চিন্তার রকমফের নিত্যসংকট ও জনদূরত্ব বাড়াচ্ছে
২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম
অন্তবর্তী সরকারের একশ’ দিন পুর্তি হয়েছে। দেশের বাইরে বর্তমান সরকারের ইমেজ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। একটি প্রতিবেশী দেশ বাদে অন্যান্য দেশের গণমাধ্যম অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে সেটা অনেকাংশে প্রযোজ্য। অনেকে বলেন, সেটা নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দরিদ্র বাঁচানোর অর্থনৈতিক দর্শন ও একান্ত ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে বাংলাদেশের উপর বহির্বিশ্বের অনেকের ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে। তবে আশাবাদী জনগণের বর্তমান চিন্তা ও চাহিদার গরমিল যেসব নিত্যনতুন সংকট সৃষ্টি করছে এবং সেগুলো সমাধানের ব্যর্থতা যে জনদূরত্ব সৃষ্টি করেছে, তা দেশের বাইরে থেকে অনুভব করার সুযোগ হয়তো তাদের হয়নি।
ইতোমধ্যে দেশে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। তারা মাঠে নেমে সংস্কার কাজের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু জনগণের অনুভূত প্রয়োজন (ফেল্ট নিড) মেটানোর জন্য সংস্কার কাজ হাতে নেয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তদের জন্য সরকারী সাহায্য, টেস্ট রিলিফ, শহর কেন্দ্রিক টিসিবির কিছু ওপেন মার্কেট দিয়ে বিশাল সাহায্যপ্রার্থী জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদার অতি সামান্য অংশ সমাধান করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখাও ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠেছে।
একটি স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস না পেরুতেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়েছিল। যেটা অদ্যাবধি এই সরকারে পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। এ খাতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের নিবিড় কাজ ও তাদের পোষ্যদের জীবন-জীবিকার সাথে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বহুলাংশে জড়িত। রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ ও বের হবার প্রধান সড়কগুলোর ধারে হাজার হাজার পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে, সেগুলোতে সামান্য কারণে অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে কারখানায় তালা ঝুলিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রচেষ্টা আমাদের দেশে পুরনো অপসংস্কৃতি।
অন্তবর্তী সরকারের যাত্রা শুরু থেকে পোশাক শ্রমিকদের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রচেষ্টা দেশকে ধীরে ধীরে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের গার্মেন্টস খাতে চরম অস্থিরতা অবলোকন করে বিদেশী বায়াররা ভিন দেশে অর্ডার সরিয়ে নেয়া শুরু করেছেন। এটা আমাদের অর্থনীতিকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ফ্যাসিবাদের দোসররা এই ঘৃণ্য পন্থায় দেশকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। সেনাবাহিনীকে সেখানে দায়িত্ব দেবার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও বারবার আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে কারখানা বন্ধ রাখায় শ্রমিকদের বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও স্বল্পমজুরীতে কর্মরত হলেও তাদের বেতন ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে।
আরেকটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় আহত-নিহতদের জন্য জন্য শক্তিশালী নীতি গ্রহণে ঢিলেমি করা। আন্দোলনের অব্যবহিত পরে সরকার গঠনের সাথে সাথে নিহতদের সাথে আহতেদের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরীর ব্যবস্থা করার চিন্তা মাথায় আসেনি। বিগত আন্দোলনে কতজন কিভাবে আহত হয়েছিলেন তার কারণও জানা যায়নি। তাই ‘আনসার লীগের’ মতো তিনমাস পরে ‘আহত লীগের’কথা উঠে এসেছে। ইতোমধ্যে জনপ্রিয় কিছু সমন্বয়কের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে ‘আহত লীগের’নামে চমকপ্রদ ভয়ংকর কিছু তথ্য।
একটি প্রথমসারির দৈনিক পত্রিকা লিখেছে, ‘আনসার লীগের পর এবার যে সরকার আহত লীগের খপ্পড়ে পড়েছে, এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের কথা আপনারা মানুষকে কেন জানাচ্ছেন না এখনো? আপনারা বারবার বলছেন, চিকিৎসা করেন, চিকিৎসা করেন, চিকিৎসা করেন। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু সুস্থ মানুষ যখন রাস্তায় শুয়ে উপদেষ্টা হওয়ার দাবি করে, সেটার চিকিৎসা কী হবে?’ একজন আহত মানুষ কেন উপদেষ্টা হতে চাইবে বা একজন আহত মানুষ কিভাবে সারাদিন অনুষ্ঠান করে এসে রাতে হাসপাতালে ঘুমাবে, এই প্রশ্নটা কেউই করছে না।’ তবে ফ্যসিস্ট চরিত্রের প্রতারণার কত রকমফের হতে পারে- এ থেকে সবার শিক্ষা নেয়া উচিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোন আহত ব্যক্তির জন্য আন্দোলন করে চিকিৎসা খরচ ও সেবার আঞ্জাম করতে হবে কেন? আহতরা হাসপাতালের বেড ছেড়ে রাস্তায় নেমে চিকিৎসার খরচের জন্য কান্নাকাটি ও চিৎকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর চেষ্টা দেশের মানুষকে অবাক করেছে। সবার আগে তাদের সুচিকিৎসার বিষয়টিকে মাথায় নেয়া উচিত ছিল। যখন আহতরা পঙ্গুত্ব বরণ করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত তখনও নতুন উপদেষ্টা পদ লাভের জন্য আরেক রাজপথে ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছিল!
এদের ভূমিকায় ঘন্টার পর ঘন্টা রাজপথে গাড়ির মধ্যে আটকা পড়ে যেসকল সাধারণ জনগণ কষ্ট পেয়েছেন তারা কি ভাবছেন? জনদুর্ভোগ পোহানো মানুষেরা অনেকটাই আশাহত হয়েছেন। প্রতিদিন ভয়াবহ যানযটের কবলে পড়া মানুষগুলো এসকল আন্দোলনকারীদের কাজের বৈপরীত্যের মধ্যে হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।
অন্তবর্তী সরকারের সময়ে মানুষ রাজপথে নেমে দাবী করা শিখেছে, কিন্তু সেসব দাবী আদায়ে আরো বেশী জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা নতুন করে শেখাচ্ছে বলে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করছেন। এতে সরকারে বিরুদ্ধে জনদূরত্ব সৃষ্টির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
উপরের সবগুলো ইস্যুকে ছাড়িয়ে যেটি আমাদের সমাজের প্রতিটি কর্ণারে গভীরভাবে জেঁকে বসেছে; তা হচ্ছে, নিত্য দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাস। নিত্যপণ্যের বাজার একবারেই অস্বাভাবিক ও অস্থির। নিত্যপণ্যে বাজারের উপর পতিত আওয়ামী সরকার তিনবছর আগেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। তারা সেটি গোপন করে গণমাধ্যমে ভিন্ন বিষয় উস্থাপন করে পার পেতে চেয়েছিল। ফলে দরিদ্র, নির্ভরশীল ও নি¤œআয়ের মানুষের সাথে বিগত সরকারের চরম দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। ডিম ও আলু এই দুটি গোলাকার পণ্য বাজারে সর্বপ্রথম গোলমাল সৃষ্টি করেছিল। চিনি, ভোজ্যতেল, চাল সবকিছুর বাড়তি মূল্য একসময় ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে হারিয়ে হতাশ করে তুলেছিল। সেই কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তিলাভের জন্য সারকারের কাছ থেকে দ্রব্যমূল্য নির্দিষ্ট করে দিয়ে দৈনিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু-সুলভ মূল্যনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আশা করা হয়েছিল। সাধারণ জনগণ বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের দিকে তাকিয়ে ১০০তম দিন পার করে দিলেও তাদের সে আশায় গুঁড়েবালি পড়ছে। নিত্যপণ্যের শুল্ক প্রত্যাহরেও বাজারে দাম কমছে না। কারণ, বাজারের বিক্রেতা ও তাদের সরবরাহকারিদের চেতনার সাথে চরম সমন্বয়হীনতা বিদ্যমান রয়েছে।
ইতোমধ্যে তাদের সাথে দেশের সমধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমচেতনা জাগ্রত করে দেবার পরিবর্তে উভয়ের পারস্পরিক চেতনার মধ্যে দূরত্ব তৈরীর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কোন কোন উপদেষ্টা দেশের সমধারার রাজনৈতিক নেতাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে আপনমনে যা ভাল হয় তা ভেবে কাজ করে চলছেন। যা কার্যত: জনবিরোধী অবস্থান নেয়ার নামান্তর।
এমনকি ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যেও চরম বিভাজন লক্ষ্যণীয়। তাবলীগ জামাত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও পাল্টাপাল্টি কর্মূসূচি পালন দেশে সমগ্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে আহত করছে। এসব সাধারণ মানুষের মনের ভাষা নয়, সেটা কারো নিকট ইতিবাচক বা কাম্য পরিস্থিতিও নয়।
তরুণরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর। তারা সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করার আগেই কেউ কেউ ফ্যসিবাদের দোসরদের কব্জায় পড়ে বিভিন্ন পদ-পদবী বাগিয়ে বিলাসী জীবনের দিকে ধাবিত হবার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পদবঞ্চিতদের সাথে তাদের দূরত্ব তৈরী হয়েছে। তিনমাস না পেরুতেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতের পার্থক্য শুরু হয়েছে। ফলে সেই শুরুর সময়ের তারুণ্যের স্পিরিট নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছে।
তারুণ্যের স্পিরিট নষ্ট হবার এই সংকটকালে কেউ কেউ ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে অন্ত:ফ্যাসিবাদ নির্মূলের বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু বর্তমান জনদূরত্ব বহাল রেখে নিজেদের মধ্যে মতের ভিন্নতাকে প্রচার হবার সুযোগ দিতে থাকলে নতুনভাবে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত হবে কোন পন্থায়? সমধারার রাজনৈতিক দলগুলো এভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে আরো দূরে সরে যেতে থাকলে সেখানে ব্যালট বিপ্লব হবেই বা কিভাবে?
একসঙ্গে এতবেশি সংস্কারে হাত দিতে গিয়ে কোনটাই ঠিকমতো হচ্ছে না- এমন অবস্থা জাতিকে আরো বেশি আশাহত করে তুলতে পারে। তাই সবার আগে জনদূরত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে রুখে দিয়ে জনসম্পৃক্তাতা বাড়ানোর কাজে এগিয়ে এসে, সেই শুরুর সময়ের তারুণ্যের স্পিরিটকে নষ্ট হবার হাত রেখে রক্ষা করতে হবে। শুধু বিদেশে নয়, প্রধান উপদেষ্টার ফেসভ্যালুকে গোটা দেশের অভ্যন্তরে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা দরকার। এর সাথে দেশের আশাবাদী মানুষের চিন্তা-চেতনার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য আরো কিছু নতুন প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
ফ্যসিবাদ বর্তানো শুধু একজনের কাজ হলেও- এর ডালপালা ও শেকড় আমাদের দেশ ও সমাজের অতি গভীরে প্রোথিত হয়ে সেটার অনুশীলণ এখনও দেশ-বিদেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যাপ্তি ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে। এর সমূল উৎপাটন করতে হলে সকল রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে প্রচেষ্টা চালানোর কোন বিকল্প নেই।
লেখক: অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যাল ।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আইনজীবী হত্যায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান
ঢাবিতে আইনজীবী সাইফুলের গায়েবানা জানাজা
মায়ামিতে মেসিদের নতুন কোচ মাশ্চেরানো
চিন্ময় সম্পর্কে দিল্লির বক্তব্যকে বন্ধুত্বের চেতনার পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে ঢাকা
উত্তাল ইসলামাবাদে সেনা মোতায়েন
আদানির গ্রেপ্তারের দাবিতে বিহার বিধানসভার সামনে বিক্ষোভ
র্যাবের ‘কসাই’ সাবেক এসপি ফারুকীর বিচার না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে
হজযাত্রী নিবন্ধন ২ মাস বাড়ানোর দাবি
সংঘাত-অস্থিরতার দায় সরকার এড়াতে পারে না : এবি পার্টি
অহিংস গণঅভ্যুত্থানের সংগঠকসহ ১৮ জন কারাগারে
হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ ড. ইউনূসের
ঐক্যের শক্তি ধ্বংস করতে ছড়ানো হচ্ছে বিভেদের বিষ: মুশফিক আনসারী
পরিবেশ কর্ম-পরিকল্পনা ২০২৪-২০৩০ চালু করেছে এডিবি
লন্ডনে হাইকমিশনার সাইদা মুনার রাজত্বের অবসান হচ্ছে
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক উস্কানির ফাঁদ পাতা হচ্ছে
জাতীয় অর্জনে কৃষক ও কৃষিবিদদের অবদান অনস্বীকার্য -স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা
বিজেপির হুমকির যথাযথ জবাব দিতে হবে
বগুড়ায় মারা গলেনে কারাবন্দী আওয়ামী লীগ নতো শাহাদত আলম ঝুনু
গাজীপুরে বন বিভাগের জমি উদ্ধারে বাধাঃ হামলায়i এসিল্যান্ড সহ আহত ১০ গাড়ি ভাঙচুর