগ প্রদান নিশ্চিত করছে। কীটনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি বছরব্যাপী এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কিত বার্তা-সংবলিত লিফলেট ও স্টিকার বিতরণ, মাইকিং, র্যালি এবং অ্যাডভোকেসি সভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম তদারকির জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিমগুলোর প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু বর্ষা মৌসুমের হলেও এখন এটা সারা বছরের। যদি এখনই ডেঙ্গুর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না গ্রহণ করে তাহলে এবারও তাই হবার আশঙ্কাই বেশি। সেইসঙ্গে এখন গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে। এসব কিছু আমলে নিতে হবে এক্ষুণি।
সেপ্টেম্বরে খুব দ্রুতই এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনকার ডেঙ্গু বিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেল, গত ১ সেপ্টেম্বর ভর্তি রোগী ছিল ৪৭৮ জন; মৃত্যু তিনজনের। ৭ সেপ্টেম্বর রোগী ছাড়িয়ে যায় ১৫ হাজার। ৯ সেপ্টেম্বরে রোগী হয় ১৬ হাজারের বেশি। ১০ সেপ্টেম্বরে মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে যায়; মোট মৃত্যু হয় ১০২ জনের। ১১ সেপ্টেম্বরে রোগী সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৩ সেপ্টেম্বর রোগী ১৮ হাজার ছাড়ায়। ১৫ সেপ্টেম্বরে ছাড়িয়ে যায় ১৯ হাজার।ন ১৭ সেপ্টেম্বরে রোগী ছাড়ায় ২০ হাজার, একদিনের ব্যবধানে ১৮ সেপ্টেম্বরে রোগী ছাড়িয়ে যায় ২১ হাজার, ২০ সেপ্টেম্বরে রোগী হয় ২২ হাজারের বেশি। আর ২১ সেপ্টেম্বরে মোট রোগী সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ হাজার ১০৮ জন আর মোট মৃত্যু দাঁড়ায় ১২৫ জনে। চলতি বছরে মোট রোগী সংখ্যায় নারী রোগীর হার ৩৭ দশমিক চার শতাংশ আর পুরুষ রোগীর হার ৬২ দশমিক ছয় শতাংশ। তবে মৃত্যুতে নারী রোগীর হার বেশি ; ৫৪ শতাংশ দশমিক চার শতাংশ আর পুরুষ মৃত্যুর হার ৪৫ দশমিক ছয় শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরো বছরের তথ্যে দেখা যায়, বছরের শুরুতে অর্থ্যাৎ জানুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয় এক হাজার ৫৫ জন; মৃত্যু হয় ১৪ জনের, ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি হয় ৩৩৯ জন; মৃত্যু হয় তিনজনের, মার্চে রোগী ছিল ৩১১ জন; মৃত্যু পাঁচ জনের, এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪ জন; মৃত্যু দুইজনের, মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ জন; মৃত্যু ১২ জনের, জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ জন; মৃত্যু আটজনের। বছরের মাঝামাঝিতে জুলাই মাস থেকে রোগী বাড়তে থাকে; ছাড়িয়ে যায় দুই হাজারের ঘর। এ মাসে হাসপাতলে ভর্তি হওয়া সংখ্যা দুই হাজার ৬৬৯ জন; মৃত্যু হয় ১২ জন, আগস্টে কয়েকগুণ বেড়ে রোগী হয় ছয় হাজার ৫২১ জন; মৃত্যু ২৭ জন। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম ৩ সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ২৬৭ জন আর মৃত্যু ৪২ জনের।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ হিসাব কেবলমাত্র অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী। তালিকার বাইরের হাসপাতাল, ক্লিনিক, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার ও ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ খেযে রোগীর হিসাব এর বাইরে। এই রোগীদের তথ্য পাওয়া গেলে মোট রোগী ও মোট মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে মন্তব্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। দেশে মোট রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী এবং মৃত্যু ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে। মোট রোগীর মধ্যে পাঁচ হাজার ৭০৫ জন আর মোট মৃত্যুর ৭২ জনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এই বিভাগের মোট রোগী পাঁচ হাজার ৪৩২ জন। তবে দেশের সিটি কর্পোরেশন এলাকার চাইতে সিটি কর্পোরেশনের বাইরের এলাকায় এবারে রোগী বেশি শনাক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আগেই বলেছেন, ডেঙ্গু এখন আর শহুরে রোগী নয়। এটা ছড়িয়েছে পুরো দেশে। আর এটা এখন আর বর্ষা মৌসুমের নয়, বরং পুরো বছরের। তবে বর্ষায় বৃষ্টি হয় বলে তখন ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা বংশ বৃদ্ধি করে বেশি। যে কোনও জমা পানিতে এডিশ ডিম পারে এবং এর প্রজনন বৃদ্ধি হয়। তাই বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কেবল ঢাকা নয়, এখন দেশজুড়ে এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, রোগী সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি হচ্ছে, হবে। মশা মারার কার্যক্রম নেই, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ নেই-দিকনির্দেশনা নেই, হাসপাতালগুলোর পরিচালকরা নেই। ডেঙ্গু কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা ২০২৩ সালেই দেখেছে বাংলাদেশ। গোটা বছরে ৩ লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হয়, তার আগে ২২ বছর মিলিয়েও এত রোগী পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর সংখ্যাটিও ছিল উদ্বেগজনক। যেখানে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ৮৪৯ জনের, সেখানে শুধু ২০২৩ সালেই সংখ্যাটি হয়ে যায় দ্বিগুণ। ২০২৩ সালে কেবল সরকারি হিসেবেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। শতাংশের হিসেবে আক্রান্তদের মধ্যে শূন্য দশমিক ৫৩ জন মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্রতিবছরে ডেঙ্গুতে ১০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে পুরো বিশ্বে মৃত্যু হয় ৫ হাজার ৫০০ জনের বেশি, যার মধ্যে এক হাজার ৭০৫ জনই বাংলাদেশের। চলতি বছর বিশ্বে ৪০ হাজার মানুষ এ রোগে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন।
প্রতিবেশ ও আত্মীয়স্বজনকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদের বাড়ি ঘর ও আশপাশের এলাকা পরিস্কার রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের জ্বর হলে দেরি না করে যতদ্রুত সম্ভব ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। Ñপিআইডি ফিচার
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ব্যর্থতার আবর্তে ম্যান ইউ
যেখানে নাহিদাই প্রথম
যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ডলারে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন জয়
সরকারের সর্বত্র এখনো শেখ হাসিনার দোসররা সক্রিয় : রিজভী
পোশাক খাতে অস্থিরতা
সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনা এত করুণ কেন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের জন্য রহমত স্বরূপ
পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে দুদকের উল্টো সুর কেন
বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য : যুবদল সভাপতি মুন্না
বিএনপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ শনিবার
চলতি পথে
সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ
ডেঙ্গু গল্প
তারেক রহমানের পক্ষে বাবুগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নাজমুল হাসানের গণসংযোগ
অচেনা সুরে
লাতিন কবি রোকে ডালটন’র দুটি কবিতা
কোনো কিছুর উদ্দেশ্যে মানত করলে তা পুরণ না হলে করণীয় প্রসঙ্গে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ শফিকের লাশ দুই মাস পর কবর থেকে উত্তোলন
মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তির খসড়া অনুমোদন
ব্যাপক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্য