সংস্কার ও জাতির স্বপ্ন
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের চরম শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ৯ মাস যুদ্ধ করে জালেম শাসক গোষ্ঠীর করালগ্রাস থেকে দেশ স্বাধীন হলেও আমরা আজ অবদি পরিপূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারিনি, মুক্ত হতে পারিনি জুলুম, বৈষম্য ও দুর্নীতির নাগপাশ থেকে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে আমরা বরাবরই নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছি। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের আমলে গোটা জাতি এক শ^াসরুদ্ধকর জুলুমের কবলে পড়েছিলো। শুধু ভোটের অধিকার এবং বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয় নাই বরং ন্যায় বিচারের সংজ্ঞাটাও বিকৃত করে দেয়া হয়েছিল। ঘুষ, দুর্নীতি অঘোষিত আইনে পরিণত হয়েছিল। কালোবাজারী পুঁজিপতিদের সিন্ডিকেটের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর নীরব দুর্ভিক্ষ ও চাপা কান্না আজো থামছে না। বিগত সময়ে বিভিন্নভাবে দেশের মানুষ নিগৃহীত, নিষ্পেষিত ও অধিকার বঞ্চিত হয়েছে। দীর্ঘ উৎপীড়ন, যাতনা ও ভয়-ভীতিতে ক্ষত-বিক্ষত, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এই জাতি আজ জাতীয় জীবনের টার্নিংপয়েন্টে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছে, স্বাধীনভাবে এবং সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার। জাতি এখন পূর্ণ স্বাধীনতা চায়, মুক্তি চায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর মানুষ আশা করছে, শুধু ক্ষমতার হাত বদল নয়, নীতি-নৈতিকতারও পরিবর্তন হবে। ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারী, মজুদদারীসহ সকল প্রকার নীতিহীনতার জঞ্জাল থেকে জাতি মুক্তি পাবে। রাষ্ট্রের বিশেষ বিশেষ জায়গায় সংস্কার হবে। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন নয় বরং নীতি ও পদ্ধতিরও পরিবর্তন হবে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোকে এমনভাবে ঢেলে সাজানো হবে, যাতে যেকোনো সরকারের আমলেই এই বিভাগগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের সংস্কার খুবই জরুরী। স্বাধীন বিচার বিভাগ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করলে বিচার বিভাগ তার গতিতে চলতে পারেনা, বিচার অবিচারে পরিণত হয়। আমরা দেখেছি, পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির ইশারায়ই বিচার বিভাগ চলেছে। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে মর্জিমত এবং বিরোধীদল বা বিরোধীমতকে দমন করার কাজে। পুলিশ প্রশাসনকে পরিণত করা হয়েছে সরকারী দলের পোষ্য বাহিনীতে। ফলশ্রুতিতে, সরকারি দলের নেতাকর্মীরা বেপরোয়াভাবে বিভিন্ন রকম অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। অথচ, তাদের উপর মামলা হয়নি, মামলা হলেও তারা অনায়াসে জামিন পেয়ে গেছেন এবং নির্দ্বিধায় তাদের অপরাধ কর্ম চালিয়ে গেছে। এর বিপরীতে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের উপর কারণে-অকারণে মামলা দিয়ে সর্বশান্ত করা হয়েছে। বিগত ১৬ বছরে বিচার বিভাগ একটি রাজনৈতিক দলের আইন বিভাগে পরিণত হয়েছিলো এবং সেই দলের নেতাকর্মীদের সকল অপকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। জাতি এই অবস্থার পরিবর্তন চায়, ভবিষ্যতে কোনো সরকার বিচার বিভাগের উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে দেশকে কারো পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত করুক, এটা আর চায় না।
মানুষ এখন স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, আইনের শাসন ও বিচারের নিশ্চয়তা চায়। বিগত সরকারের আমলে যত গণহত্যা হয়েছে, যেমন শাপলা চত্বরে হেফাজতের উপর গণহত্যা, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে গণহত্যা, জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের ফাঁসি, ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টের গণহত্যাসহ সব হত্যাকা- এবং গুম-খুনের ঘটনার সাথে জড়িত রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সকল অপরাধিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ মানুরে উপর এমন নৃশংসতা চালাতে না পারে। সাথে সাথে বিগত সময়ে গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণসহ তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শহীদদের তালিকা তৈরী করে তাদেরকে জাতীয় বীর ঘোষণা করে শহীদ ও আহতদের পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। বিগত সময়ে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাসীনদের একান্ত আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। ফলে দিনের ভোট রাতে হয়ে যেত, মৃত লোকদেরও ভোট দেয়া হতো। এমনকি কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে ভোটারের মোট সংখ্যার চেয়েও বেশি ভোট সরকারী দলের প্রার্থীরা পেত। অথচ নির্বাচন কমিশনাররা সাংবিধানিকভাবে শপথবাক্য পাঠ করেই এই কাজে যোগ দিয়েছেন। এরকম বাজে কাজ করার জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। একারণে নির্বাচন কমিশণের সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ, কোন দল বা সরকার যেন এই কমিশনের উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং নির্বাচন কমিশিনও যাতে কোনো দলের এজেন্ডা নিয়ে কাজ না করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নীপিড়ন দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অবৈধ উপায়ে উপার্জন ও বিদেশে টাকা পাচারের ধারা বন্ধ করতে হবে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের বিভিন্ন সুবিধাভোগীরা যে বিরাট অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন ও দেশে-বিদেশে যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, সে সম্পদ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি প্রতিবেদন দেখা গেছে, বিগত সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এই পাচারের সাথে জড়িতে ছিলেন শেখ পরিবারের সদস্য ছাড়াও সাবেক ৩১ জন মন্ত্রী ও এমপি। তারা ব্যবহার করেছেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছর থেকে দেশের অর্থনীতিতে ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতিসহ নানারূপ টানাপড়েনের অন্যতম কারণ হলো, অর্থ পাচার। তবে অর্থ পাচার এর আগেও হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সাথে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর চুক্তি বাংলাদেশের রয়েছে। জনগণ চায়, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে ফিরিয়ে এনে দেশের পুনর্গঠন এবং সংস্কারের কাজে ব্যয় করা হোক এবং অর্থ পাচারের এই ধারা চিরতরে বন্ধ হয় এমন ব্যবস্থা করা হোক।
বিগত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে গেছে। নি¤œ আয়ের মানুষ ঠিক মতো পরিবার চালাতে পারছে না। একজন দিনমজুর প্রতিদিন যে টাকা রুজী করে, তা দিয়ে তার পরিবারের অর্ধেক চাহিদাও মিটাতে পারে না। খেটে খাওয়া মানুষগুলো আজ দিশেহারা। এ অবস্থায়, নি¤œ ও মধ্য আয়ের লোকদের হাহাকার বন্ধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটগুলো ভেঙ্গে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফ্যাসিবাদের দোসরদের হাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে মুক্ত করবে এই আশা ও স্বপ্ন আজ গোটা জাতির।
লেখক: সিনিয় মুহাদ্দিস, জামিয়া আয়শা সিদ্দিকা, মেজরটিলা, সিলেট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬
যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা
বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান
নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ
সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত
শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন
আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ
বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার
পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি
‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’
ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি
পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল
অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?
চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন