ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০ পৌষ ১৪৩১

অনন্য চিন্তক-দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় দার্শনিক, মানবহিতৈষী, অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমাদের মধ্যে বেঁচেছিলেন ৯০ বছরেরও বেশি সময়। মৃত্যুর কিছু দিন আগে আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। ভালো-মন্দ অনেক আলাপ আলোচনার পর বিনয়ের সাথে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি লিখছেন না কেন? বললাম, আমার মতো লক্ষ লক্ষ পাঠক আপনার লেখা পড়ার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি জানালেন, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পায়ের ব্যথায় নড়াচড়া করা সম্ভব হচ্ছে না। মজা করে তাকে বলেছিলাম, দাদা পা-টা বদলে নিলে কেমন হয়। হেসে বলেছিলেন, আর বদলে লাভ কী! ট্রেনে উঠার সময় তো হয়েই গিয়েছে। এ আলাপের পর মাসখানিক তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না, বিভিন্ন কাজে আমিও ছিলাম ব্যস্ত। একদিন ভোরে পূবালী ব্যাংকের পরিচালক আলহাজ্ব এম এ রকিব হঠাৎ আমাকে ফোন করে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মৃত্যুর সংবাদ জানালেন। তখন ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, রকিব ভাই বোধহয় মজা করছেন আমার সঙ্গে। খবরটা বোধহয় সত্য নয়। তাৎক্ষণিক আমি তাঁর মেয়ে সাদিয়া চৌধুরী পরাগের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। আমার জন্য এ ভীষণ দুঃসংবাদটি সত্যই হয়ে গেল।

১৯৭৪ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ঢাকায় থাকা অবস্থায় তাঁর বাসায় যাওয়া-আসা ছিল। সুযোগ পেলেই দু’কথা বলার চেষ্টা করতাম, প্রশ্ন করতাম কিছু জানার বা শেখার জন্য। তিনি আদর করতেন বলেই পাশে যেতাম কথা বলতাম, দাদা বলেই সম্বোধন করতাম। পরবর্তী পর্যায়ে বৈবাহিক সূত্রে দাদা-নাতি সম্পর্ক আমাদের রয়েই গেল। মজা করে বলতেন, তুমিতো আগে থেকেই আমার নাতি, আমি দাদা, বৈবাহিক সূত্রেও তুমি আমার নাতিন জামাই, মন্দ না আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হলো। আসলে রাশভারি এ মানুষটির ভিতরে যে আরও এক ভিন্ন মানুষ লুকিয়েছিল তার সঙ্গে মেলামিশা না করলে হয়তো জানতেই পারতাম না। আমি তাঁকে যেভাবে দেখেছি, তার মহৎ জীবনের যতখানি জেনেছি, তারই নিরিখে কালের প্রেক্ষিতে তাঁর মূল্যায়ন বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লক্ষ্য। তবে কাজটি নিঃসন্দেহে দুরূহ।

অপরিচিত মানুষের সঙ্গে চট করে কথা বলতেন না দেওয়ান সাহেব। কিন্তু একবার মিশে গেলেই হয়, রীতিমত জমিয়ে কথা বলতেন। তাইতো অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর সঙ্গে। ক্লান্তিকর কাজের পর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিত দেওয়ান আজরফের রসে ভরা গল্প ছিল দারুণ উপভোগ্য। স্বীয় মেধাবলে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালবাসতেন। ফলে শিক্ষা-হিতৈষী ও মানবপ্রেমিক হিসেবে এক অনুকরণীয় আদর্শের প্রতীক ও প্রেরণার উৎস হয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। শিক্ষা, সমাজসেবা ও মানব কল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন তিনি।

এ মুহূর্তে অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক স্মৃতি। কাগজে লিখতে গিয়ে বা অতীত জানার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন তথ্য ও পরিসংখ্যান। সে সময় কম্পিউটার বা ইন্টারনেটও ছিল না এ অঞ্চলে। কিন্তু আমাদের ভরসা ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে শুরু করে উপসাগরীয় যুদ্ধ অথবা এ অঞ্চলে তথা উপমহাদেশের অতীত ও বর্তমান বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। ছিলেন এক জীবন্ত তথ্য ভাণ্ডার। খুব কম লোকই তাঁর কাছে কোনও কিছু জানতে চেয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন। একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। একই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল সম্প্রদায়ের কাছে আদর ও কদর ছিল তাঁর। এ যুগে বড় দুর্লভ এ ধরনের ভালবাসা। বিশ্ব বিশ্রুত মনীষীদের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে জর্জরিত ও ইজম বিভ্রান্ত পৃথিবীর জন্য মহান শিক্ষাই যেন রেখে গেছেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অত্যন্ত বলিষ্ঠ নীতির অধিকারী ছিলেন। কোথাও কোনো ভুল থাকলে স্পষ্টভাবে ধরিয়ে দিতে কোনো দিনই দ্বিধা করতেন না। সামনে প্রশংসা করে পিছনে সমালোচনা করতে কখনও দেখা যায়নি তাঁকে। এ দিক দিয়েও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রায়শই দুঃখ করে বলতেন, এ অঞ্চলের বেশিরভাগ পাঠক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে গুরুত্বহীন বিষয়গুলো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিত্যদিনের জীবন যন্ত্রণা নিয়ে অসংখ্য খবর, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ হলেও পাঠকদের সাড়া মেলে নিতান্তই কম। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল সতত। ফলে মাঝে মধ্যে অনুযোগের সুরে বলতেন, আর কত লিখব? কাদের জন্যই লিখব? নিজেদের জীবন-যন্ত্রণা সম্পর্কে মানুষ এত নিস্পৃহ! শুধু শুধু লিখে কাগজ নষ্ট করার মানে কিছু হয় কি? কোনো দিনে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি দেওয়ান আজরফের মুখে। সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন কারো সমস্যার কথা শুনলেই বিচলিত হয়ে উঠতেন তিনি। এক নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন এ মহান ব্যক্তি।

আজ মনে পড়ছে, ঢাকার জালালাবাদ এসোসিয়েশনের অফিস কক্ষে বসে একদিন কোনও এক বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্বন্ধে তাঁর মৃত্যুর পর কাগজের পাতায় স্মৃতিচারণ করে লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পাশের চেয়ারে বসছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। ঐ ব্যক্তির ছবি কাছে পাচ্ছিলাম না। রসিকতা করে দেওয়ান সাহেবকে বলেছিলাম, দাদা প্রয়োজনে কোনো কিছু না পেলে বড় সমস্যায় পড়তে হয়, বিচলিত হতে হয়। নিজের স্মৃতিচারণ করে বিস্তৃত জীবনের একটা লেখা তৈরি করে আমাকে দিয়ে যাবেন। সঙ্গে একটা ছবিও, যাতে করে সহসাই লে-আউট করে ফেলতে পারি।

না, আমার এ আবদারটুকু তিনি রাখেননি। একেবারে নিঃশব্দে সবার কাছ থেকে তিনি বিদায় নিলেন। সে দিনের সে রসিকতা যে এত তাড়াতাড়ি নির্মম বাস্তব হয়ে দেখা দেবে তা ভাবতে এখনও ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু এটাতো কাগজের লে-আউট নয় যে, যখন খুশি একটাকে উঠিয়ে আরেকটা বসিয়ে লেখা যায়। এটাতো জীবনের লে-আউট। একবার চলে গেলে শত চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
মাহফুজ আলমের কথায় ভারতের আঁতে ঘা
অপরাধ বাড়ছে কেন?
বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

ইসরায়েল নিশ্চিত করেছে, হামাস নেতা হানিয়া তেহরানে নিহত

ইসরায়েল নিশ্চিত করেছে, হামাস নেতা হানিয়া তেহরানে নিহত

হাওয়াইয়ের কিলাওয়া আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত, লাভার প্রবাহ শুরু

হাওয়াইয়ের কিলাওয়া আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত, লাভার প্রবাহ শুরু

ম্যাট গেটসের বিরুদ্ধে যৌন ও মাদক কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশ

ম্যাট গেটসের বিরুদ্ধে যৌন ও মাদক কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশ

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে যুবককে বেঁধে নির্যাতন-নাকে খত দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে যুবককে বেঁধে নির্যাতন-নাকে খত দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল

গাজার হাসপাতাল ও ত্রাণ বহরে ইসরায়েলি হামলা, নিহত আরও ৫৮ ফিলিস্তিনি

গাজার হাসপাতাল ও ত্রাণ বহরে ইসরায়েলি হামলা, নিহত আরও ৫৮ ফিলিস্তিনি

অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের বিশাল বহর কিনছে পাকিস্তান, ছাড়িয়ে যাবে ভারতকেও

অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের বিশাল বহর কিনছে পাকিস্তান, ছাড়িয়ে যাবে ভারতকেও

১৩ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ

১৩ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ

সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে পটল চাষে বাম্পার ফলন

সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে পটল চাষে বাম্পার ফলন

গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু

গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু

শাহরাস্তিতে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

শাহরাস্তিতে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

পাকিস্তানে অবশেষে সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনা শুরু

পাকিস্তানে অবশেষে সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনা শুরু

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি  বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি

বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি

যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন

যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন