ক্ষুধা সূচকে অবনতি উদ্বেগজনক
২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-২০২৪ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত সূচক মতে, ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম, স্কোর ১৯.৪। এবারের সূচকে গত বছরের চেয়ে তিন ধাপ অবনতি হয়েছে। ২০২৩ সালের সূচকে অবস্থান ছিল ৮১তম ও স্কোর ১৯.১। এবারের সূচকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্ষুধার মাত্রা মধ্যম পর্যায়ে এবং অপুষ্টির শিকার ১১.৯% মানুষ। ২.৯% শিশু তার পঞ্চম জন্মদিনের আগে মারা যায়। অপুষ্টির কারণে ২৩.৬% পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর বয়স অনুপাতে উচ্চতা বাড়ছে না। এছাড়া, ১১% পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর উচ্চতা অনুযায়ী ওজন বাড়ছে না। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সম্প্রতি বলেছে, ‘নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০% মানুষ। এছাড়া, প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে ৩০% মানুষ।’ বিবিএস ২০২৩ সালে বলেছে, দেশের মানুষের মোট ব্যয়ের প্রায় ৪৬% ব্যয় হচ্ছে খাদ্য কেনায়। কিছুদিন আগে বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত রিপোর্ট মতে, ‘বাংলাদেশের ৭৩% মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সক্ষমতা নেই।’ অপরদিকে, এসডিজি অ্যাকশন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ গত ১৯ মে বলেছে, ‘বাংলাদেশের ১৮.৯% মানুষ সর্বাধিক দরিদ্র ও ২০.১% মানুষ দরিদ্র এবং সবচেয়ে ধনী ১৯.৮% ও ধনী ২১.৭%।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় ৪০% মানুষ দরিদ্র ও চরম দরিদ্র। এরা ঠিকমতো মৌলিক চাহিদা মিটাতে পারে না। বিআইডিএস গত ১৫ জুলাই বলেছে, ‘স্বাস্থ্যসেবা মেটাতে বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরচ করতে হয় বাংলাদেশে। দেশে এ সেবার ৭৩% ব্যয় মানুষ নিজ পকেট থেকে মেটায়। তাই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশের ৬১.৩০ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে, যা মোট দারিদ্র্যের ৩.৭%। এছাড়া, চিকিৎসা সেবা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৬১% মানুষ অর্থ সংকটে পড়ে। প্রায় ২৭% মানুষ ঋণ করে স্বাস্থ্যসেবা নেয়।’ গত এপিলে প্রকাশিত ‘ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্ট’-এর জরিপ রির্পোট মতে, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য সূচকে ৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনি¤েœ, স্কোর ৩০.৮।’
স্মরণীয় যে, বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার কথা। বর্তমানে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের অবস্থানে আছে। আইএমএফ সম্প্রতি বলেছে, ‘২০২৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির দেশ। এ নিয়ে টানা তিন বছর একই অবস্থানে আছে। দেশটির জিডিপির পরিমাণ ৪৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু গড় আয় ২,৬৪৬ মার্কিন ডলার।’ মধ্য আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেলে এলডিসি ভুক্ত দেশের যেসব সুবিধা তথা ঋণ ও ব্যবসায়িক সুবিধা ইত্যাদি পেত বাংলাদেশ তা বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে কঠিন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে বলে প-িতদের অভিমত। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ভিশন ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ক্ষুধামুক্ত এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করা। অথচ, ২০৩০ সাল আসতে আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪০%। তারা মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। আরো ১০% মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। ফলে দেশ ধনী হচ্ছে বলা হলেও অধিকাংশ মানুষের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে না। কারণ, উন্নতির ভাগীদার তারা হতে পারছে না! এই অবস্থায় জাতীয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। ফলে ২০৩০ সালে দেশকে ক্ষুধামুক্ত করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়।
দেশকে ক্ষুধামুক্ত করতে হলে খাদ্যপণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে এবং সব গরিব মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির হার এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে সর্বাধিক থেকে স্বাভাবিক করতে হবে এবং শ্রমিকের চরম খারাপ অবস্থার ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি হতে উত্তরণ ঘটাতে হবে। দেশে জাতীয় কোনো নি¤œতম মজুরী নেই। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য নি¤œতর মাসিক মজুরী ১২,৫০০ টাকা করা হয়েছে ব্যাপক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। তাও বহু গার্মেন্ট কারখানায় বাস্তবায়ন করা হয়নি। যে গার্মেন্ট কারখানায় নি¤œতম মজুরী বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেটা শুধু দক্ষ শ্রমিকদের জন্য। বাকীদের নামেমাত্র মাসিক মজুরী দেওয়া হয়। অতিরিক্ত কাজ করার পরও তারা ওভার টাইম পায় না। কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার কোনো চিকিৎসা ব্যয়ও দেয় না মালিকরা। শ্রমিকদের নিজে বহন করতে হয়। এমনকি দুর্ঘটনায় আহত-নিহত শ্রমিকের কোনো খোঁজখবরও নেয় না মালিকরা। শ্রমিকরা চাকরিচ্যুতি, অবসর ইত্যাদির পর কোনো সুবিধাদি পায় না।
আইএলও’র ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বিশ্বে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের অবস্থা আরো খারাপ! অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেশের শ্রমিকের অবস্থা খারাপ! আইটিইউসি’র বৈশ্বিক অধিকার সূচক-২০২৩ মতে, শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশ্বের ‘সবচেয়ে বাজে’ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ!
যা’হোক, দেশের শ্রমিকরা যে মজুরী পাচ্ছে, তা দিয়ে চরম মূল্যস্ফীতির তথা এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক বাজার মূল্যে চলছে না। অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হচ্ছে। উপরন্তু স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে ও পরিবারের অন্য লোকরা শিক্ষা ও চিকিৎসা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে দেশে আয় বৈষম্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা দেশের সার্বিক শান্তি ও উন্নতির চরম অন্তরায়। তাই এর অবসান হওয়া দরকার। নতুবা শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাইবার ফোর্স, যা ‘গুজব বাহিনী’ বলে খ্যাত, তা সম্প্রতি দেশের গার্মেন্ট খাতে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে ব্যাপক সহিংস আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল আশুলিয়া ও তার আশে-পাশে। তাতে অনেক কারখানার ক্ষতি হয়েছে। অনেক ক্রয়াদেশ ফেরত গেছে। এর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করবে তারা বারবার এবং তা দেশব্যাপী। এখনই বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা প্রায়ই সড়ক অবরোধ করছে বিভিন্ন স্থানে। গুজব বাহিনী ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে যে, ‘আগেই তো ভালো ছিলাম’। তারা বিশ্ব ভোটচোরকেও হাইলাইট করছে। তাই দেশের শ্রমিকদের অসন্তোষ নিরসন করতে হবে। তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের মানসন্মত সুষম খাদ্য পাওয়া নিশ্চিত করত হবে। তাহলে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দেশের অবস্থান অনেক উপরে উঠবে।
দ্বিতীয়ত: দেশের খাদ্যপণ্যকে ভেজালমুক্ত করতে হবে। খাদ্যপণ্যের অনেকগুলো ভেজাল-নকল তথা মানহীন। মান সনদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এটা হয়েছে। দেশে ৪,৪০০টি পণ্য রয়েছে। তন্মধ্যে বিএসটিআই’র সনদপ্রাপ্ত মাত্র ২৯৯টি (আরো ১৬টি পণ্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে)। এ অবস্থায় দেশের সব পণ্যকে মান সনদের আওতায় আনা জরুরি। যা’হোক, খাদ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক এবং মানুষের আয় বৃদ্ধি করা না হলে দেশ ক্ষুধামুক্ত হবে না। দেশে সব ধরনের খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং ঘাটতি খাদ্যপণ্য সময়মতো আমদানি করতে হবে। শ্রমিকসহ দরিদ্রদের জন্য রেশন কার্ড প্রদান করে তার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য প্রদান করতে হবে। গত ১৫ অক্টোবর থেকে কৃষি বিভাগ ঢাকার কয়েকটি পয়েন্ট থেকে প্রতি ডজন ডিম ১৩০ টাকা, কেজি প্রতি আলু ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৭০ টাকা ও পেঁপে ২০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এটা সম্প্রসারিত করতে হবে। এর সঙ্গে টিসিবির ট্রাকসেলও জোরদার করতে হবে। তবেই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে যাবে। মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬
যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা
বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান
নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ
সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত
শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন
আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ
বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার
পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি
‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’
ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি
পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল
অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?
চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন