ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য জরুরি

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

গত ১৬ বছর ধরে ভারতের পুতুল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিশন ছিল তথাকথিত উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে দেশটাকে দেউলিয়া ও অকার্যকর করে ভারতের হাতে তুলে দেয়া। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কোনো শাসক দেশকে এমন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটা ভাবা যায় না। একটা রাষ্ট্র কিভাবে শক্তিশালী, আত্মনির্ভর কিংবা আত্মঘাতী হতে পারে অল্প কথায় তার একটি চমৎকার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছিলেন বৃটিশ সমাজ চিন্তক-গবেষক হার্ভে লোথিয়ান। ২০১৫ সালে ডিসিড্যান্ট ভয়েস অনলাইনে প্রকাশিত লোথিয়ানের লেখা সংক্ষিপ্ত সারগর্ভ নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, জাতি গড়ে ওঠার মূল উপাদান হচ্ছে মানুষ বা জনগণ। যে দেশ বা জাতির মানুষ যত বেশি ঐক্যবদ্ধ সে জাতি তত শক্তিশালী। সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনগুলো যত বেশি বিভাজন, ভেদাভেদ ও বৈরীতার শিকার হবে রাষ্ট্র তত দুর্বল হবে। সমাজে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও বৈচিত্র্য সত্ত্বেও পারস্পরিক বোঝাপড়া, সম্প্রীতি ও মানবিক দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে যে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায়। জাতির ক্রান্তিকাল বারবার আসে না। ক্রান্তিকালে সব ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের উদাহরণ ও উত্তরণ সম্ভব। বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া কোনো জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠতেই পারে না। আর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাকে ধ্বংস করার প্রধানম দুটি উপাদান হচ্ছে, প্রথমত: জাতিকে স্পষ্টত বিভক্ত করে ফেলা, দ্বিতীয়ত: দুর্নীতি-লুন্ঠনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস ও দেউলিয়াত্বের মুখে ঠেলে দেয়া। গত ১৬ বছর ধরে এ দুটি নেতিবাচক শক্তি ব্যবহার করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ধ্বংসের পথ বেছে নিয়েছিলেন। হার্ভে লোথিয়ান বলেন, অর্থনৈতিক ধস ও নিরাপত্তাহীন সাধারণ মানুষকে সংঘাত সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে দেশের নেতারা কল্পিত শত্রুর বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের মানুষকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে বিভক্ত করে সংঘাতে লেলিয়ে দিতে পারলেই ব্যস, কেল্লা ফতে। জাতি রাষ্ট্রের ধ্বংস অনিবার্য। হার্ভে লোথিয়ানের ভাষায়, মিশন অ্যাকোম্পিøশ্ড। এর বিপরীতে প্রশ্ন আসে, কিভাবে জাতি শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠতে পারে ও রক্ষা পেতে পারে। সেখানে লোথিয়ান বলেছেন, জাতির সামনে সবকিছু স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে হবে। সকলেই বাস্তব সমাজের অংশীদার, সমাজের প্রত্যেক মানুষ আলাদা এবং অমূল্য, প্রত্যেকেরস জীবনের জন্য মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, উপযুক্ত কর্মসংস্থান যথোপযুক্ত মজুরিসহ বৈচিত্রময় জীবনধারাকে অবারিত রাখার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হবে। জাতিয় ঐক্য, সংহতি ও সুশাসন নিশ্চিত হলে রাষ্ট্রের নেতাদের আর কিছুই করতে হবে না। এমন অবস্থায় চৈনিক দার্শনিক লাওজি’র বলেন, ‘ডু নাথিং অ্যান্ড এভরিথিং গেটস ডান’। আরেকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন, শাসকের প্রত্যক্ষ শাসন ছাড়াই যে দেশ সুন্দরভাবে চলে, সে শাসনই সর্বোত্তম। এমন একটি সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের জন্য একটি ইউটোপিয়া বা কল্পলোক বলে গণ্য হতে পারে।

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগাভাগির জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে রক্ত ও জীবন দেয়নি। একটি প্রত্যাশিত রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণের জন্য আগে আরো অনেকবার এ দেশের ছাত্র-জনতা রাজপথে রক্ত ও জীবন বির্সজন দিয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষের আত্মদানের মূল লক্ষ্য ছিল, একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র কায়েম করা। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নেতৃত্ব শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সেই স্বপ্নের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষের উপর একদলীয় শাসন চাপিয়ে দিয়ে গুম-খুন-নিপীড়ন-লুটপাটের পথ বেছে নিয়েছিল। স্বাধীনতার আগের সংগ্রামী নেতার সাথে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বৈপরীত্য ও বৈসাদৃশ্য জাতিকে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ করেছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির সেই সংক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যার মুক্তির জন্য দেশের বহু মানুষ রোজা রেখে দোয়া করেছিল। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে তিনি বীরের বেশে ফিরে আসার মাত্র পৌনে ৪ বছরেই মানুষের ভালোবাসা ঘৃণা ও বিষাদে পূর্ণ হয়ে গেল কেন? দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ প্রশ্নের জবাব জানতে ও বুঝতে না পারলে, ইতিহাসের নির্মম ট্রাজেডি বারবার ঘটতেই থাকবে। যেসব প্রশ্নে জনগণের মধ্যে ঐক্য ও স্বতঃস্ফূর্ত জনমত গড়ে ওঠে, যেসব বিষয় যেকোনো রাজনৈতিক দল কিংবা আকাশচুম্বি জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার আদর্শের সাথে আপসযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের সেসব ভিত্তিভূমিকে দুর্বল করে যারা দেশকে ধ্বংস ও নৈরাজ্যের পথে ঠেলে দেয়, তাদের ট্রাজিক মৃত্যুতে মানুষ শোকর গুজার করে, রাস্তায় মিষ্টি বিলিয়ে আনন্দ করে। কারণ ব্যক্তি ও দলের চেয়ে দেশের স্বার্থ ও অস্তিত্ব অনেক বড় বিষয়। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের ট্রাজিক ঘটনাগুলো একটির সাথে আরেকটির কোনো মিল ও যোগসূত্র নেই। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর যে সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। সেই সরকার শেখ মুজিবের শাসনকে নমরুদ-ফেরাউনের শাসন বলে আখ্যায়িত করে জাতিকে মুক্তির বিপ্লবী বার্তা ঘোষণা করেছিল। যারা সশস্ত্র অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা হলেও দেশের শাসনভার গ্রহণ করেননি। বাকশাল সরকারের পতন ঘটিয়ে আওয়ামী নেতৃত্বের হাতেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ তারা ক্ষমতা দখলের জন্য জীবন বাজি রেখে রক্তাক্ত পথ বেছে নেননি। এরপর মাত্র সাড়ে ৫ বছরের মাথায় চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে নিরাপত্তা রক্ষিদের হাতে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর এক বিরল দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। তাঁর জানাজায় ঢাকার ইতিহাসের বৃহত্তম জনসমাবেশ ঘটেছিল। পুরো জাতি শোকে মুহ্যমান হয়েছিল। বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা জাতীয়তাবাদী নেতার মৃত্যুতে বিশ্বের দেশে দেশে জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছিল। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব একজন আদর্শ রাষ্ট্রনেতা হারানোর শোক প্রকাশ করেছিল। দেশের রাজনৈতিক নেতারা যখন মেঠো বক্তব্য দিয়ে চরম সন্ধিক্ষণে প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসর্মপণ অথবা পালিয়ে গিয়ে জাতিকে দিশাহীন আবর্তে নিক্ষেপ করেছিলেন, তখন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করেননি। পঁচাত্তরে নভেম্বরের প্রথম সপ্তায় আবারো এক বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবতে থাকা জাতিকে আলোর দিগন্তে ফিরিয়ে আনতে জিয়ার সাহসী ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব দেশকে এক নতুন সম্ভাবনার পথে উন্নীত করেছিল। তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু জাতি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এটা ছিল বাংলাদেশকে ভারতের দাবেদার রাষ্ট্রে পরিনত করার ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার অংশ।

সচেতন জনগণ রাষ্ট্রের অতন্দ্র প্রহরী। তারা একজনকে বিশ্বাস করে ক্ষমতার মসনদে বসাতে পারেন, আবার ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তাঁকে চরম শাস্তি দিয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে পারেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নেতৃত্ব কখনো কোনো দল বা নেতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। স্বাধীন রাষ্ট্রের শত্রু-মিত্র নির্ধারিত হয় জনগণের স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিচারে। এখানেও কোনো স্থির বা চিরস্থায়ী শত্রুমিত্র থাকতে পারে না। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ জনগণের চোখে, জনগণের স্বার্থে শত্রুমিত্র নির্বাচন করতে পারেনি। সবকিছু দেখা হয়েছে দিল্লীর চোখে। জিয়াউর রহমানই প্রথম সেই চিত্র পাল্টে দিয়ে জনগণ ও বিশ্বের কাছে এক স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাবনার জানান দিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে নতুনভাবে স্বীকৃতি দিয়ে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা ঘোচাতে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল কর্মসংস্থান ও পাটের বিকল্প রফতানি শিল্প হিসেবে তৈরী পোশাক খাতের উন্নয়নে ইউরোপ-আমেরিকার বাণিজ্য অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ইমার্জিং টাইগারে পরিনত করার মূল কারিগর ছিলেন তিনি। সততা ও জনগণের স্বার্থে আপসহীন নেতৃত্বের উত্তরাধিকার নিয়ে বিএনপি ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের শাসনভার লাভ করলেও এরশাদের সাথে আপস করা শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালে নির্বাচিত বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ‘একদিনও শান্তিতে থাকতে দেব না’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরশাদের পতনের আগেই বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সমঝোতা ও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ফয়সালা হয়েছিল। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, পতিত স্বৈরাচারকে রাজনীতিতে পুর্নবাসন না করা এবং প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতি থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের পক্ষে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই আলোকে অন্তবর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। দলীয় অবস্থান পরিবর্তন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্রে পদার্পণ করে বাংলাদেশ। একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারি দলের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব থাকেনা। বিরোধীদলকেও গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করতে হয়। কিন্তু ক্ষমতার জন্য মুখিয়ে থাকা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকার কথা অগ্রাহ্য করে বিএনপি সরকারের শপথ গ্রহণের শুরুতেই বলে দিলেন, তিনি এই সরকারকে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দিবেন না। তিনি তার জেদ ও কথা রেখেছিলেন। তিনি একদিনের জন্যও বিএনপি সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেননি। আটবছরের স্বৈরাচারী শাসনের যবনিকাপাত ঘটিয়ে দেশের শিশু গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যখন নতুন দিগন্ত স্পর্শ করতে চেয়েছে, তখন তা নস্যাৎ করাই যেন আওয়ামী লীগের মূল এজেন্ডা। একটি জাতিরাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে দেশের ঐতিহ্যবাহী ও গণমুখী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন অবিমৃষ্যকারী ভূমিকা সত্যিই বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক। সংসদে থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে জোরালো ভূমিকা রাখার পরিবর্তে উস্কানিমূলক মেঠো রাজনীতি এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংসদ থেকে আওয়ামী লীগ সদস্যদের একযোগে পদত্যাগের কারণে সংসদে তত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আইন পাস করতে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপিকে একটি একপাক্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। শুধুমাত্র সেই আইন পাস করেই প্রতিশ্রুতি মত সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে একদলীয় দখলবাজির নির্বাচন করে গুম-খুন, দখল-দুর্নীতি ও সন্ত্রাস কায়েম করে দেশকে ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিনত করে একটি গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে দেশকে ক্রমাগত একটি অস্থির অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে দিল্লীতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনা, দেশে ঘাপটি মেরে থাকা তার মাফিয়াতন্ত্রের দোসর এবং দিল্লীর মুসলিম বিদ্বেষী সরকারের তল্পিবাহক মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করছে। একজন নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের জীবনের চেয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারের ক্ষমতা মূল্যবান নয়। সেখানে ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষকে জিম্মি করে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুট ও পাচার করে দেশকে দেউলিয়া ও নিরাপত্তাহীন করে তোলার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালিয়ে দেশের প্রতিটি জনপদে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও তারা রাজনীতিতে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখে, বিদেশি প্রভূদের পুতুল হয়ে দেশে নৈরাজ্য ও প্রতিবিপ্লব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পুর্নবাসিত হয়ে আরো শত শত মানুষকে হত্যার ঘোষণা দেয়ার দু:সাহস দেখাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষের গুম-খুন, গণহত্যার বিচারে শাস্তির সম্মুখীন করা ছাড়া অন্য কোনোভাবে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিকল্প কোনো সুযোগ নেই। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের দেশপ্রেম, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রত্যাশার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনাকে রোবটের মত ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব ও সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিতে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত কখনোই বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। একাত্তরে ভারতীয় সহায়তার মূল কারণ ছিল পাকিস্তানের দুই অংশকে আলাদা করে দুর্বল করা এবং বাংলাদেশকে করায়ত্ব করে সিকিম-হায়দরাবাদের মত গ্রাস করা। আক্ষরিক অর্থে দেশ দখলের গতানুগতিক ফর্মূলায় বাংলাদেশকে গ্রাস করা দু:সাধ্য হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নস্যাৎ করে রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হেজিমনি ও আধিপত্য কায়েমের মূল অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবার। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি ভারত। লাখ লাখ অবৈধ শ্রমিক পাঠিয়ে, অসম-অস্বচ্ছ বাণিজ্য চুক্তি করে, অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে ও একতরফা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি এবং সবশেষে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে মূলত তাদের বিপুল অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছে। দেশকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ও অকার্যকর করে দুর্বল ও পরনির্ভর করে রাখার ষড়যন্ত্র আর সফল হবে না।

ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম বিদ্বেষী আধিপত্যবাদী হলেও বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ভারতের সাথে বৈরীতা-শত্রুতায় বিশ্বাস করেনা। তারা শুধু আর্ন্তজাতিক সার্বভৌমত্বের মানদন্ডে সমতার ভিত্তিতে ভারতের সাথে বন্ধুত্ব ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক চায়। শেখ মুজিবের করুণ পরিনতি থেকে শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেয়নি। বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ জনতার সংহতি ও ব্যাপক সমর্থনপুষ্ট সরকারকে বিশ্বের কোনো পরাশক্তি অগ্রাহ্য করতে পারবে না। ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল করে ছাত্র-জনতার বিপ্লব ব্যর্থ করে দেয়াই এ মুহূর্তে বাংলাদেশ বিরোধী কুশীলবদের মূল লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া এবং রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক শক্তির বিষয় নয়। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল। একাত্তরের লাখো শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি করে যারা দেশকে ভারতীয় হেজিমনির গ্রাস বানিয়েছিল, তারাই এখন ২০২৪ সালের হাজার হাজার ছাত্র-জনতার আত্মদানকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে বশংবদ করার ঘৃণ্য খেলায় মেতেছে। এখন খন্ডিত দলীয় রাজনীতি ও ক্ষমতায় যাওয়ার পুরনো প্রতিযোগিতার সময় নয়। ফ্যাসিবাদের মূল কুশীলবদের বিচার নিশ্চিত না করে তাদের সহযোগীদের সাথে রিকনসিলিয়েশন সম্ভব নয়। তাজউদ্দিনের পরিবারের মত দু’একটা বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে আওয়ামী লীগের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুশোচনা ও আত্মসমালোচনার বদলে তারা এখনো মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহায়তায় মাফিয়াতান্ত্রিক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার অলীক স্বপ্নে বিভোর। এ দেশের সদা জাগ্রত সিপাহী- ছাত্র-জনতা সে স্বপ্ন দু:স্বপ্নে পরিনত করবে। স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও বাণিজ্য পরিচালিত হবে দেশের কৌশলগত শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। ভারত যেমন একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। শত শত বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ ভারত কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৃটেনের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রভাব রাখেনি। এমনকি বিভীষিকাময় যুদ্ধের স্মৃতি ভিয়েতনামের সাথে কিংবা জাপানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে না পারলেও গত ১৬ বছরে ভারতের কারণে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষিয়ে তোলা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পাকিস্তান যে বন্ধুত্বের বার্তা পাঠিয়েছে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকার তার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের একচেটিয়া বাণিজ্য সুবিধা ও নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে দেয়া এখন সময়ের দাবি। পাকিস্তান থেকে একটি পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আগমনে ভারত-বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের পিত্ত জ্বলে যাচ্ছে কেন? ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী তা যেমন অস্বীকার করা যায়না, একইভাবে পাকিস্তান, মিয়ানমার চীনও আমাদের আঞ্চলিক মিত্র ও বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ আর কখনোই বিশ্বকে ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী তা যেমন অস্বীকার করা যায়না, একইভাবে পাকিস্তান, মিয়ানমার চীনও আমাদের আঞ্চলিক মিত্র ও বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ আর কখনোই বিশ্বকে ভারত, চীন কিংবা আমেরিকার চোখে দেখতে চায় না।

[email protected].


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

স্মৃতির দর্পণে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
ডিকার্বনাইজেশনে আরো জোর দিতে হবে
ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখতে হবে
আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন
সরকারকে দৃঢ় ও গতিশীল উদ্যোগ নিতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

মির্জা ফখরুলের সঙ্গে দেখা করলেন ভুটান রাষ্ট্রদূত

মির্জা ফখরুলের সঙ্গে দেখা করলেন ভুটান রাষ্ট্রদূত

ইয়েমেন টনক নাড়িয়ে দিয়েছে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের

ইয়েমেন টনক নাড়িয়ে দিয়েছে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের

মহাখালীতে রিকশা চালকদের অবরোধ : ট্রেন চলাচল বন্ধ

মহাখালীতে রিকশা চালকদের অবরোধ : ট্রেন চলাচল বন্ধ

মহাখালীতে রেললাইনে ব্যাটারিচালিত রিকশা রেখে চালকদের অবরোধ, শহরজুড়ে তীব্র যানজট

মহাখালীতে রেললাইনে ব্যাটারিচালিত রিকশা রেখে চালকদের অবরোধ, শহরজুড়ে তীব্র যানজট

ভারতে সাজাভোগ শেষে দেশে ফিরলেন পাচার হওয়া ২৪ নারী-পুরুষ

ভারতে সাজাভোগ শেষে দেশে ফিরলেন পাচার হওয়া ২৪ নারী-পুরুষ

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিয়ে যা বলছে নেটিজেনরা

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিয়ে যা বলছে নেটিজেনরা

উ.কোরিয়ার চিড়িয়াখানায় সিংহ ও বাদামী ভাল্লুক উপহার দিলেন পুতিন

উ.কোরিয়ার চিড়িয়াখানায় সিংহ ও বাদামী ভাল্লুক উপহার দিলেন পুতিন

"আমি 'স্টারবাকস বর্জন করি আপনাদেরও করা উচিত"

"আমি 'স্টারবাকস বর্জন করি আপনাদেরও করা উচিত"

যানজটে স্থবির ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ভোগান্তি চরমে

যানজটে স্থবির ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ভোগান্তি চরমে

বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না জাবির শিক্ষার্থী রাচির

বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না জাবির শিক্ষার্থী রাচির

লাওসে বিষাক্ত মদের বিষক্রিয়ায় পর্যটকের মৃত্যু

লাওসে বিষাক্ত মদের বিষক্রিয়ায় পর্যটকের মৃত্যু

বিদায় বেলা ঢাকায় আসছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

বিদায় বেলা ঢাকায় আসছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

ইউক্রেন যুদ্ধ,রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতা!

ইউক্রেন যুদ্ধ,রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতা!

রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক আটকে বিক্ষোভে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা : চরম ভোগান্তি

রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক আটকে বিক্ষোভে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা : চরম ভোগান্তি

সেন্ট মার্টিন যাওয়ার ট্রাভেল পাস যেভাবে পাবেন

সেন্ট মার্টিন যাওয়ার ট্রাভেল পাস যেভাবে পাবেন

রাসিকের মাষ্টাররোলে নিয়োজিত ১৬১ কর্মীকে অব্যাহতি, ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শোকজ

রাসিকের মাষ্টাররোলে নিয়োজিত ১৬১ কর্মীকে অব্যাহতি, ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শোকজ

সিরিয়ার পালমিরা শহরে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় নিহত ৩৬, আহত ৫০

সিরিয়ার পালমিরা শহরে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় নিহত ৩৬, আহত ৫০

অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তাবিত শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ কার্যকর হবে কি?

অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তাবিত শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ কার্যকর হবে কি?

ক্ষেপণাস্ত্রের পর এবার ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্থলমাইন ব্যবহারের অনুমতি দিলেন বাইডেন

ক্ষেপণাস্ত্রের পর এবার ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্থলমাইন ব্যবহারের অনুমতি দিলেন বাইডেন

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান থাকছে না আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান থাকছে না আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে