সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনা এত করুণ কেন
০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৭ এএম
আপনি কি কখনও দেশের কোনো সরকারি হাসপাতালে রোগী হিসেবে গেছেন? আউটডোরে? কিংবা ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে? নিদেনপক্ষে একজন ভিজিটর হিসেবে ওখানে যাবার অভিজ্ঞতা আপনার হয়ে থাকবে। একজন রোগী হিসেবে যদি আপনি কোনো সরকারি হাসপাতালে জেনারেল বেডে ভর্তি হয়ে থাকেন কিংবা তাঁর এটেনডেন্ট হিসেবে ওখানে অবস্থান করেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে ওখানকার টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আপনার খুব কষ্টকর একটি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
দেশের বিপুল সংখ্যক নি¤œ আয়ের মানুষের চিকিৎসার জন্য শেষ আশ্রয় এই সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোর বিপুল ব্যয়ের তুলনায় সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা একরকম ফ্রি। থাকা-খাওয়ার জন্যও তেমন কোনো খরচ লাগছে না। তবে, হয়তো হাসপাতাল যোগান দিতে না পারলে বাইরে থেকে ওষুধ কেনা লাগতে পারে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও চার্জ দিতে হতে পারে। তবে তা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তুলনায় অনেক কম। এছাড়া, কেউ যদি দেশের কোনো বড় হাসপাতালে ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি দেশের সেরা ডাক্তারদের সেবা পাচ্ছেন। তাঁরা প্রতিদিন এক থেকে দু’ বার রাউন্ডে এসে দেখে যাবেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ওরাই কিংবা তাদের সমকক্ষ পর্যায়ের কেউ হয়তো চিকিৎসা প্রদান করতেন। তবে, হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বেসরকারি হাসপাতালসমূহের মতো আপনার নিজস্ব পছন্দের কোনো চিকিৎসককে ওখানে চিকিৎসা দেয়ার জন্য পাওয়া যাবে না।
এত কিছুর পরেও, যদি না কেউ কোনো কেবিন বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, বরং একজন ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে জেনারেল বেডে তার স্থান হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই মনে হবে, ‘কবে আল্লাহ এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবেন’। দেখা-শুনার জন্য যদি কেউ সাথে থাকেন তারও একই অনুভূতি হবে। কিন্তু, কেন? না, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কোনো অব্যবস্থাপনা বা ঘাটতির জন্য নয়। স্রেফ টয়লেটসমূহের করুণ অবস্থার জন্য। টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা যাবে, দুর্গন্ধের জন্য ঢোকাই যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে, টয়লেট ব্যবহার করার পর যে ফ্লাশ করার ব্যবস্থা রয়েছে, তা কার্যকর নেই। সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কোথাও হয়তো দেখা যাবে, টয়লেটের ফ্লোরে নোংরা পানি জমে আছে। কোথাও বা পানির কলগুলো ঠিক মতো কাজ করছে না। টয়লেট টিস্যু বা হাত ধোয়ার জন্য সাবানের কোনো ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কেউ পেয়ে থাকলে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন। এই দুরবস্থা দেখে শংকা হতে পারে, এখান থেকে নতুন কোনো রোগ বাঁধিয়ে ফিরতে হয় কিনা।
বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, দেখা গেছে, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট, যা অনেক লোক এক সাথে ব্যবহার করে থাকে, সেখান থেকে জন জনান্তিকে নানাবিধ রোগ ছড়াতে পারে। পাবলিক টয়লেটের মাধ্যমে সচরাচর যেসব রোগ বা জীবাণু ছড়াতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে: ই-কোলাই, স্যালমোনেলা, নরোভাইরাস, এমআরএসএ, হেপাটাইটিস এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এমনকি কমন কোল্ড। কিছু ক্ষেত্রে এসব রোগের কারণে তীব্র পেটব্যথা, জ্বর ও শারীরিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে গলা ও ত্বকের সমস্যা দেখা যায়। কখনও কখনও রোগের উপসর্গ সপ্তাহ খানেক স্থায়ী হতে পারে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে এসব রোগের কোনো কোনটির কারণে জীবন সংশয় হতে পারে। খুব গুরুতর নয় এমন ক্ষেত্রেও আক্রান্ত ব্যক্তি অফিস মিস করার মতো যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।
সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, বেশিরভাগ বাথরুমের জীবাণু টয়লেটের সিটে থাকে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, টয়লেটের মেঝে ও অধিক স্পর্শ লাগে এমন পৃষ্ঠসমূহ - যেমন ধরুন সিন্ক, কলের হাতল, হ্যান্ড ড্রয়ার, লাইটের সুইচ, দরজার নবÑ এসবে অনেক বেশি সংখ্যায় জীবাণুর উপস্থিতি থাকে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাবলিক টয়লেটের মেঝেতে প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ২০ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া থাকে। কাজেই, কেউ যদি কোনো কিছু স্পর্শ নাও করেন, তার জুতার তলায় করেও জীবাণু বহন করে নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, মহিলাদের হ্যান্ডব্যাগ যদি টয়লেটের মেঝেতে বা সিন্কের কাউন্টারে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেটার সাথেও জীবাণু বাহিত হতে পারে। একারণে সাথে থাকা জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখার জন্য দরজায় বা দেয়ালে যে অন্তত একটি হুক থাকা দরকার সেটা কেন জানি অনেকের মাথায় আসতে চায় না।
এখন, কেউ যদি টয়লেটের জীবাণু বহন করছে এমন কোনো দূষিত বস্তু বা পৃষ্ঠ স্পর্শ করেন, পরে ঠিক মতো হাত না ধুয়ে ঐ হাত ব্যবহার করে খাবার প্রস্তুত বা গ্রহণ করেন, তাহলে হাতে থাকা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন। এ ধরনের খাবার অন্য কেউ গ্রহণ করলে সেও সংক্রমিত হতে পারে। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ফ্লাশ করার সময় চারিদিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়া পানি নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলেও জীবাণুতে সংক্রমিত হতে পারেন। কাজেই, বুঝা যাচ্ছে, পাবলিক টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, এর মেঝে, দরজা ইত্যাদি নিয়মিত বিরতিতে জীবাণু মুক্ত করা এবং টয়লেটের বাতাস দূষণ মুক্ত রাখা টয়লেট বাহিত রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের মতো জায়গায় এর গুরুত্ব সমধিক, কারণ, এখানে নানা রকমের রোগ ব্যাধি নিয়ে অসংখ্য মানুষ এসে থাকেন।
দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ব্যবস্থাপনার যে করুণ চিত্র আমরা উপরে তুলে ধরেছি তা থেকে বেরিয়ে আসা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয়। টয়লেট ব্যবস্থাপনার করুণ দশার একটি কারণ হতে পারে, এসব হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়ে থাকেন। হতে পারে, টয়লেটসমূহ যত সংখ্যক লোক ব্যবহার করে তার তুলনায় ক্লিনিং স্টাফ সংখ্যায় অপ্রতুল। ঢিলেঢালা প্রশাসন এবং অপর্যাপ্ত নজরদারিও কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। প্রশ্ন হলো, দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি একটা ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন স্যানিটেশন সিস্টেম মেইনটেন করা যায়, তাহলে সরকারি হাসপাতালসমূহে করা যাবে না কেন?
দেশে যানবাহনের ব্যস্ত রুটসমূহ, যেমন ধরুন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিপুল সংখ্যক যাত্রীর রিফ্রেশমেন্টের জন্য মাঝপথে যানবাহনসমূহ যাত্রাবিরতি করে থাকে। সেখানে এই বিপুল সংখ্যক যানবাহনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের প্রায় সকলেই বিরতিকালীন রেস্টুরেন্টের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। কদাচিৎ দেখা যাবে, এগুলো ঠিক মতো পরিষ্কার করা হচ্ছে। হজ্বের সময় লক্ষ লক্ষ হাজি কাবা শরীফ ও মসজিদে নববীর টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোর ক্লিনিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো রকম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া না। তাহলে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ, যেগুলো বড় জোর দৈনিক কয়েক শ’ থেকে কয়েক হাজার লোক ব্যবহার করে থাকেন, যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এত কঠিন হবে কেন? ক্লিনারদের সংখ্যা অপ্রতুল হলে তাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। স্থায়ীভাবে ক্লিনারদের সংখ্যা বাড়ানো না গেলে প্রয়োজনে খ-কালীন ক্লিনার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এটার জন্য বাজেট সংকট হবার কথা নয়। আর যদি হয়েও থাকে, উন্নত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে রোগীরা আলাদা চার্জ যোগাতে সানন্দে রাজি হবেন বলে আমার বিশ্বাস। শুধু জরাজীর্ণ টয়লেট ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহ উন্নত চিকিৎসা সেবা দিয়েও যে মারাত্মক ইমেজ সংকটে আছে, সে বিষয়টি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নওগাঁর আত্রাই পৈসাতা গ্রামে ৩জনকে পিটিয়ে জখম আহতদের উদ্ধার করে ৯৯৯ পুলিশ
মাদারীপুরে গুড়ি বৃষ্টি আর হিমেল বাতাসে জনজীবন স্থবির
দুমকীতে বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফনে বাঁধা
দুবাই মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীর অ্যাওয়ার্ড লাভ
'বরবাদ' সিনেমা শতকোটির গন্ডি পেরিয়ে যাবে! কি বললেন শাকিব?
রাজশাহীর পুঠিয়ায় বাস চাপায় মা ছেলেসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত
দোয়ারাবাজারে ভারতেীয় সীমান্তে ৩০০ বস্তা রশুন আটক করেছে টাস্কফোর্স
রাজশাহীতে নেসকোর ভৌতিক বিল বন্ধসহ নানারকম হয়রানীর প্রতিবাদে বিক্ষোভ
শ্যামনগর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার
যুবদলের উদ্যোগে ৩১ দফা অবহিতকরণে আলোচনা সভা
এমাজউদ্দীন আহমদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বজনীন
বাংলাদেশে সা'দ পন্থিদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে: হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে বক্তারা
ভারত বাধা পেরিয়ে শিরোপা জিততে মরিয়া বাংলাদেশ
দোয়ারাবাজারে ভ্যানের ধাক্কায় শিশু নিহত
গারো পাহাড়ের পানি হাতায় ঘুরতে এসে ভোগা নদীতে ডুবে ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
সিলেট-তামাবিল চার লেন উন্নতিকরণে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ
১০ বছর আগে উধাও মালয়েশিয়া বিমানের নতুন করে খোঁজ শুরু
৯/১১-র ধাঁচে রাশিয়ায় ড্রোন হামলা ইউক্রেনের, বন্ধ বিমানবন্দর
আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
দ. আফ্রিকাকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের অভিযানে পাকিস্তান