জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতা এবং ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত একটি জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু সমস্যা হলো, ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর এই জাতীয়তাবাদ হারায় চালিকাশক্তি এবং ধর্মের ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হওয়ায় মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের সবাই রাষ্ট্রটাকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া ধর্মের জোরে ভাষা এবং জাতিগত পার্থক্য ঘুচানো সম্ভব হয়নি। ব্যবসা, চাকরিসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ে তৈরি হয় বৈষম্য। তাতে ফলাফল দাঁড়ায় জাতিরাষ্ট্রের পতন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ভাষা ভিত্তিক ন্যাশনালিজম কায়েমের চেষ্টা করা হয়, যার ভিত্তি ছিল বাঙালি বা বাংলাভাষী জাতিরাষ্ট্র, যা বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালি ও উপজাতীয়দের মধ্যে তৈরি করে বিভেদ। অতপর ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতি-ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ কনসেপ্ট প্রবর্তন করেন, যার ভিত্তি হচ্ছে, রাষ্ট্রের সীমারেখার ভেতর বসবাসরত সব ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের মানুষ মিলে জাতিরাষ্ট্র। এর ফলে ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের ভিত্তিতে কেউ বাদ পড়েনি। সবাই একটা কমন প্লাটফর্ম খুঁজে পায়।
যেহেতু এককেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের সব নাগরিককে একত্রিত করতে পারে না এবং প্রাকৃতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে, তাই বাংলাদেশের মতো একাধিক ধর্ম-ভাষা ও বর্ণের মানুষ অধ্যুষিত দেশে ভূখ-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদই শ্রেষ্ঠ। তাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ ও অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষে অটল ও অবিচল রয়েছে। কারণ বিশ্বের কোনো দেশই একক কোনো ধর্ম, ভাষা-ভাষী অথবা একক কোনো বর্ণের মানুষের নয়। হিটলার বর্ণের ভিত্তিতে জার্মানি বানাতে চেয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা দেখিয়েছে। ইসরাইল ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বানাতে চেয়ে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর আগ্রাসন চালাচ্ছে। অন্যদিকে বহুভাষা, বহুধর্মের ও বহুবর্ণের হয়েও ভূখ-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করায় যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে নিজ নাগরিকদের জন্য অন্যতম সেরা একটি রাষ্ট্র। যেখানে এককেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ মানুষে মানুষে বিভেদ ও বৈষম্য তৈরি করে, সেখানে একমাত্র ভূখ-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদই পারে সবাইকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসতে।
জিয়াউর রহমান দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এটি বুঝতে পেরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ভূখ-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করে গেছেনে। আমাদের সবার উচিত, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদারতা এবং মর্ম অনুধাবন করে গর্বিত হওয়া এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া।
আত্মনির্ভরশীল একটি দেশ গড়তে হলে সর্বাগ্নে প্রয়োজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতি গঠন আর জাতি গঠনে জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই জাতিরাষ্ট্র। জাতিরাষ্ট্র মানেই জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও ভাবধারার রাজনীতি দ্বারা চালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা, অন্যটি হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভূখন্ডকেন্দ্রিক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারা।
ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ইত্যাদির সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদ ভূখ-কেন্দ্রিকতাই হয়ে থাকে এর প্রধানতম প্রেরণা ও শক্তি। এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ইরানসহ প্রভৃতি দেশ জাতিরাষ্ট্র। নানা ভাষার, নানা ধর্মের, নানা বর্ণের ও নানা সংস্কৃতির মানুষ এসব দেশে বসবাস করলেও এরা সবাই ভূখ-গতভাবে এক জাতীয়তাবাদী পরিচয়ে পরিচিত হন।
বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ বাস করে। এখানে ভাষারও নানা বৈচিত্র্য আছে। বাংলা, চাকমা, মারমা, উর্দুসহ অনেকগুলো ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের জাতিগোষ্ঠীর মানুষ-এরা সবাই বাংলাদেশ ভূখ-ে বসবাস করে। সেই অর্থে এরা সবাই বাংলাদেশী। সুতরাং জাতীয়তাবাদও হবে বাংলাদেশী। এখানেই সবার জাতীয় পরিচয় ও জাতীয় স্বার্থ নিহিত আছে। এর মাধ্যমে আমাদের জাতিসত্তার একটা সুস্পষ্ট কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
নৃতাত্ত্বিক ও আদর্শিক চেতনা মিশ্র স্বতন্ত্র রূপ ও পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপ অন্বেষার ঐকান্তিক আগ্রহ, ভাষা, ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি অর্থনীতি-একবাক্য বলা যায় জীবনের পরিপূরক প্রতিটি বিষয় ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের আলোকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে তুলে ধরা হয়েছে। তাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ, অনুভূতি ও বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ পক্ষে অটল-অবিচল রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সাংগঠনিক দিক দিয়ে অনিবার্যভাবে এটিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য যে মেশিনারির প্রয়োজন, সম্ভব হয়নি তারও বিকাশ ঘটানোর। এই সীমাবদ্ধতাটুকু স্বীকার করতে হবে নির্দ্বিধায়।
দেশকালের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে তার নৈতিক এবং ধর্মীয় অনুভূতির পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন মেনে না নেয়া গোঁড়ামি। জিয়াউর রহমান তার বাংলাাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই অর্থে তিনি একজন সংস্কারবাদী। তার সমাজ ভাবনার মূল প্রতিপাদ্য সমাজ সংস্কার।
বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের ক্রমপরিবর্তনের কালে জিয়াউর রহমান উপস্থাপিত করেছিলেন উদারতন্ত্রের ভাবধারা। তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দর্শন। এটি ধর্মান্ধও নয় আবার ধর্মহীনও নয়। সব ধর্ম, ভাষা ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের স্বীকৃতি রয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। যার ফলে একটি সুস্পষ্ট চেতনার মাধ্যমে সব ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং দেশ গড়ার কাজে ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় সত্যিকারের উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি।
‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’ সন্নিবেশিত আছে সব জাতির পরিচয়, সব ধর্মের পরিচয়, সব ভাষার পরিচয় ও সব সাংস্কৃতির পরিচয় এবং ভৌগোলিক পরিচয়; সর্বোপরি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সম্পদের সমবন্টন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি। এককথায় সুশৃংখল মধ্যপন্থী জাতি গঠনের সব উপাদানই সন্নিবেশিত আছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। এর মাধ্যমে একটি জাতি গঠিত হলে সেই জাতি হবে একটি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ও আধুনিক জাতি। যে জাতিকে কোন ভাবেই বিভক্ত করা সম্ভব হবে না। এর মাধ্যমে একটি দেশ গঠিত হলে সে দেশকে জঙ্গি, মৌলবাদী, ব্যর্থ ও অকার্যকর বানানো সম্ভব হবে না।
মতদর্শের দিক দিয়ে বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন মতের সন্ধান অবশ্য পাওয়া যাবে কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সব ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষকে একটি প্লাটফর্মে একত্রিত করেছে। পাশাপাশি সাম্য, গণতান্ত্রিক এবং উদারতন্ত্রের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে প্রতিফলিত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপ অন্বেষার ঐকান্তিক আগ্রহ। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে পশ্চৎপদ বাঙালি মুসলমান মানসে সম্মিলিত সাহিত্য প্রচেষ্টায় প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের ঐতিহ্যের রূপরেখা। ফলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আবাসিক হলে ছাত্রদলের পোস্টারিং, মধ্যরাতে উত্তাল ঢাবি
আগামীর বাংলা হবে ইসলামের বাংলা ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কিছু মানবো না
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জেড ফোর্স
যুগস্রষ্টা জিয়াউর রহমান
মার্কিন নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়ে ট্রাম্পকে ড. ইউনূসের অভিনন্দন
সৈনিক-জনতার একতার অঙ্গীকার
তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব
৭ নভেম্বর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক
কেশবপুরের ত্রাস টিটু যৌথ বাহিনীর হাতে আটক
সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন
যশোরে বিদেশি পিস্তল-বুলেট ও মাদকসহ আটক ২
৭ নভেম্বরের তাৎপর্য
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস
ইসরাইলি অর্থনীতির ভবিষ্যত অন্ধকার, বেকারত্ব বেড়েছে
মেলানিয়াকে ফার্স্ট লেডি উল্লেখ করে বউয়ের প্রশংসায় ট্রাম্প
হিমালয় অববাহিকায় দুর্গম অঞ্চলে নতুন গ্রাম গড়ে তুলছে চীন
৭৩% ভোটার মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র হুমকির মুখে
অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে ইংলিশ
যুক্তরাষ্ট্র আরো বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে উঠতে পারে : জয়শঙ্কর
মার্কিন সিনেটে ইতিহাস গড়লেন দুই কৃষ্ণাঙ্গ নারী