অস্তিত্বের সংকটে মাদরাসা শিক্ষা
১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
আমাদের দেশে মাদরাসা শিক্ষা বলতে বুঝায় এমন শিক্ষাব্যবস্থা, যার সমস্যার অন্ত নেই। তিক্ত বাস্তবতা হচ্ছে, এ পর্যন্ত এই শিক্ষায় বিরাজমান সমস্যাদি নিরসন ও মানোন্নয়নের চিন্তার চেয়ে সংস্কারের চিন্তাই বেশি হয়েছে। ফল হয়েছে, লোম বাছতে বাছতে কম্বল উজাড়। যেমন অতীতে এই সংস্কার প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার অস্তিত্বই ধ্বংস হয়ে গেছে, বড় বড় মাদরাসা স্কুল কলেজে পরিণত হয়েছে।
আফসোসের বিষয় হলো, আমরা যারা মাদরাসা শিক্ষার সংস্কারের কথা বলি, তারা এই শিক্ষার অস্তিত্বের দর্শন সম্পর্কে মোটেও সচেতন বলে মনে হয় না। একটি বাড়ি, দালান বা গাছ দাঁড়িয়ে থাকে মাটির ভিত্তির উপর। কোনো প্রতিষ্ঠান, দল বা মতাদর্শও টিকে থাকে নিজস্ব উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও দর্শনের উপর। এই দর্শন যদি ভুলে যাওয়া হয় তাহলে পুরো জিনিসটির অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমার এই জীবনে অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও অন্তত চারটি বই লিখে জাতিকে, বিশেষ করে যারা মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করেন, তাদেরকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। বলতে চেয়েছি যে, মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্বের দর্শন হলো, আলেম তৈরি, যুগ জিজ্ঞাসার জবাব দানের উপযুক্ত ইসলামী বিশেষজ্ঞ ও মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ইলম ও আমলে সজ্জিত জ্ঞানী সৃষ্টি করা।
মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্বের দর্শন সম্পর্কে ঔদাসীনতার কারণে অনেক রকমের সমস্যা ইসলামের প্রাচীনতম এই শিক্ষা ব্যবস্থার হাতেপায়ে জিঞ্জির হয়ে আছে। যেমন- আলিয়া নেসাবের মাদরাসাসমূহের উপরের স্তরে যেসব মাদরাসায় অনার্স খোলা হয়েছে সেখানে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। অথচ, অনেক উপযুক্ত শিক্ষক মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত আছেন, অনেক এম ফিল ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক, যারা বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন, তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও পদায়ন করা হচ্ছে না। বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। তাদের উপস্থিতিকে যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হতো তাতেও মাদরাসা শিক্ষার পরিচালনা ও পঠন-পাঠনে বড় রকমের উন্নতির আশা করা যেত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের নিয়োগ, পদায়ন, মানোন্নয়নের ব্যাপারে চরম ঔদাসীনতা দেখানো হচ্ছে। ফল দাঁড়িয়েছে, অনেক মাদরাসায় ফাজিল-কামিলে কার্যত কøাস হয় না। পরীক্ষায় নকল চালাচালি রোধ করা যায় না।
আমার ক্ষুদ্র একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার বাড়ি দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নে। ইরানে প্রবাস জীবন হতে ফিরে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে একটি মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলাম নব্বই-এর দশকের শুরুতে। স্থানীয় জনগণের প্রাণ উজাড় করা সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত ‘খাদিজাতুল কুবরা মহিলা মাদরাসা’ এখন দাখিল স্তর পর্যন্ত এমপিওভুক্ত। চারতলা সরকারি ভবন পেয়েছে। বর্তমান কমিটিতে আমার নাম না থাকলেও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হওয়ার সুবাদে গ্রামের বাড়িতে গেলে মাদরাসার খোঁজ খবর নিয়ে থাকি। এবারে মাদরাসা কীভাবে চলছে জানতে চাইলে শিক্ষকরা জানালেন, সামনের বছর দাখিল পরীক্ষার্থী ৩৫ জন। কিন্তু শিক্ষকের অভাব। ৫ জন শিক্ষকের পোস্ট খালি। একজনের চাকরিচ্যুতি নিয়ে কেইস চলছে। বাকীদের নিয়োগের জন্য অনেক জটিলতা। বিএসসি শিক্ষক নেই। বর্তমান ৮/৯ জন শিক্ষককে বাকী ৫ জনের অভাব পূরণ করতে হচ্ছে। অতীতে মাদরাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ স্থানীয়ভাবে হতো। সবচে মেধাবী ছাত্রটিকে মাদরাসার শিক্ষকতায় ধরে রাখা হতো। এমপি বা রাজনীতিকদের নিয়োগ বাণিজ্য ছিল না। মাদরাসা প্রধান চাইলে সরাসরি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারতেন। এখন নিবন্ধনের পারাপার পার হয়ে আসতে হয়, বাস্তবতার সাথে যার মিল নেই।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী মাদরাসায় গিয়েছিলাম। শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময়ের জন্য আহ্বান পেয়ে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, একটি কামিল মাদরাসায় অর্ধেকের মতো মহিলা শিক্ষিকা। মহিলাদের মধ্যে হাদিস তাফসীরে অভিজ্ঞ এবং শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত আলেমার প্রাচুর্য দেখে অবাক হলাম। কিন্তু না। জানা গেল, সরকারি নির্দেশে ৩০% মহিলা শিক্ষিকা বাধ্যতামূলক। ফলে স্বীকৃতি বা বেতন-ভাতা ঠিক রাখার প্রয়োজনে যেন-তেনভাবে মহিলা কোটা পূরণ করতে হয়েছে। জ্ঞানে বা অভিজ্ঞতায় উত্তীর্ণ না হলেও মাদরাসার আশপাশের মেয়ে-বউঝি ইত্যাদি দিয়ে কোটা পূরণ করা হয়েছে। ফলে অতীতে মাদরাসা শিক্ষায় ছাত্রশিক্ষকের যে সম্পর্ক বা জ্ঞান সাধনায় বুজুর্গ উস্তাদগণের সার্বক্ষণিক যে খেদমত তার নামনিশানা অধিকাংশ মাদরাসায় আছে বলে মনে হয় না। অবিলম্বে মাদরাসার শিক্ষক প্যাটার্নের এই সংকট ও জটিলতা নিরসন বিশেষ করে মহিলা শিক্ষক কোটা বাতিল করা না হলে পরিণতি নির্ঘাত নিউস্কিম মাদরাসার মতো হবে।
আমি কামিল হাদিস পাশ করার পরপর লোহাগাড়া ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসায় হেড মওলানা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলাম ১৯৭৭ সালের শেষ ভাগে। তারপর তো অনেক জায়গায় বিচরণ করতে হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের বলতে চাই; এমন এমন সমস্যা ও সংকট সরকারি আলিয়া নেসাবের মাদরাসাগুলোকে হুমকি দিচ্ছে, যা এখনই প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে গোটা মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হয়তো বর্তমান শিক্ষক মহোদয়গণ চাকরিতে বহাল থাকবেন; কিন্তু মাদরাসার অস্তিত্ব থাকবে না, নতুন কেউ নিয়োগ পাবেন না।
আরো দু’একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করতে চাই, যেগুলোর সাথে মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্ব গভীরভাবে জড়িত। এখানে প্রধানত আলিয়া নেসাবের মাদরাসাগুলোর কথাই বলছি। মূলত কওমি মাদরাসাগুলোর জন্যও এগুলো অশনি সংকেত। কারণ, তারাও যে পথে হাঁটছে তা হুবহু আলিয়া মাদরাসার অতীতের পরিত্যক্ত পথ।
স্কুল-কলেজের ফিডিং প্রতিষ্ঠান হলো প্রাইমারি স্কুল। মাদরাসার ক্ষেত্রে ইবতেদায়ী মাদরাসা। শুরু থেকেই এই ইবতেদায়ী মাদরাসা চরম অবহেলার শিকার। দেশের প্রাইমারি স্কুলগুলো শতভাগ সরকারি, শিক্ষকদের বেতন ভাতার পরিমাণ যা, তার সাথে ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন ভাতার তুলনাই করা যাবে না। প্রাইমারিতে ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি দেয়া হয়, ইবতেদায়ীতে তার ব্যবস্থা নেই। ফলে নিচের দিক থেকে মাদরাসা ছাত্রছাত্রী পাচ্ছে না। যদি এ অবস্থা চলতে থাকে মাদরাসার দাখিল স্তর এবং পরবর্তী আলিম, ফাযিল ও কামিল স্তরের জন্য ছাত্র জোগান আসবে কোত্থেকে। কাজেই মাদরাসার ছাত্রছাত্রীর জোগান অবারিত রাখার স্বার্থে ইবতেদায়ী স্তরে শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য প্রাইমারির অনুরূপ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এই দাবিটি মাদরাসার অস্তিত্বের প্রশ্নের সাথে জড়িত।
আরেকটি সমস্যা আদর্শিক। ঢাকার বখশিবাজার সরকারি আলিয়া মাদরাসার সুতিকাগার ছিল কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা। কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল ইংরেজরা। ইংরেজরা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন। ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিল ইংরেজ এবং খ্রিস্টান। আলিয়া মাদরাসার বিরুদ্ধে একটি বয়ান আমরা ছোটবেলা থেকে বিষোদ্গার হিসেবে শুনে আসছি। তাহলো ইংরেজরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছিল। এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রকৃত অবস্থাটি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আ¤্রকাননে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলার মসনদ কেড়ে নিয়েছিল ইংরেজ বেনিয়ারা। তারপর একের পর এক অঞ্চল জয় করে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের ব্যর্থতার পর দিল্লীর মসনদ দখল করেছিল তারা। বাংলা জয়ের পর ইংরেজরা এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে, যার ফলে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠে। তখন মুসলিম নেতারা জাতির এহেন ভাগ্য বিপর্যয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। মুসলমানরা রাজত্ব ও শাসন ক্ষমতা হারানোর পর নিজের ঈমান ও সাধারণ ধর্মকর্মও হারিয়ে ফেলবেন বলে শংকিত হয়ে পড়েন তারা। ইতোমধ্যে কলিকাতায় একজন আলেম আসেন, যার নাম মোল্লা মজদুদ্দিন। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন ধর্মীয় বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। কলিকাতার মুসলমানরা চাইল, মোল্লা মজদুদ্দিন মুসলমান ছাত্রদের অন্তত ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষাটুকুন যেন প্রদান করেন। কলিকাতার মুসলিম নেতারা চিন্তা করলেন ইংরেজদের দখলদারিত্বে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরসে নিজামী সীমিত আকারে হলেও চালু করার একটা সুযোগ এসেছে। কিন্তু ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া তো এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা মোল্লা মজদুদ্দিনের দরস শুরু করা সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে কলিকাতার মুসলিম নেতারা সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে ইংরেজ গভর্নরের কাছে দরখাস্ত করেন, যাতে মোল্লা মজদুদ্দীনের মাধ্যমে মুসলমান ঘরের সন্তানদের ন্যূনতম ইসলাম ধর্ম শিক্ষার অনুমতি প্রদান করা হয়। এর পক্ষে ইংরেজ সরকারের জন্য লাভের কথাও তারা তুলে ধরেন। তা হলো, এই মাদরাসায় শিক্ষিতরা পুলিশ বাহিনী ও আদালতে জুরির কাজ করতে পারবে। ইংরেজরা রাজ্যহারা মুসলমানদের পুনরুত্থানের ব্যাপারে শংকিত ছিল। শেষ পর্যন্ত এই শর্তে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিল যে, এর প্রিন্সিপাল থাকবে ইংরেজ এবং শিক্ষাদীক্ষা তত্ত্বাবধান করবেন একজন মুসলিম মৌলভী। তার উপাধি হবে হেড মওলানা। মরহুম মওলানা উবায়দুল হক ছাহেব ছিলেন আলিয়া মাদরাসার সর্বশেষ হেড মওলানা। তারপর থেকে হেড মওলানা পদটি ভাইস প্রিন্সিপালে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া যেখানে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব ছিল না, সেখানে ইংরেজদের শর্ত মেনে মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকে কেউ কি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করতে পারে ? এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা ১৯৮০ সালে লেখা ও ১৯৯০ সালে পুনর্মুদ্রিত ‘মাদরাসা শিক্ষা কোন পথে’ বইতে সবিস্তারে আলোচনা করেছি। এই তথ্যগুলোর মূল সূত্র উর্দু ভাষায় মওলানা আব্দুস সাত্তার প্রণীত ‘তারিখে মাদরাসাই আলিয়া’ গ্রন্থ, যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়।
অপর যে বিষয়টি মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্বকে বারবার হুমকির সম্মুখীন করছে, তাহল মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন সম্পর্কে এক ধরনের উন্মাদনা। সমস্যাটি কত গভীর তা বুঝার জন্য একটি ঐতিহাসিক তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ১৮৭৫ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং তখন একশ্রেণির আলেমের মধ্যে চেতনা জাগ্রত হয় যে, দরসে নেজামীতে পরিচালিত কলিকাতা আলিয়া মাদরাসাকেন্দ্রিক মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন করতে হবে। সেখানে স্কুল ও কলেজের সিলেবাস বই-পুস্তক চালু করতে হবে। মাটিতে বসে দরস দেয়া যাবে না, চেয়ার ও টুলের ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গত কারণেই বুজুর্গ উস্তাদগণ এই প্রস্তাবনার বিরোধিতা করেন। তাতে আলেমদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেন সিলেটের বিদগ্ধ আলেম মওলানা আবু নসর ওয়াহিদ। শেষ পর্যন্ত মাদরাসায় দুটি ধারা প্রবর্তিত হয় ওল্ড স্কিম ও নিউ স্কিম নামে। শুধুমাত্র সিলেট ও শর্ষীনা আলিয়া এবং কলিকাতা আলিয়ার প্রধান অংশ ছাড়া সব মাদরাসা নিউ স্কিম পদ্ধতি গ্রহণ করে, সরকারি বেতন-ভাতা অনুদান লাভ করে এবং বড় বড় জ্ঞানী মনীষী বের হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস, ড. আলিম আল রাজি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ প্রমুখ এই নিউ স্কিমের ছাত্র ছিলেন। নিউ স্কিমের উন্নত সিলেবাস সম্পর্কে কারো সমালোচনার কথা আমার জানা নেই। কিন্তু বাস্তব অবস্থা দাঁড়ায়, নিউ স্কিম মাদরাসাগুলো এক পর্যায়ে স্কুল ও কলেজে পরিণত হয়ে যায়। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকার এক ঘোষণার মাধ্যমে এগুলোকে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ঢাকার নজরুল কলেজ ছিল নিউ স্কিম মাদরাসা, তা কলেজে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন আল্লামা উবায়দুল্লাহ উবায়দী, তার চেয়ে বড় জ্ঞানী লোক ঢাকায় এ পর্যন্ত দ্বিতীয়জন জন্মগ্রহণ করেছেন কিনা জানা নেই। পুরান ঢাকার হাম্মাদিয়া স্কুলও ছিল এক সময়ের মাদরাসা। মওলানা জাফর আহমদ উসমানী হাম্মাদিয়া মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন। চট্টগ্রামের মহসিন কলেজ ছিল তখনকার দিনের মুহসেনিয়া মাদরাসা। চট্টগ্রামের অনেক বুজুর্গ ব্যক্তি এই মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। ভোলার এ রব হাই স্কুলও ছিল মাদরাসা। পরে ভোলা দারুল হাদিস কামিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হলে প্রতিবাদী আলেমগণ সেখানে আশ্রয় নেন। এভাবে সারাদেশে ১০৯৪টি মাদরাসা স্কুল ও কলেজে রূপান্তরিত হয়ে যায় বলে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়।
এ সম্পর্কে আমি প্রচুর লিখেছি। আজকে ছোট্ট পরিসরে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে জাগ্রত ভাইদের, মাদরাসা অঙ্গণে বিচরণরত উচ্চতর ডিগ্রিধারী ভাইদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট মনে করি। নির্মোহভাবে চিন্তা করলে দেখতে পাবেন, বর্তমানে আলিয়া মাদরাসাগুলোতে এ ধরনের পরিস্থিতি ভয়াবহভাবে বিরাজ করছে। উপরের ক্লাসগুলোতে ছাত্রছাত্রী থাকলেও উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। আবার শিক্ষক থাকলে ছাত্রের অভাব। ছাত্ররা মাদরাসার চেয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। চলে যাচ্ছে। দাখিল স্তরে স্কুলের সব বই সিলেবাসভুক্ত। মাদরাসায় তার উপর আরবির জন্য কিছু অতিরিক্ত বই চাপানো হয়েছে। ছাত্রদের প্রশ্ন, এত বই আমরা পড়ব কেন।
কওমি মাদরাসার সচেতন ভাইদের বলব, আপনারাও সচেতন হোন। কওমি মাদরাসার সুতিকাগার দেওবন্দ মাদরাসা। দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলিকাতা আলিয়ার প্রায় ১০০ বছর পরে ১৮৬৬ সালে। দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার দর্শন ছিল সরকারি বরাদ্দ ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে কওম তথা সাধারণ জনগণের সাহায্যের ভিত্তিতে দ্বীনি ইলম চর্চা। সিলেবাস ছিল আলিয়ার একই ধরনের। অর্থাৎ দরসে নিজামীর কিতাবসমূহ। এখনো আলিয়া ও কওমি উভয় ধারার মূল কিতাবসমূহ অভিন্ন দেখবেন। আমার কথা আপনাদের মনপুত নাও হতে পারে। কারণ, বাহ্যত আমি কওমি ঘরাণার নই। যদিও এক সময়ে পটিয়া মাদরাসায় আল্লামা সুলতান যওক নদভী হুজুরের শিষ্যত্বের দাবি আমি বহন করে চলি। আপনারা মরহুম সদর সাহেব হুজুর মওলানা শমসুল হক ফরিদপুরি ছাহেবের একটি পুস্তিকা পাঠ করার জন্য বড়জোর ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করুন। এটি তার নিজস্ব কিতাব নয়, বরং ফিলিস্তিনের তৎকালীন গ্র্যান্ড মুফতি আমিনুল হুসাইনী করাচির দারুল উলুম মাদরাসায় যে ভাষণ দিয়েছিলেন সে ভাষণ তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ‘শত্রু থেকে হুঁশিয়ার’ শিরোনামে। ইংরেজরা পঁচিশ বছরের ব্যবধানে মিসর থেকে কীভাবে ইসলামী শিক্ষা বিলুপ্ত করেছিল তার করুণ কাহিনী ব্যক্ত হয়েছে এই পুস্তিকায়। খাদেমুল ইসলাম জামাত প্রকাশিত বইটি বিশ্বকল্যাণ প্রকাশনা থেকে প্রকাশ হয়েছে বলে জানি। আলিয়া মাদরাসার করুণ অবস্থার জন্য মনে মনে প্রীত হয়ে লাভ নেই। যদি এখনই সতর্ক না হন, এই পরিণতি আপনাদের জন্যও অপেক্ষা করছে।
লেখক : পরিচালক
বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি
শিখ নেতা হত্যা, মোদীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ কানাডার
দলীয় ভিত্তিতে প্রশাসন সাজিয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না: এ এম এম বাহাউদ্দীন
আদানির সঙ্গে জড়িত মোদিও: রাহুল গান্ধী
আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ২৫ নভেম্বর ঢাকায় আসছেন
সোহেল-টুকু-হেলালসহ খালাস পেলেন বিএনপির ২২ নেতাকর্মী
ইরানে উদ্ভাবনে নারীদের অবদান ২৪ শতাংশের বেশি
প্রকাশায় ৯৩ শতাংশ নকল করেও পদোন্নতি পান রাবি অধ্যাপক সাহাল উদ্দিন
বোরহানউদ্দিনে নিখোঁজের দুই ঘন্টা পর লেবু বাগানে মিললো শিশুর লাশ
নাবালক ছাত্রের সঙ্গে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম, ৩০ বছরের জেল শিক্ষিকার
সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ
মার্কিন সংসদের নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন না রূপান্তরকামী এমপি
বাগেরহাটে হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড
অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন জিওসি
কুড়িগ্রামের উলিপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু
ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার
কুরআন-সুন্নাহর আইন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না : চাঁদপুরে হাবিবুল্লাহ মিয়াজী
শাহজাহান ওমরকে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ
জীবনে উত্তম কর্ম, জ্ঞান ও উন্নত চরিত্র অর্জন করতে হলে সফল ব্যক্তিদের সান্নিধ্য অবলম্বন আবশ্যক
নড়াইলে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় জেলা আ.লীগ সভাপতি কারাগারে